দেশের ৯টি সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। এবার যারা এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে তাদের উষ্ণ অভিনন্দন।
দেশের ৯টি বোর্ড থেকে এবার পরীক্ষা দেয় ১৪ লাখ ৭৯ হাজার ৩১০ জন। পাস করেছে ১০ লাখ ৬ হাজার ৫৫৪ জন। পাসের হার ৬৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, যা গতবার ছিল ৮৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। গত বছরের তুলনায় পাসের হার ১৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ কম। জিপিএ-৫ কমেছে ৩৮ হাজার ৮২৭। সমমানের পরীক্ষার ফলও বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়েছে।
ফলাফলে দেখা যায়, এবার গড় পাসের হার এবং ফলাফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫, দুই-ই কমেছে। সেই সঙ্গে সব পরীক্ষার্থী ফেল করেছে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বেড়েছে। এবার ১৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন পরীক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি। গতবারের চেয়ে এবার এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে ৮৩টি। কমেছে শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও। সব মিলিয়ে অকৃতকার্যদের সংখ্যা ৬ লাখের সামান্য বেশি। সেই হিসাবে মোট শিক্ষার্থীর ৩২ শতাংশ এবার অকৃতকার্য হয়েছে, প্রতি ১০০ জনে ফেলের সংখ্যা ৩২ জন।
কেন এবার এ রকম ফলাফল হলো, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, মূলত চারটি কারণে এবার পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমেছে। সেই কারণগুলো হলো খাতার যথাযথ মূল্যায়ন, কেন্দ্র ব্যবস্থাপনায় কড়াকড়ি, ইংরেজি-গণিতে পাস করতে না পারা, করোনা ও জুলাই আন্দোলনের প্রভাব। যথাযথভাবে খাতার মূল্যায়নের বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ঢিলেঢালা মূল্যায়ন শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাইয়ের সঠিক পদ্ধতি নয়। পৃথিবীর কোনো দেশেই এটা করা হয় না। এতে সাময়িকভাবে উল্লসিত হওয়া গেলেও শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষা অর্জন ঘটে না। বিগত কয়েক বছর ধরে প্রচলিত এই ধারা থেকে এই প্রথম শিক্ষা বোর্ডগুলো বেরিয়ে এল। ভবিষ্যতেও এই ধারা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।
এবারের ফলাফলের দুটি দিক লক্ষণীয়। একটি দিক যথাযথ ফলাফলের, অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা যেমন পরীক্ষা দিয়েছে, ঠিক তেমনই ফলাফল করেছে। আরেকটা দিক হচ্ছে, বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ফেল করেছে। যারা উত্তীর্ণ হয়েছে তারা শিক্ষাধারার পরবর্তী ধাপে চলে যাবে। কিন্তু আমাদের এখন নজর দিতে হবে ফেল করা শিক্ষার্থীদের দিকে। আর ভাবতে হবে ভবিষ্যতের কথা। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের যদি আমরা শিক্ষাধারায় ধরে রাখতে না পারি, তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। ফেল করা শিক্ষার্থীদের এই ধারায় ধরে রাখাটাই হবে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ। যে ফল হওয়ার কথা তাই হয়েছে বলে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। সরকারসহ পুরো শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের এই চ্যালেঞ্জটা নিতে হবে।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর অকৃতকার্য হওয়াটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থারই ত্রুটি। জাতিগতভাবে আমরা তাদের উত্তীর্ণ হওয়ার পর্যায়ে উন্নীত করতে পারিনি। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে, যার লোকসংখ্যা এই অকৃতকার্য ৬ লাখ শিক্ষার্থীর চেয়েও কম। এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর ফেল করাটা আসলে আমাদের অর্থনীতি ও মানবসম্পদের বড় অপচয়। এতে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক সংকটে বিপন্ন হয়ে পড়ার শঙ্কাও থাকে। অতীতে অকৃতকার্য হওয়ার কারণে অনেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এসব আমরা যেন ভুলে না যাই। তবে এই ফলাফল ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা হয়ে থাকবে। সেই শিক্ষাটা হচ্ছে ঠিকমতো পড়াশোনা না করে কোনো শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় পাস করার সুযোগ নেই।
এর অবশ্য আরেকটি আশঙ্কার দিক রয়েছে। সেটা হলো, পড়াশোনার বিষয়টি শিক্ষার্থীদের কাছে ‘চাপ’ হয়ে দেখা দিতে পারে। কোচিং, টিউটর, গাইড বইয়ের রমরমা ব্যবসাও স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে। আসলে আমাদের পাবলিক পরীক্ষাব্যবস্থারই বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। পুরো পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত না করে, অর্থাৎ বোর্ডের ওপর ছেড়ে না দিয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও বিদ্যালয়গুলোকে সম্পৃক্ত করা দরকার। এটা নিঃসন্দেহে শিক্ষানীতির বিষয়। এতে অনেকে দুর্নীতির সুযোগ ঘটতে পারে বলে মনে করতে পারেন। কিন্তু আমাদের এখন এমন এক সৎ শিক্ষকমণ্ডলী গড়ে তোলার দিকে নজর দিতে হবে, যারা সততার সঙ্গে শিক্ষাদান করবেন। তবে এক-দুই বছরে সেটা ঘটবে না। নীতি-নৈতিকতানির্ভর সমাজ হলেই আমরা নীতিবান শিক্ষক পাব। দেশের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি নির্মূল হলেই এটা সম্ভব।
দুর্নীতি নির্মূলে বৃহৎ পরিসরে সরকারকে কাজ করতে হবে।
শিক্ষকদের বেতনসহ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। নিয়োগ দিতে হবে সেসব শিক্ষকদের, যারা শিক্ষকতাকে মহান পেশা মনে করে নীতি-নৈতিকতার মানদণ্ড রক্ষা করে শিক্ষকতা করবেন। তবে আপাতত যা করণীয় তা হচ্ছে, কীভাবে কৃতকার্য শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যায়, সেদিকে নজর দেওয়া। এ জন্য নতুন করে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে সেই কাজটি সমগ্র জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা সম্পন্ন করাই হবে যথাযথ পদ্ধতি। এটা করতে গিয়ে কোনো বিতর্কে জড়ানো যাবে না। মনে রাখা জরুরি, এবারের ফলাফলের প্রেক্ষাপটে আমাদের মাধ্যমিক ও সমমানের শিক্ষা নতুন একটা পর্বে প্রবেশ করেছে। এই শিক্ষাস্তর নিয়ে নতুন ব্যবস্থাপনা এবং উদ্যোগও তাই সময়ের দাবি।