যেন এক
ভূ-দৈত্য আমাদের শহরটাকে ধরে ঝাঁকিয়ে দিল। ছুটির দিন হওয়ায় অনেকে ছিল ঘুমের
ঘোরে, কেউ রান্নাঘরে নাস্তা বানাতে ব্যস্ত, কেউ ওয়াশরুমে, কেউ বাজারে, কেউ
চায়ের পেয়ালাটা হাতে নিয়ে চুমুক দিচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই সব কেঁপে উঠল।
যেন মাটি নয়, আমাদের বুকটাই কাঁপছিল। ভয়টা এমন ছিল, মনে হলো চারপাশের সব
দেয়াল হঠাৎই ভেঙে ধুলায় পরিণত হবে।
ঢাকা শহরে আছি প্রায় চল্লিশ বছর, এই
শহরে এমন দুলুনি আগে দেখিনি। আজ সত্যি ভয় পেয়েছি। পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছি,
আতঙ্কটা দেশজুড়েই ছিল। বিশেষ করে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীতে ভয়াবহ
আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। সেখানে মাটির ঘরের দেয়াল ধসে অন্তত দুজনের মৃত্যুর খবর
পাওয়া গেছে। পুরানো ঢাকায়ও মৃতের সংখ্যা চারের মতো।
১৫ তলা ভবনের ৯
তলায় আমার বাস। ঘুম থেকে জেগে ল্যাপটপে পত্রিকা পড়ছিলাম। আকস্মিক প্রবল
ঝাঁকুনিতে মনে হলো, এবার বুঝি সব শেষ হতে যাচ্ছে! আমাদের পুরো বিল্ডিংটা
দুলছিল, আর চারদিকে এক ধরনের হাহাকার, চিৎকার, দোয়া-দরুদ, সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত
নেমে যাওয়ার শব্দ-সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, বাঁচার আকুতি যেন একেকটা
প্রতিধ্বনির মতো বাতাসে ভাসছে। কেউ বলছিল ‘আল্লাহু আকবর’, কেউ ‘লা ইলাহা
ইল্লাল্লাহ’, আবার কেউ শুধু চিৎকার করছিল, ‘নেমে যান, নেমে যান!’ বাচ্চাদের
কান্না, বয়স্কদের হাঁপ ধরা ভয়–সব মিলিয়ে এক বিশৃঙ্খল ও ভয়ার্ত মুহূর্ত।
নিচে
নেমে দেখি আরও অদ্ভুত সব দৃশ্য। ছোট ছোট বাচ্চারা প্রিয় খেলনা নিয়ে
নেমেছে। কারও টেডি বিয়ার, কারও গাড়ি, কারও বল, বুকে চেপে দাঁড়িয়ে আছে। যেন
ওটাই তাদের সুরক্ষা।
কেউ নিজের পোষা বিড়ালকে কোলে নিয়ে এসেছে, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে দুজনই।
কেউ পাখির খাঁচা নিয়ে নেমেছে, আবার কেউ কুকুরটাকে টেনে আনতে আনতে বেরিয়েছে।
অনেকে খালি পায়ে, মাটিতে ছোট ছোট পাথর লেগে পায়ে ব্যথা পেয়েছে, কিন্তু ওসব ভাববার সময় কোথায়!
অনেকে
ঘরের পোশাকেই চলে এসেছে। ছেলেরা অনেকে খালি গায়ে, যে মেয়েরা ওড়না ছাড়া
ঘরের পা ফেলে না, তাদের অনেকেই ওড়না পরে আসতে ভুলে গিয়েছে। সবার মনে একটাই
চিন্তা, বাঁচতে হবে, বের হতে হবে। অনেকের মুখে শুনলাম, তাড়াহুড়োয় কেউ
মোবাইল ফোনটা আনতেই ভুলে গেছে। পরে আবার ওপরে উঠবে কি না, সেই দ্বিধা।
আবার
কিছু মানুষের দেখা পেলাম, যাদের মাথা ঠান্ডা। তারা এই চরম দুঃসময়েও
অবিশ্বাস্য দ্রুততায় পাসপোর্ট, টাকা, গয়না, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র-সব এক
ব্যাগে গুঁজে নিয়ে নেমেছে! চরম বিপদের মুহুর্তেও তারা কত হিসেবি, আরও
বাঁচার, সম্ভাব্য সংকট মোকাবেলায় তারা কত সিদ্ধহস্ত।
তবে আজকের সকালটা
ছিল সবার জন্যই চরম ভীতি ও আতঙ্কের। সেই সময় মৃত্যুভয় সবাইকে যেন তাড়া
করছিল। তাড়াহুড়া কর নামতে গিয়ে কত মানুষ আহত হয়েছেন, আঘাত পেয়েছেন, তার
পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। তবে সংখ্যাটা খুব কম নয়।
আমাদের দেশে ভূমিকম্প
নিয়ে সচেতনতা খুব কম। সবারই এক রকম ধারণা, আমাদের দেশে বড় কিছু হবে না।
কিন্তু আজ মাত্র ৫-এর কিছু বেশি মাত্রার একটা ধাক্কাই আমাদের এমন তটস্থ করে
দিল। মনে হচ্ছিল, এটা যদি ৬ বা ৭ হতো? আমাদের ভবনগুলো কি টিকতো? আমরা কি
সময়মতো বের হতে পারতাম?
বিশেষজ্ঞরা তো বহুদিন বলছেন, ভূমিকম্পের জন্য
সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহরগুলোর একটা ঢাকায় আমাদের বাস। বিল্ডিংগুলোর
বেশিরভাগেরই মান নেই, কোথাও নিরাপত্তা নেই, কোথাও সঠিক তদারকি নেই। শহরটাকে
আমরা এমনভাবে সাজিয়েছি, দেখতে ঝলমলে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে এটা একটা
মৃত্যুফাঁদ। কিন্তু আমরা কেউ বিষয়টা অনুভব করি না। ভাবি না।
আজকের
ভূমিকম্পে আমি একটা জিনিস বুঝেছি-মৃত্যু সত্যি আমাদের কত কাছে। আমরা যত বড়
কর্মকর্তাই হই, যত বড় ব্যবসায়ী হই, যত ধনী হই, যত ক্ষমতাবান হই, একটা
ভূমিকম্প আমাদের সবকিছু কয়েক সেকেন্ডে শেষ করে দিতে পারে। সুরম্য ফ্ল্যাট,
দামি গাড়ি, কয়েক তলা বাড়ি-সবই মুহূর্তে চূর্ণবিচূর্ণ হতে পারে। মাটি কাউকে
ছাড় দেয় না। এটা বুঝলে আমরা একটু কম অহংকারী হব।
সকালের সেই কাঁপুনির
রেশে কেবলই মনে হচ্ছে, আমরা আসলে কত অসহায়, আমাদের আয়ু কত ক্ষণস্থায়ী।
আমাদের জীবনটা আসলে একটা সুতোয় ঝুলে থাকে। একটা ছোট ধাক্কা, একটা হালকা
শব্দ, আরেকটু বেশি কাঁপুনি-এটাই যথেষ্ট সব শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য।
মানুষের
মুখগুলো দেখছিলাম, একেকজনের মনে মনে একেক রকম ভয়। কেউ নিজের সন্তানকে
জড়িয়ে ধরেছে, যেন পৃথিবীর সব আঘাত থেকে তাকে আড়াল করবে। কেউ মাকে ধরে
রেখেছে, যেন তাঁকে কিছু না হয়। আবার কেউ ফোনে প্রিয়জনকে ব্যস্তভাবে বলছে,
তুমি কোথায়? ভালো আছ তো? মৃত্যুভয় এক অদ্ভুত জিনিস, এটা মানুষকে মুহূর্তেই
অন্য মানুষে পরিণত করে।
আত্মীয়তা, ভালোবাসা, বন্ধন- সব আরও জোরালো হয়ে ওঠে।
আজকের
সকালের ভূমিকম্পের পর আমরা একটু হলেও ভাবব না, এই দৌড়ঝাঁপ, এই
প্রতিযোগিতা, এই অপরিকল্পিত বিল্ডিং তৈরি-সব কি তবে সামান্য একটা কাঁপুনির
জন্য? আমরা হয়তো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থামাতে পারব না, কিন্তু প্রস্তুতি নিতে
পারব। সচেতনতা বাড়াতে পারব।
স্কুলে ভূমিকম্প মহড়া বাধ্যতামূলক হওয়া
উচিত। অফিসে নিয়মিত প্রশিক্ষণ থাকা উচিত। বিল্ডিং নির্মাণে কড়া নিয়ম থাকা
উচিত। এমন নিয়ম, যা মানতেই হবে। এগুলো হলেই হয়তো বাঁচার হার বাড়বে।
কিন্তু
অযথা ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। মিথ্যা ‘বাঘ আসছে’ বলে চিৎকার করলে যেমন বিপদে
সবাই উদাস হয়ে যায়-ঠিক তেমনই ভূমিকম্প নিয়ে শুধু আতঙ্ক ছড়ালে সত্যিকারের
বিপদের দিনে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। দরকার
সচেতনতা, দরকার পরিকল্পনা।
আজকের ভূকম্পন পর বার বার মনে হচ্ছে, আসলে
আমরা কতটা ছোট! আমাদের কামনা-বাসনা, হিংসা-বিদ্বেষ, টাকা-পয়সা,
পদ-মর্যাদা-সবই কত তুচ্ছ। মাটি কাঁপলেই বোঝা যায়, আমাদের কেউ নেই, কিছু
নেই। কিছুই নিজের না।
আমরা যদি একটু মানবিক হই, একটু একে অপরের পাশে
দাঁড়াই, যদি একটুখানি সতর্ক হই, তাহলেই হাজার প্রাণ রক্ষা পেতে পারে। আজকের
দুলুনি আমাদের সেই শিক্ষা দিক, জীবন বড় দামি। মানুষ আরও দামি। একসঙ্গে
বাঁচার চেয়ে বড় আর কিছু নেই।
আজ সকালের ধাক্কাটা আমাদের নির্বোধ
দৌড়ঝাঁপ থামিয়ে নতুন করে বাঁচতে শেখাক। আমরা যেন একে অপরের দিকে হাত বাড়াই,
ভয় কমাই, সচেতনতা বাড়াই। সবাইকে নিয়ে সবার জন্য বাঁচি।
লেখক: কলামিস্ট
