
ক্যান্সার
চিকিৎসার জন্য অত্যাবশ্যকীয় রেডিওথেরাপি মেশিন গোটা দেশেই অপ্রতুল
ক্যান্সার রোগীদের অন্ততঃ ৮০ শতাংশ রোগীর জন্য রেডিওথেরাপির প্রয়োজন হয়।
রোগীর সংখ্যা অনুপাতে দেশে কমপক্ষে ১৭০ টি রেডিওথেরাপি মেশিনের প্রয়োজন।
কিন্তু সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে আছে সর্বমোট ৩৫ টি। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজসহ
অনেক বড় বড় মেডিকেল কলেজে রেডিওথেরাপি মেশিন নাই। এদিকে যেসব সরকারি
হাসপাতালেও মেশিন আছে সেখানে সচল নাই। এমনকি বর্তমানে দেশে ক্যান্সার রোগীর
সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান সরকারি ও বেসরকারী কোন পর্য্যায়েই নাই।
কয়েকটি
বড় বড় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কর্পোরেট হাসপাতাল ব্যতীত অনেক বড় বড়
সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এ চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় দেশের প্রান্তিক
মানুষের চিকিৎসার জন্য এটি একটি উপেক্ষা। চিকিৎসার অভাবে ঐসব অঞ্চলের মানুষ
হয় ঢাকায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন নতুবা ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতালের ফাঁদে
পড়ছেন। বেসরকারি হাসপাতালের আধুনিক লিনাক রেডিওথেরাপি মেশিন থাকলেও এর
চিকিৎসা ব্যয় সরকারি হাসপাতালের প্রায় ১০ গুণ বেশি। যা সাধারণত মানুষের
আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নহে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ আকাশ ছোঁয়া ব্যয়ের
কারণেই প্রায় ৮০ শতাংশ রোগী মাঝপথে চিকিৎসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক
ক্যান্সার যদি সঠিকভাবে চিকিৎসা দেয়া হয় তবে আরোগ্য লাভ করে। কিছুটা শান্তি
উপভোগ করতে পারেন। কিন্তু বেসরকারি পর্যায়ে ঢাকা ছাড়া অন্যান্য শহরে
দুঃষ্প্রাপ্য হওয়াতে আবার সরকারি পর্যায়ে থাকলেও নি¤œমানের পুরানো মেশিনের
রেডিওথেরাপি নেয়ার কারণে ক্যান্সার সত্যিই দুরারোগ্য ব্যাধিতে রূপান্তরিত
হয়ে সাধারণ জনগণের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার যদিও ৮ টি বিভাগে
১০০ শয্যাবিশিষ্ট ক্যান্সার ইউনিটের নির্মানে একটি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে
নিয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে শয্যা সংখ্যা বাড়িয়ে ১৮০ করার পরিকল্পনা সরকারের
রয়েছে, তবে এর বাস্তবায়নের গতি অত্যন্ত কম। জানা যায়, ২০২১ সালে শুরু হওয়া এ
প্রকল্পের মেয়াদ ইতিমধ্যে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, তবে
তার অগ্রগতি হতাশাব্যঞ্জক।
চিকিৎসার জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা, দীর্ঘ
সিরিয়াল, মাঝপথে চিকিৎসা ছেড়ে দেয়া বা দিতে বাধ্য হওয়া Ñএসবই যেন এখন
ক্যান্সার রোগীদের নিয়তি। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনষ্টিটিউট ও হাসপাতালের
মত কেন্দ্রিয় প্রতিষ্ঠানেও দেখা গিয়েছে, প্রতিদিন ২০০ রোগী রেডিওথেরাপির
জন্য আসলেও পুরোনো মেশিন অকেজো থাকায় এবং নতুন মেশিনের অপ্রতুলতায় সঠিক
চিকিৎসা মেলে না। এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসকরা ও অসহায়ত্ব বোধ করেন। এ চিত্র
শুধু ক্যান্সার হাসপাতালেরই নয়, সরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকা দেশের সব
হাসপাতালেরই।
সরকারের উচিত যত দ্রæত সম্ভব হাসপাতালগুলোর রেডিওথেরাপি
চিকিৎসায় সকল অচল মেশিনগুলো সচল করার পাশাপাশি সকল সরকারি মেডিকেল কলেজ
হাসপাতালগুলোয় প্রয়োজনীয় সংখ্যক আধুনিক লিনাক মেশিন স্থাপন করা। শুধু তাই
নয়, এসব মেশিন সচল ও সুষ্ঠুভাবে কাজ করছে কিনা তা সুপারভিশনে একটি সঠিক
মানবসম্পদ নিয়ে একটি কার্যকর ওয়ার্কশপ স্থাপন করা। মেডিকেল ফিজিসিষ্ট ও
রেডিওথেরাপিষ্ট, রেডিওথেরাপি টেকনোলজিষ্টের পর্যাপ্ত পদ সৃষ্টি করা। ভুললে
চলবেনা, ক্যান্সার চিকিৎসাকে সাধারণ মানুষের লাগালের মধ্যে আনা সরকারের
সাংবিধানিক দায়িত্ব। জীবন রক্ষাকারি এ চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে যেন আর কোন
রোগীকে মাসের পর মাস সিরিয়ালের জন্য ঘুরতে না হয়, তা নিশ্চিত করা জাতীয়
জরুরী দায়িত্বসমূহের মধ্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজটি
১৯৯২ সনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই রেডিওথেরাপি চালু করতে চিকিৎসকগণ ও
জনসাধারণ একাট্টা। ২০১৩ ও ২০১৪ সনে রেডিওথেরাপি, আইসিইউ, সিসিইউ প্রকল্প
প্রস্তাবনা কলেজ তরফ থেকে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। ২০১৯ এ আইসিইউ কোভিড
আসার কারণে বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু রেডিওথেরাপির ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেয়া
হয় নাই। শুধুমাত্র অনকলজি ডিপার্টমেন্ট খোলা হয়েছে যাতে শুধু কেমথেরাপির
ব্যবস্থা আছে। লক্ষীপুর থেকে হবিগঞ্জ পর্যন্ত বিশাল জনপদের চিকিৎসার
ভরসাস্থল হচ্ছে কুমিল্লা নগর। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৫ টি মেডিকেল কলেজ এ
নগরটিতে অবস্থিত। কিন্তু কোন রেডিওথেরাপি মেশিন নাই।
অনেকদিনের দাবী
কুমিল্লা নামে কুমিল্লা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করায় সকল রাজনীতিবিদ ও আমজনতা
ঐক্যবদ্ধ। দেশের ভৌগোলিক কারণেও তার বাস্তবতা অনেক। পৃথিবীর প্রায় শহরেই
যেখানে কুমিল্লাবাসী আছেন তারা কুমিল্লা বিভাগের দাবীতে তৎপর। তেমনি আজকে
চিকিৎসা নিতে আসা সকল আশপাশের রোগীরাও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে রেডিওথেরাপি
মেশিনসহ রেডিওথেরাপি বিভাগ চালু করার দাবীতে একমত। কুমিল্লা জেলা পরিষদের
প্রায় ১০০ কোটি টাকার উপরে অলস পড়ে রয়েছে যার ৬০ কোটি টাকা খরচ করেই
সম্পূর্ণ রেডিওথেরাপি ডিপার্টমেন্ট চালু করা যায়। ক্যান্সার চিকিৎসায়
রোগীদের দুর্ভোগ লাঘবে শুভানুধ্যায়ী ও সরকার দ্রæত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ
করবে-এটাই সকলের প্রত্যাশা।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ
