বৃহস্পতিবার ৩০ অক্টোবর ২০২৫
১৪ কার্তিক ১৪৩২
খাদ্য, পুষ্টি ও নিরাপত্তা: সুস্থ জীবনের মূল ভিত্তি
ড. আলা উদ্দিন
প্রকাশ: সোমবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৫, ১:১৩ এএম |


বিশ্বের অন্যতম মৌলিক মানবাধিকার হলো নিরাপদ ও পর্যাপ্ত খাদ্য। এই বছরের বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৫ আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে- খাবার শুধু তৃপ্তির উপকরণ নয়; এটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে একটি দেশের স্থিতিশীলতার ম‚ল স্তম্ভ। কিন্তু বাংলাদেশে আজ খাদ্য নিরাপত্তা সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, প্রশ্ন করতে হয়-আমরা কি ঠিকঠাক খাই? আর সেই খাওয়া কি আমাদের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎকে রক্ষা করছে?
প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর পালিত বিশ্ব খাদ্য দিবস খাদ্যের যৌক্তিক ও ন্যায়সম্মত সরবরাহ নিশ্চিত করার আহ্বান জানায়। পাশাপাশি ডবিøউএইচও ও এফএও যে বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা দিবস ৭ জুন পালন করে, তারও অন্যতম উদ্দেশ্য- নিরাপদ খাদ্যের প্রচার ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি। দুর্ভাগ্যবশত এই বার্তাগুলো বাংলাদেশে বারবার উপেক্ষিত হচ্ছে। মাঠে বাস্তবতা এমন যে, রাস্তার ধারে বিক্রি হওয়া খাবার থেকে শুরু করে বড় বড় সাপ্লাইচেইন- প্রায় প্রতিটি স্তরেই অনিরাপদ খাদ্যের উপস্থিতি দেখা যায়।
অনিরাপদ খাদ্য শুরুর দিকে পেটের ত্রæটি, ডায়রিয়া বা বলিরেখার মতো স্বল্পকালীন সমস্যার কারণ হলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, হৃদরোগ, ক্যানসারসহ নানা অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। অনেক ক্ষেত্রেই নাগরিকরা বুঝতে পারেন না তাদের দৈনন্দিন রোগের পেছনে খাদ্যভিত্তিক বিষাক্ততা বা ভেজালের অবদান আছে- কারণ এই জটিল রোগগুলো বহু বছর ধরে আলোকপাত হয় না। আর যখন পুরো পরিবারই অসুস্থ, তখন অর্থনৈতিক উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়- শিশুরা স্কুল থেকে দ‚রে থাকে, কর্মক্ষমরা কাজ হারায়, গৃহস্থালি সংকট বাড়ে। 
সংখ্যায় প্রকাশ করা না গেলেও ক্ষতির পরিমাণ বাস্তবে বিপুল। প্রতি বছর খাদ্যবাহিত রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় হয় বিপুল অর্থ, যা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। খাদ্যের অস্বাস্থ্যকর গুণমান শুধু স্বাস্থ্যকে নয়, জাতীয় অর্থনীতিকেও দুর্বল করে দেয়।
খাদ্য নিরাপত্তার সংকট সবার কাছে সমানভাবে কাজ করে না। শহুরে দরিদ্র, পথশিশু, দিনমজুর, ও গ্রামীণ পরিবার- এরা সবচেয়ে ঝুঁকিপ‚র্ণ। তাদের কাছে সস্তা, সহজলভ্য খাবারই প্রধান; আর সস্তা প্রায়শই মানহীন। জোর করে বেঁচে থাকা এসব মানুষ কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি রোগের শিকার হলে চিকিৎসা বহন করতে পারে না। ফলস্বরূপ তাদের জীবনযাপনের মান ক্রমাগত খারাপ হয় এবং সামাজিক অমঙ্গল সৃষ্টির স‚চনা হয়।
আরও একটি জ্বলন্ত বাস্তবতা- ধর্মীয় উদযাপনের সময়, যেমন রমজান মাসে, বাজারে নৈতিক অবক্ষয় প্রবল হয়। ঐতিহ্যগত পবিত্রতার ছাপ রেখে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মেয়াদোত্তীর্ণ বা রাসায়নিক পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত খাবার বিক্রি করে। খেজুর, ফল, দুধ প্রভৃতি সামগ্রী তখন তুলনাম‚লকভাবে দামি হয়ে যায়। গতকালের ব্যবসায়ীরা আজও জনগণের স্বাস্থ্যকে বিনিময়ে রেখে বেশি মুনাফা আদায়ের চেষ্টা চালায়।
বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা আইন-২০১৩ প্রণীত হয়েছে এবং বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) কাজ করছে- কিন্তু বাস্তবায়নে তা দুর্বল। নমুনা সংগ্রহ, বাজারে অভিযান, অনৈতিক উৎপাদন বন্ধ- এসব কার্যক্রম থাকলেও তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাময়িক। অভিযানের দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই ব্যবসায়ীরা পুরোনো কৌশলে ফিরে যায়। অন্যদিকে ভোক্তাদের সচেতনতা সৃষ্টিতে কার্যকর কর্মস‚চির অভাব আছে। ফলে ভেজাল উৎপাদনে জড়িত অশুভ চক্র এখনো দমন করা যাচ্ছে না। 
সমস্যার এক বড় দিক হলো ট্রেসেবিলিটি ও লেবেলিংয়ের অভাব। খাদ্যের উৎস, প্রক্রিয়াকরণ ও বিতরণ সম্পর্কে স্বচ্ছ তথ্য না থাকায় ভোক্তা সচেতন হওয়া তো দ‚রের কথা, নিয়ন্ত্রক সংস্থাও মেকানিজম ঠিক রাখতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত মনিটরিং সিস্টেম, ল্যাব সুবিধা ও মানবসম্পদ জরুরি।
অনিরাপদ খাদ্যের মুষ্টিমেয় কিছু কারণ হলো- জৈবিক দ‚ষণ, অস্বাস্থ্যকর প্রক্রিয়াকরণ, বিষাক্ত রাসায়নিকের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বাজারজাত করা। জনগণ অনেক সময় ভেজাল চিহ্নিত করতে পারে না; অনেকেই মনে করে শুধু দামের ভিত্তিতে খাওয়া উপযোগী কি না। ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে, রোগব্যাধি ছড়ায়, এবং সামগ্রিক জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ে। কিন্তু ভেজালের বিরুদ্ধে লড়াই শুধু বাজার পরিবীক্ষণেই সীমাবদ্ধ নয়- এটি সামাজিক ও নৈতিক আন্দোলনের কাজও। ব্যবসায়িক জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে, গ্রাহক অধিকার শক্তিশালী করা হবে এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টায় খাদ্য ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ফেরাতে হবে।
বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা সংকট মোকাবিলায় একক উদ্যোগ যথেষ্ট নয়; একটি সমন্বিত, বহুমুখী নীতি ও কার্যক্রম গ্রহণ অপরিহার্য। প্রথমত, বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষকে শক্তিশালী করা অত্যন্ত জরুরি। এর জন্য আর্থিক, প্রযুক্তিগত ও মানবসম্পদ বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা নিয়মিত এবং আকস্মিক বাজার পরিদর্শন ও অভিযান চালাতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সমন্বয় বাড়িয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের কার্যক্রম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত, ট্রেসেবিলিটি এবং লেবেলিং বাধ্যতাম‚লক করতে হবে। প্রতিটি খাদ্য পণ্যের উৎপত্তি, প্রক্রিয়াকরণ এবং বিতরণ সম্পর্কিত তথ্য স্পষ্টভাবে লেবেলে থাকতে হবে। এতে ভোক্তা সহজেই খাবারের গুণগত মান যাচাই করতে পারবে এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাও নির্ভুল তথ্যের মাধ্যমে তদারকি করতে পারবে।
তৃতীয়ত, ভোক্তা সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপ‚র্ণ। টেলিভিশন, রেডিও এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জনজাগরণী কার্যক্রম চালিয়ে মানুষকে শেখাতে হবে কীভাবে ভেজাল চিহ্নিত করতে হয়, নিরাপদভাবে খাদ্য সংরক্ষণ ও প্রস্তুত করতে হয়। ভোক্তা যত বেশি সচেতন হবে, অসাধু ব্যবসায়ীদের কার্যক্রম ততই সীমিত হবে।
চতুর্থত, স্থানীয় পর্যায়ে নজরদারি এবং ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। পৌরসভা, ইউনিয়ন এবং গ্রামভিত্তিক কমিটি গঠন করে স্থানীয় জনগণকে খাদ্য নিরাপত্তায় সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। এতে স্থানীয় পর্যায়ে নিয়মিত তদারকি ও সতর্কতা বৃদ্ধি পাবে এবং সমস্যার দ্রæত সমাধান সম্ভব হবে।
পঞ্চমত, বাণিজ্যিক জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। ব্যবসায়ীদের করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে এবং ভেজাল পণ্য উৎপাদনে কঠোর শাস্তি, জরিমানা ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ব্যবসায়ীরা তাদের মুনাফার চেয়ে জনস্বাস্থ্যের দিকে বেশি মনোযোগ দেবে, এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ষষ্ঠত, সামাজিক নিরাপত্তা নীতি ও ভর্তুকি বাড়াতে হবে। বিশেষ করে দরিদ্র, অসহায় ও দুর্গম এলাকার জনগোষ্ঠীর জন্য পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করতে স্কুল মিল প্রোগ্রাম, স্থানীয় কৃষি সহায়তা এবং সরাসরি ভর্তুকির ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এতে ন্যায্যভাবে খাদ্য পৌঁছানো সম্ভব হবে এবং ক্ষুধা ও পুষ্টিহীনতার প্রভাব কমানো যাবে। শেষে, ল্যাব ও গুণগত মান নিরীক্ষা বিস্তৃত করতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে পোর্টেবল ল্যাব কিট ও স্থানীয় ল্যাব স্থাপন করে নিয়মিত পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো উচিত। এতে খাদ্যের মান বজায় থাকবে এবং ভেজাল বা নিম্নমানের পণ্য সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব হবে।
এসব পদক্ষেপ একত্রে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, জনগণের স্বাস্থ্য রক্ষা পাবে এবং দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। খাদ্য নিরাপত্তা শুধু সরকার বা সংস্থার কাজ নয়; এটি জাতীয় দায়িত্ব, যেখানে সুশীল সমাজ, ব্যবসায়ী ও নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য।
খাদ্য নিরাপত্তা কেবল একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নয়- এটি জাতীয়, সামাজিক ও নৈতিক সমস্যা। যখন খাদ্যই রোগের উৎস হয়ে ওঠে, তখন দেশের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। সরকারকে শুধু আইনি কাগজ বানিয়ে নিয়ে বসে থাকার বদলে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে; সুশীল সমাজকে জবাবদিহি দাবি করতে হবে এবং নাগরিকদেরও সচেতন ও ক্ষমতায়িত হতে হবে। ব্যবসায়িক সংস্থাগুলোকে তাদের মুনাফার চেয়ে জনগণের স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিতে বাধ্য করতে হবে।
আজও বাংলাদেশের অনেক মানুষ পুষ্টিকর খাদ্য থেকে বঞ্চিত। একপাশে রয়েছে পুষ্টিহীনতা ও অভাব, অন্যপাশে ভেজাল ও অনিরাপদ খাদ্যের মহাসংঘরাজ। যদি আমরা এখনই স্থির ও দ‚রদর্শী পদক্ষেপ না নিই, আগামী প্রজন্মের স্বাস্থ্য ও কর্মশক্তি বিপন্ন হবে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব-সরকার, বেসরকারি ক্ষেত্র, সুশীল সমাজ ও প্রতিটি নাগরিকের। যখন নাগরিকরা সুস্থ থাকবে, তখনই জাতি সত্যিকারের উন্নয়নের পথ হাঁটবে। তাই খাদ্য নিরাপত্তাকে নৈতিক ও রাজনৈতিক অগ্রাধিকার হিসেবে গ্রহণ করা জরুরি।
লেখক: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়












http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
মুলার আগাম ফলনেও হাসি নেই কৃষকের মুখে
নভেম্বরে নতুন পোশাক পাচ্ছে পুলিশ
নির্বাচন ঘিরে ‘সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি’ মোকাবিলায় প্রস্তুতির নির্দেশ
২৬৬৪ ইয়াবাসহ আটক যুবদল নেতা রহিম
ব্রাহ্মণপাড়ায় মাদকের ১৯ মামলার আসামী সবুজসহ গ্রেপ্তার ৫
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
অভিযানের পরদিনই দালালের খপ্পরে প্রাণ গেলো প্রসূতির
ডেঙ্গু কেড়ে নিল আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন ত্বকীকে
২৫০ আসনে গ্রিন সিগন্যাল দিতে যাচ্ছে বিএনপি, রয়েছে কঠোর বার্তাও
চান্দিনায় ক্রেতা ও বন্ধকির ৪ কোটি টাকার স্বর্ণ নিয়ে উধাও ব্যবসায়ী
লাল শাকে রঙিন গোমতীর চর
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২