ইলিশ আমাদের জাতীয় সম্পদ। কার্যকর উদ্যোগের অভাবে আমরা দিন দিন আমাদের এ ঐতিহ্যবাহী সম্পদ হারাতে বসেছি। ইলিশের ভরা মৌসুমেও ক্রেতারা অসহায় ইলিশের দামের কাছে। এমনকি ইলিশের বাড়ি বরিশালেও দেখা মিলছে না ইলিশের। দিনরাত নদীতে জাল ফেলে ইলিশ না পেয়ে হতাশ হয়ে ঘাটে ফিরছেন জেলেরা। যা পাওয়া যাচ্ছে, দাম নাগালের বাইরে। ইলিশের আরেক শহর চাঁদপুরেও লাগামহীন দাম। এই দুই জেলার মোকামে আড়াই হাজার টাকার বেশি দরে ইলিশের কেজি বিক্রি হচ্ছে। সেই ইলিশের কেজি রাজধানীতে ৩ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে, দাম ততই বাড়ছে। ইলিশের চড়া দামের জন্য খুচরা বিক্রেতারা দুষছেন আড়তদারদের।
আবার অনেকে বলছেন, বৈরী আবহাওয়ার কারণে ইলিশের আহরণ কমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈরী আবহাওয়া, নদীদূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, নদ-নদীতে ডুবোচর, নদীর মোহনায় নাব্যসংকট ও অবকাঠামো নির্মাণ এবং অবৈধ জাল দিয়ে নির্বিচারে মাছ শিকারের মতো বিষয়গুলো নদ-নদীতে ইলিশ প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। পাশাপাশি পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রসহ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বর্জ্য ও দূষণ নদীর পানির গুণমানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, যা ইলিশের আবাস ও চলাচলের পথকে বাধাগ্রস্ত করছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ইলিশ আহরণ হয় ৫ লাখ ৭১ হাজার টন। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে আহরণ হয়েছিল ৩ লাখ ৭২ হাজার ৩৪৩ টন। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৮৩৪ টন ইলিশ আহরণ হয়েছে। সে হিসাবে গত এক বছরে বরিশাল বিভাগে ইলিশ আহরণ হয়েছে ২৫ হাজার ৫০৯ টন। বরিশাল মৎস্য আড়তদারদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, একসময় এখানে বাজারে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ মণ ইলিশ আসত। সেখানে বর্তমানে ৮ থেকে ১০ মণ ইলিশ আসছে। সরবরাহ কম থাকায় দাম চড়া। বর্তমানে ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৭০ হাজার টাকা বা কেজি ১ হাজার ৭৫০ টাকা। ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম সাইজের ইলিশের দাম ১ লাখ টাকা বা কেজি ২ হাজার ৫০০ টাকা। ১ কেজির ওপরের ইলিশ ১ লাখ ৮ হাজার থেকে ১ লাখ ১২ হাজার বা ২ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের সহকারী ও ইকোফিশ প্রকল্পের সাবেক গবেষক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, দেশে আহরিত মোট ইলিশের ৬৬ শতাংশ আসে বরিশাল অঞ্চল থেকে। কিন্তু গত অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে দেশে ৪২ হাজার টন কম ইলিশ উৎপাদন হয়েছে। নদীর মোহনায় অসংখ্য ডুবোচর রয়েছে। স্রোত নেই। দূষণ বেড়েছে। সব মিলিয়ে নদীগুলো ইলিশের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
ভরা মৌসুমেও ইলিশের দাম চড়া, এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণ এবং মানবসৃষ্ট কারণেও ইলিশের প্রজননে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। উৎপাদন বাড়াতে হলে ইলিশের উপযোগী পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতীয় সম্পদ ইলিশ রক্ষায় এবং নদীর পানির গুণগত মান ঠিক রেখে ইলিশের আবাস ও চলাচলের পথকে মসৃণ করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।