দেশে কতিপয় দুর্বৃত্তের হিংস্রতা ও নিষ্ঠুরতা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। মিটফোর্ড এলাকায় ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যা তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। পাথরে থেঁতলে দিয়েই ক্ষ্যান্ত হয়নি পাষণ্ডরা, তারা সোহাগের লাশের ওপর নৃত্যও করেছে। সিসিটিভিতে দেখা যাচ্ছে, আশপাশের মানুষ এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেও কেউ সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি। একশ্রেণির মানুষের হিংস্রতা, বর্বরতা যেন সব সীমারেখার বাইরে চলে গেছে। তুচ্ছ কারণে কিংবা পুরোনো বিরোধের জেরে ঘটানো হচ্ছে নৃশংস হত্যাকাণ্ড।
লালচাঁদ ওরফে সোহাগকে বীভৎসভাবে হত্যার ঘটনা সারা দেশে ক্ষোভ, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা চরমভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা কোথায় গিয়ে ঠেকবে! এখন প্রশ্ন উঠেছে- হঠাৎ করে মানুষের মধ্যে বর্বরতা, হিংস্রতা এত বাড়ল কেন? যেখানে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে মাঠে রয়েছে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। তার পরও অপরাধীরা কেন এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে? এ ঘটনায় সারা দেশে মানুষ বিক্ষুব্ধ। যদিও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় সারা দেশে চিরুনি অভিযানের ঘোষণা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
সশস্ত্রবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা আরও দুই মাস বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার।
পুরান ঢাকায় সোহাগ হত্যাকাণ্ড ছাড়াও চাঁদপুরে খুতবা অপছন্দ হওয়ায় মসজিদের ভেতরে ইমামকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টা, খুলনায় যুবদলের সাবেক নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লাকে গুলি করে ও রগ কেটে হত্যা, চট্টগ্রাম নগরীতে ফাতেমা বেগম নামে এক নারীকে ১১ টুকরা করে হত্যা, গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে চুরির অপবাদে হৃদয় নামে এক শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যাসহ বেশ কিছু বর্বরতার ঘটনায় উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষ। সোহাগ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপির যুবসংগঠন যুবদলের স্থানীয় নেতা-কর্মী জড়িত বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, যা খুবই উদ্বেগের বিষয়। ঘটনাটি বিএনপির জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে। দলটির নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সুধী সমাজের অনেকে বলছেন, তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত লাগাম টেনে ধরতে না পারলে বিএনপির ভাবমূর্তি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে এমনটি ধরে ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে, যা বিএনপির জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর। দলটির হাইকমান্ডও বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য মতে, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে সারা দেশে রাজনৈতিক কারণে খুন হন ৬৫ জন। মব ভায়োলেন্সের শিকার হন ৮৯ জন এবং বিভিন্ন কারণে ২২০ জন শিশু খুন হয়। এর বাইরেও বিভিন্ন কারণে আরও কিছু খুনের ঘটনা রয়েছে বলে জানিয়েছে আসক। অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার দুর্বলতা ও ঢিলেঢালা আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার কারণে এ-জাতীয় ভয়ানক অপরাধ মাথাচাড়া দিচ্ছে। পরিস্থিতির উত্তরণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপের কথা বলছেন তারা। তবে শুধু রাষ্ট্র বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এককভাবে দায়ী করা যাবে না। প্রথমত, এর সঙ্গে পারিবারিক দায়বদ্ধতা জড়িয়ে রয়েছে।
পরিবার থেকে সুশিক্ষা ও শৃঙ্খলাবোধের শুরু। দ্বিতীয়ত, সামাজিক দায়বদ্ধতা বা ভূমিকার মধ্যে শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সুশিক্ষা দান করা এবং সমাজের বিশিষ্টজনদের সচেতনতা বাড়ানোর বিষয় থাকে। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। নৃশংসতা বা বিকৃত আচরণের নেপথ্যে পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনকে দায়ী করছেন সামাজিক অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। দেশে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ও বীভৎসতা ঠেকাতে হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপের বিকল্প নেই। সর্বোপরি, অপরাধীদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাও জরুরি। এ ক্ষেত্রে সরকার শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে। পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের চর্চা বাড়াতে হবে, যাতে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।