বৃহস্পতিবার ৩০ অক্টোবর ২০২৫
১৪ কার্তিক ১৪৩২
রেনেঁসা, ষোড়শ শতাব্দীর ইউরোপে নবজাগরণের মহাবিপ্লব
তানভীর হাসান ধ্রুব
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৫, ১২:১৪ এএম |



ইতালির রোমের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত পৃথিবীর ক্ষূদ্রতম দেশ ভ্যাটিকানের রাজধানী, ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স স্কয়ারের সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা ইউরোপের শিল্পে নবজাগরণের অন্যতম নিদর্শন। পুরো ভবনটির দেয়ালে এবং এর আশেপাশের এলাকাজুড়ে সজ্জিত ভাস্কর্যগুলো যেন একএকটি জীবন্ত স্বর্গীয় দূত! সেন্ট পিটার্স পৃথিবীর বৃহত্তম গীর্জা কিন্তু তার চাইতেও আশ্চর্যের বিষয় হোলো এই স্থাপনাটির নির্মাণকাজ কয়েক প্রজন্ম আগেও ছিলো রীতিমতো অসম্ভব! তখন কারও কাছে এই সুবিশাল স্থাপনা নির্মাণের মতো যথেষ্ট গণিত,পদার্থবিদ্যা এবং স্থাপত্য বিষয়ক জ্ঞান ছিলোনা। তারপর ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে শিল্পী এবং স্থপতিরা এমন কিছু করে দেখান যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে হাজার বছর ধরে ছিলো অকল্পনীয়। ইতিহাসের পাতায় এই সময়টি রেনেঁসা নামে পরিচিত,যার বাংলা অর্থ ‘পুনর্জাগরণ’। এসময়ে ইউরোপীয় শিল্পে আগমন ঘটে মাইকেল এঞ্জেলো এবং লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির মতো মেধাবীদের যারা অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন। সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা তৈরি হয়েছিলো ১৫৪৭ খ্রীস্টাব্দে, মাইকেল এঞ্জেলোর দিকনির্দেশনায়। মাইকেল এঞ্জেলো ছিলেন এই গীর্জার প্রজেক্ট ম্যানেজার,শিল্পী এবং স্থপতি। তিনি শুধুমাত্র একজন শিল্পী ছিলেন না,তিনি একজন বৈজ্ঞানিকও ছিলেন। শিল্পজগতে তিনি রেনেঁসা মানব হিসেবে পরিচিত। তাঁর তৈরি ভাস্কর্য ‘ডেভিড’ শিল্পকলার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নিদর্শন! মাইকেল এঞ্জেলো ‘ডেভিডের’ নির্মাণকাজ শুরু করেন ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে। ১২ টন মার্বেল পাথরের ব্লক খোদাই করে এর নির্মাণকাজ তিনি শুরু করেছিলেন এবং প্রথম ২ বার ব্যর্থ হয়ে ৩য় ধাপে পূর্ণাঙ্গ সফলতা লাভ করেছিলেন। টানা ৩ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ৫ মিটার উচ্চতার এই ভাস্কর্য তিনি নির্মাণ করেছিলেন। রেনেঁসা সময়কাল মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন এক যুগের সূচনা ঘটিয়েছিলো যা মানুষকে নিজের স্বরূপ সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছিলো। পোপ ৩য় ইনোসেন্ট এই ব্যাপারে বলেছেন,“দ্বাদশ শতাব্দীর শেষদিকে মানব সভ্যতার পঁচন ধরেছিলো,মানুষ আঠা এবং ছাইকে অবজ্ঞাসূচক দৃষ্টিতে দেখতো। মানুষের অভিব্যক্তিতে মধ্যযুগীয় বিশ^াস এবং পাপিষ্ঠ প্রবৃত্তি দৃশ্যমান ছিলো। রেনেসাঁ যুগে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাাই কিভাবে এসব হতাশাবাদী ভাবমূর্তী শ্রমসাধ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মানব শারিরিক গঠনের মাঝে ঐশ^রিক প্রবৃত্তির দেখা পাওয়া যায় এই যুগে।” ‘ডেভিড’ ভাস্কর্যটি নির্মাণের দশ বছর পর পোপ ২য় জুলিয়াসের উপাসনালয়ে মাইকেল এঞ্জেলোর পরবর্তী শিল্পকর্মের দেখা মেলে,যা হযরত মূসা (আ:) এর প্রতিমূর্তি। লাইফ সাইজ থেকে বড় এই ভাস্কর্যটিতে হযরত মূসার ক্রোধাত্মক অভিব্যক্তি পেশিবহুল শরীর দৃশ্যমান, যেভাবে প্রাচীন বিশে^ ঈশ^রকে কল্পনা করা হোতো। মাইকেল এঞ্জেলোর মতো শিল্পীরা প্রাচীন গ্রীক এবং রোমান শিল্পশৈলী থেকে ধারণা নিয়ে একটি নতুন ধারা তৈরি করেন। রেনেঁসা যুগের শিল্পে কোনরকম অনুকরণ লক্ষ্য করা যায় না। শিল্পী বতিচেল্লির ‘প্রিমাভেরা’ চিত্রকর্মটি রেনেঁসা যুগের সুপরিচিত চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে একটি। শিল্পী রাফায়েলের ‘স্কুল অব এথেন্স’ পেই›টিং থেকে প্রাচীন চিন্তাধারার প্রাচুর্যতা লক্ষ্য করা যায়,এবং শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’ পেইন্টিংটি দেখার জন্য এখনও দর্শনার্থীদের ভিড় জমে থাকে প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে! হাজার বছর ধরে ত্রিমাত্রিক বাস্তব পৃথিবীকে একটি মসৃণ ক্যানভাসে উপস্থানের সক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো,তারই পুনর্জাগরণ ঘটে রেনেঁসা যুগে। এই যুগটি স্থাপত্যশৈলীর বিকাশের সোনালী যুগ এবং এর উৎসাহ এসেছিলো প্রাচীন শিল্পশৈলী থেকে। প্রাচীন বিশে^ অতিকায় গম্বুজ বিশিষ্ট স্থাপত্যের বিস্মৃতি ছিলো যা পুনরায় আবিষ্কিৃত হয়েছিলো এসময়ে। রেনেঁসা যুগ শুধুমাত্র শিল্পচর্চায় সীমাবদ্ধ থাকেনি,এসময়ে নতুন ধাঁচের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রেরও আবিষ্কার হয়েছিলো এবং সেই সাথে মানব শরীরের গবেষণায় অসাধারণ উন্নতী দেখা গিয়েছিলো। পকেট সাইজের ঘড়ি, কম্পাস এবং জোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন পৃথিবী এবং বিশ^জগতের অনেক রহস্য খোলাসা করেছিলো,যার সাহায্যে নাবিকরা সমুদ্রে দিক খুঁজে পেতো এবং তারই ফলশ্রুতিতে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকা মহাদেশে বিস্তার করা ইউরোপীয়দের কাছে সহজতর হয়েছিলো। স্থপতি এবং ভাস্কর ব্রুনেলেস্কি বিশেষ ধরনের ক্রেন তৈরি করেন যা দিয়ে বড়বড় মার্বেল পাথর তেলা হোতো স্থাপনার নির্মাণে। তিনি হায়া সোফিয়া এবং অন্যান্য প্রাচীন স্থাপনার নির্মাণে গম্বুজের ব্যাবহার দেখে অনুপ্রাণীত হয়েছিলেন। তাঁর আবিষ্কৃত ক্রেন জাহাজে মালামাল তোলার ক্ষেত্রে যুগান্তকারি পরিবর্তন এনেছিলো। ইতালির ভেনিস,ফ্লোরেন্স,মিলানের ভবনগুলোতে নতুন ধাঁচের স্থাপত্যশৈলির দেখা পাওয়া যায় এসময়ে। সুইশ স্থপতি এন্টোনিয়ো কোন্তিনো এই নতুন ধারার স্থাপত্যশৈলীতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। রেনেঁসা যুগের শিল্পীদের মধ্যে রিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির নাম ইতিহাসের পাতায় ধ্রুবতারার মতো চমকাচ্ছে। ভিঞ্চির শুধুমাত্র ‘মোনালিসা’ ই একমাত্র সাফল্য নয়,তিনি কামানের নকশা করেছেন,আকশে উড়বার স্বপ্ন নিয়ে পাখির ডানার আদলে নকশা করেছিলেন যা সেসময়ের হিসেবে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ই বলা যায়। ইউরোপে রেনেঁসা শুধমাত্র একটি ইতিহাসের অংশ না,এটি এমন এক সময় যখন পৃথিবীতে একরকম নতুন মানব সভ্যতার সূচনা ঘটেছিলো। 
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ,চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়।
মোবাইল নং: ০১৯৭৬৪৩৫৫৭৪ 
ইমেইল: ঃ anvirdhruba503@gmail.com












http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
মুলার আগাম ফলনেও হাসি নেই কৃষকের মুখে
নভেম্বরে নতুন পোশাক পাচ্ছে পুলিশ
নির্বাচন ঘিরে ‘সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি’ মোকাবিলায় প্রস্তুতির নির্দেশ
২৬৬৪ ইয়াবাসহ আটক যুবদল নেতা রহিম
ব্রাহ্মণপাড়ায় মাদকের ১৯ মামলার আসামী সবুজসহ গ্রেপ্তার ৫
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
অভিযানের পরদিনই দালালের খপ্পরে প্রাণ গেলো প্রসূতির
ডেঙ্গু কেড়ে নিল আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন ত্বকীকে
২৫০ আসনে গ্রিন সিগন্যাল দিতে যাচ্ছে বিএনপি, রয়েছে কঠোর বার্তাও
চান্দিনায় ক্রেতা ও বন্ধকির ৪ কোটি টাকার স্বর্ণ নিয়ে উধাও ব্যবসায়ী
লাল শাকে রঙিন গোমতীর চর
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২