গণতন্ত্রের সপক্ষে বক্তব্য রেখে
আমার লেখকজীবন শুরু হয়েছিল। শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, তারই
পুনরুচ্চারণ আবশ্যক, যদিও সময়ের গতিকে মান্যতা দিয়ে পুরনো কথা নতুনভাবে
সাজাতে হয়। গণতন্ত্রের অর্থ নিয়ে বিতর্ক আছে। সেই তর্কে বেশি দূর প্রবেশ
করব না। তবে দু-একটি মূল কথা সংক্ষেপে বলে নেওয়া দরকার।
সমাজে নানা
মানুষের নানা রুচি, নানা মুনির মত। এইসব মতের এবং বিশ্বাসের কিছু হয়তো
ভ্রান্ত। তবে অধিকাংশ মতই আংশিকভাবে সত্য, যদিও তারা প্রায়ই পরস্পরবিরোধী।
আমরা কেউই সম্পূর্ণ সত্যের অধিকারী নই। এখানেই গণতন্ত্রের মূল কথাটা এসে
যায়। কোনও একটি দল অথবা বিশেষ নেতা শুদ্ধ সত্যটি জানেন, সেই সত্য সকলের ওপর
চাপিয়ে দেবার অধিকার আছে সেই অদ্বিতীয় দলের অথবা নেতার, এই একতন্ত্রী
বিশ্বাসের বিপক্ষে গণতন্ত্রের দৃঢ় অবস্থান। বিভিন্ন মতের যথাসম্ভব
শান্তিপূর্ণ দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়েই মানুষের সমাজ অগ্রসর হোক, বৃহত্তর
সত্যের পথে ক্রমে এগিয়ে যাবার এটাই সঠিক উপায়, একথা যাঁরা মানেন, তাঁরাই
গনতন্ত্রের যথার্থ সমর্থক। বিবেকের স্বাধীনতা মূল কথা; সেই সঙ্গে চাই
নিজেকে প্রকাশ করবার সুযোগ; এবং আত্মপ্রকাশের সুযোগের সহায় রূপে চাই সহনীয়
সাম্য। গণতন্ত্র একই সঙ্গে সহযোগে ও দ্বন্দ্বে বিশ্বাসী। সহযোগে বিশ্বাসী,
কারণ কিছুটা সহযোগ ছাড়া কোনও সমাজই দাঁড়াতে পারে না। আবার শান্তিপূর্ণ
দ্বন্দ্বে বিশ্বাসী, কারণ আমরা প্রত্যেকেই নানা আকারে প্রকারে সত্যের
অংশমাত্র জানি, আর এইসব আংশিক সত্যের ভিতর সাময়িক দ্বন্দ্ব অনিবার্যভাবে
উপস্থিত। এই মূল বিশ্বাস রক্ষা করেও অবস্থাবিশেষে গণতন্ত্রের রূপের
পরিবর্তন ঘটান সম্ভব। এমনকী কাম্যও বটে। কিন্তু যেখানে ওই প্রাথমিক প্রত্যয়
অস্বীকৃত, সেখানে গণতন্ত্রই অস্বীকৃত।
রুটিরুজি ছাড়া জীবনধারণ সম্ভব
নয়। সেটা নিশ্চয়ই আবশ্যক। তবে গণতন্ত্রের জন্য তার বেশি কিছু চাই। হিটলারের
রাজত্বে রুটিরুজির ব্যবস্থা ছিল। কথাটা অন্যভাবে বলা যাক। একদিকে আছে
সহিষ্ণু বহুত্ববাদে আশ্রিত সমাজ ও সংস্কৃতি, অন্যদিকে কট্টর প্রভুত্ববাদ।
এই প্রভুত্ববাদকে গণতন্ত্র বলে চালাবার চেষ্টাতেই চলে গণতান্ত্রিক আদর্শের
প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা। যদি কোনও রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়-হিন্দু,
মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি, যাই হোক না কেন-উগ্র মৌলবাদের পন্থাকে সমর্থন
জানায়, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও সেই সংঘবদ্ধ অসহিষ্ণুতাকে গণতন্ত্র বলে
স্বীকার করা যাবে না।
গণতন্ত্রের সঙ্গে সুনীতি বিচারের সম্পর্ক আছে।
সেই সঙ্গে এসে পড়ে ধর্মের প্রসঙ্গ। এখানেও দ্বান্দ্বিক বিচারের আবশ্যকতা
আছে। হিন্দুদের প্রাচীন ধ্যানধারণায় ধর্ম ও মোক্ষের কথা পৃথকভাবে বলা
হয়েছে। এই দুইয়ের ভিতর যোগ আছে, তবু এরা অভিন্ন নয়। মোক্ষানুভূতি ঘটে একক
মানুষের চিদাকাশে। ধর্মের যোগ আছে সমাজসংগঠন ও সামাজিক বিধানের সঙ্গে,
নীতিবিচার যেখানে প্রধান কথা। সত্যাসত্য নিয়ে যেমন তর্কের শেষ নেই, ধর্ম ও
সুনীতি বিষয়েও তেমনই জিজ্ঞাসু মানুষের ভিতর বহু প্রশ্ন অমীমাংসিত আছে।
ভগবদ্গীতাকে আমরা পাই মহাকাব্যের অংশরূপে, তবু মহাভারতের রচয়িতা ভালভাবেই
জানতেন যে, ধর্মের তত্ত্ব সূক্ষ্ম ও জটিল। ধর্মজিজ্ঞাসার কোনও সরল উত্তর
নেই। মহাপুরুষদের পথের কথা বলা হয়েছে বটে, কিন্তু মহাজনেরাও কি সবাই একই
পথে চলেছেন? যিশু ও হজরত মোহাম্মদ কি সর্বাংশে পরস্পরের প্রতিচ্ছবি মাত্র?
সুনীতিবিচারে জটিলতার নানা কারণ থাকে, যেটি সহজবোধ্য, সেটির কথাই এখানে বলা
যাক। নীতিবিচারের বিকাশ ঘটেছে সমাজজীবনের নানা বৃত্তে ও স্তরে, বিভিন্ন
পরিবেশে। পরিবেশের বিভিন্নতার কারণে নীতিবোধেও বিভেদ দেখা যায়। মানবপ্রকৃতি
ও সংস্কৃতিতে অনিবার্য বৈচিত্র্য উপেক্ষা করা যায় না। এই বৈচিত্র্যের ভিতর
সামঞ্জস্যস্থাপনের চেষ্টা চলে। তবু সেটা সহজসাধ্য নয়। এ বিষয়ে সচেতনা
আবশ্যক। কিছু নিবিষ্ট বিচার-বিশ্লেষণ এই সচেতনতা গঠনে ও সহিষ্ণুতা বর্ধনে
সহায়ক হতে পারে। গণতন্ত্রের নতুন দিগন্তের ভিতর এদের জন্য স্থান চাই।
যে-সব
মূল্যবোধ ও নৈতিক বিধান সমাজকে ধরে রেখেছে, তাদের দুটি প্রধান বর্গে ভাগ
করা যায়। এক গুণাবলি গড়ে উঠেছে অতি প্রাচীনকাল থেকে পারিবারিক আধারে।
এইভাবে পালিত হয়েছে কনিষ্ঠদের প্রতি স্নেহ, সমবয়স্কদের ভিতর ভ্রাতৃত্ববোধ,
জ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা, সকল স্বজনের ভিতর পারস্পরিক সহজ সহানুভূতি
বন্ধন। যৌথ পরিবার যখন আরও বিস্তৃত রূপ পেয়েছে বৃহত্তর জাতিতে, তখন সেখানেও
স্থাপিত হয়েছে পারিবারিক নৈতিক বিধানের এক পরিবর্ধিত প্রতিমা, দেশমাতৃকার
ধারণায় আছে যার ভক্তিপূর্ণ প্রকাশ। অপেক্ষাকৃত আধুনিক এ যুগে এসেছে সুশীল
সমাজের ধারণা, যাকে আশ্রয় করে মান্যতা পেয়েছে এক ভিন্ন বর্গের মূল্যবোধ।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মূল্যের স্বীকৃতিতে পাই এরই উদাহরণ। তারই সঙ্গে
যুক্ত হয়ে আছে নাগরিক স্বাধীনতার ধারণা, আইনের শাসন এবং নৈর্ব্যক্তিক
ন্যায়বিচারের সেই আদর্শ, যেখানে আত্মীয়ের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব দেখাবার
বিধান নেই। এইভাবে দুই ভিন্ন বর্গের নৈতিকবোধ পাশাপাশি প্রভাব বিস্তার করে
চলেছে। প্রথমটিকে যদি বলি আত্মীয়সাপেক্ষ নীতিবোধ, দ্বিতীয়টিকে বলা যাবে
নিরপেক্ষ বিচারশীলতা। প্রথমটির উন্মেষ ঘটেছে পরিবারে ও পল্লিতে, যদিও এর
প্রভাব সেখানে আবদ্ধ নেই। দ্বিতীয়টির যোগ ব্যবসায়কেন্দ্রিক নাগরিক
সংস্কৃতির সঙ্গে। সমাজজীবনে দুইয়েরই প্রয়োজন আছে নিজ নিজ ক্ষেত্রে। দুটিকেই
রক্ষা করা আবশ্যক, অথচ এদের ভিতর সমন্বয় স্থাপন সহজ নয়। এদেশে আত্মীয়পোষক
নীতিরই প্রাবল্য বেশি। দুই ভিন্ন নীতিবোধের দ্বন্দ্বে প্রায়ই মাত্রা রক্ষা
পায় না, মাত্রা রক্ষা করা খুব সহজও নয়; সৃষ্টি হয় অতি জটিল ও দুঃখজনক
সমস্যা। কিছু উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বুঝে নেওয়া সহজ হবে।
এদেশের জনজীবনে
দুর্নীতি ভয়ংকরভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত কয়েকটি
দেশের ভিতর আজ বাংলাদেশের স্থান অন্যতম। এদেশের আত্মীয়পোষণ প্রবণতার সঙ্গে
এই দুর্নীতিগ্রস্ততার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। আত্মীয়পোষক নীতিরও রূপভেদ আছে। এদেশে
জাতিবিশেষ ও দলবিশেষের প্রতি বিচারহীন পক্ষপাতকে আজকের পরিবেশে যেন
কর্তব্য বলেই ধরা হয়। দুর্নীতির ফলে যদি বিশেষ পরিবার, জনজাতি অথবা
রাজনৈতিক দল লাভবান হয়, তবে গোষ্ঠীগত বিচারে সেই দুর্নীতিতে দোষ নেই, এই
রকমের এক ধারণা অথবা অপসংস্কারের প্রভাবেই ভারতের সমাজ ও রাজনীতি আজ
গভীরভাবে অসুস্থ। ন্যায় বিচারের আদর্শ এখানে পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত।
আত্মীয়তোষক নীতি যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন সারা দেশই তার ফলে দুর্বল হয়ে
পড়ে, ভারতের অভিজ্ঞতায় এই কথাটা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
অথচ একটা
মাত্রার ভিতর পরিবার প্রীতিরও গভীর প্রয়োজন আছে। শিশু মায়ের কাছ থেকে বিশেষ
মনোযোগ দাবি করে, সেই দাবি অস্বীকৃত হলে শিশুর জীবনে সংকট দেখা দেওয়া
অস্বাভাবিক নয়। শৈশব অতিক্রম করবার পরও সন্তান পিতামাতার কাছ থেকে কিছু
অতিরিক্ত স্নেহ-ভালবাসা আকাক্সক্ষা করে থাকে, সেই আকাক্সক্ষাকে একেবারে
উপেক্ষা করলে পরিণাম দুঃখজনক হতে পারে। মোট কথা, সমাজসংগঠনে আত্মীয়তাবোধ ও
পরিবারপ্রীতির স্থান আছে, আবার নিরপেক্ষ বিচারশীলতারও প্রয়োজন স্বীকার্য।
সমাজজীবনে কোনওটিকেই পরিত্যাগ করবার পরামর্শ দেওয়া যায় না। অগ্রাহ্য করা
যায় না এদের ভিতর এক অমীমাংসিত দ্বন্দ্বের রূঢ় বাস্তবতাকেও। সমাজ যেখানে
স্বজনপোষণের দিকে অতিশয় ঝুঁকে আছে, সেখানে ভিন্নধারার কথা বিশেষভাবে তুলে
ধরা যুক্তিসঙ্গত মনে হতে পারে। এক অসমন্বিত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে যাঁরা
যাতনা ভোগ করেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।
যেদুটি
ভিন্ন ধাঁচের সমাজের কথা এখানে বলা হয়েছে-সনাতন পল্লিমুখী আত্মীয়সমাজ এবং এ
যুগে যাকে বলা হয়ে থাকে সুশীল সমাজ-এদের যেমন আদর্শরূপ আছে, তেমনই বিকৃতিও
আছে। ভাবের দিক থেকে এরা পরস্পরকে সমৃদ্ধ করতে পারে, আবার বিপরীত মুখে
গভীর থেকে গভীরতর বিকৃতির দিকে ঠেলে দিতেও পারে। অভাবাত্মক দ্বিতীয়
প্রক্রিয়াটি নিয়েই দুঃশ্চিন্তা। ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থচিন্তার আঘাতে
আত্মীয়তার বন্ধন দুর্বল হয়ে চলেছে। সংকীর্ণ আত্মীয়চিন্তায় ও ছোট ছোট
দলীয়তায় সুশীল সমাজের সুবিচারের আদর্শ ধূলিসাৎ হচ্ছে। অধঃপতনের এই ধারাকে
রোধ করবার মতো সমাজসংগঠন ও নীতিবোধ কি গড়ে তোলা যাবে? নীতিবোধের দুই ধারা
থেকে কি আমরা সেই সব সদর্থক ভাবকে উদ্ধার করতে পারব সুস্থ সমাজের ভিত্তিতে
যাদের স্থান থাকা প্রয়োজন? এসব প্রশ্নের কোনও পূর্বনির্ধারিত উত্তর নেই।
থেকে যায় তবু উদ্যোগ ও অনুসন্ধানের দায়িত্ব।
পৌরসমাজের আদর্শ ও মূল্যবোধ
সমূহকে সনাক্ত করা সহজ। পশ্চিমি জগতে আঠারো শতকের শেষভাগ থেকে তাদের
স্মরণীয় ভাষায় বার বার ঘোষণা করা হয়েছে। মৌল মানবাধিকারের বাণী আর
স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সমন্বয়ের কল্পনা সেখানে প্রধান কথা। যদিও
এদের বুর্জোয়া মূল্যবোধ বলে কখনও চিহ্নিত করা হয়েছে তবু এরা বরণীয় ও
রক্ষণীয়। নাগরিক সভ্যতার প্রতি যাঁরা আকৃষ্ট, তাঁদের শিবিরে তো বটেই, ভিন্ন
চিন্তাধারাতেও এইসব আদর্শকে শ্রদ্ধার স্থান দেওয়া হয়েছে। ‘ভারত ছাড়ো’
আন্দোলনের প্রাক্কালে ১৯৪২ সালে ‘হরিজন’ পত্রিকায় গান্ধী লিখেছিলেন ঃ ঞযব
ঋৎবহপয যধাব ধ হড়নষব সড়ঃঃড় রহ খরনবৎঃু, ঊয়ঁধষরঃু, ঋৎধঃবৎহরঃু. ওঃ রং ধ
যবৎরঃধমব হড়ঃ ভড়ৎ ঃযব ঋৎবহপয ড়হষু নঁঃ ভড়ৎ ধষষ সধহশরহফ.” ভ্রাতৃত্ব বা
মৈত্রীর বাণী প্রাচীন কাল থেকেই ধ্বনিত হয়েছে। তার সঙ্গে সাম্য ও
স্বাধীনতাকে যুক্ত করে যে-আদর্শের কথা ফরাসি দেশের অগ্রণী চিন্তকেরা
বুর্জোয়া বিপ্লবের যুগে ঘোষণা করেছিলেন, তার ব্যাখ্যা নিয়ে তর্ক চলবে, তবু
সেই ঘোষণা সারা বিশ্বেই শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। এ যুগে সমন্বয়ী
চিন্তার এটা এক ঐতিহাসিক ভিত্তিভূমি। মানবিক আদর্শের বিবর্তনে নাগরিক
সভ্যতার শ্রেষ্ঠ অবদান বলে একে মান্য করা চলে। এদেশের এবং প্রতিবেশী সকল
দেশের পৌরসমাজে ক্ষুদ্র দলীয়তার ঊর্ধ্বে মানবাধিকারের সপক্ষে বৃহৎ আন্দোলন
কর্তব্য বলে গৃহীত হওয়া উচিত।
এরই পরিপূরক অন্য এক আন্দোলন এবং গঠনমূলক
কর্মধারা পল্লিসমাজে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। কথাটা ব্যাখ্যা করে বলা যাক।
আধুনিক সমাজে আর্থিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন ব্যাপার। তবু সব মানুষই
যাতে ন্যূনতম মর্যাদার সঙ্গে সমাজে বাস করতে পারে, তার অনুকূল অবস্থা
সৃজনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া আবশ্যক। ভিক্ষাবৃত্তিতে মর্যাদা নেই। কিছু
দিয়ে তার পরিবর্তে কিছু পেলে সমাজে মর্যাদা রক্ষা হয়। প্রত্যেকে
ব্যক্তিকেই বাঁচবার জন্য সমাজের কাছ থেকে কিছু নিতে হয়, অন্ন-সেবা-শিক্ষা
যা কিছু হোক। তার পরিবর্তে সমাজকে কিছু দেওয়ার দায়িত্ব ও সুযোগ সকল সমর্থ
মানুষের জন্য থাকা চাই। সেই সুযোগের অভাব মানবাধিকারের পূর্ণতার পথে বড়
বাধা। শহরে ও গ্রামে কর্সসংস্থানের অভাব আমাদের সমাজে সংকট ডেকে এনেছে। এই
সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে কোন পথে? শিল্পায়নকে অনেকে মুক্তির পথ বলছেন।
শিল্পায়ন প্রয়োজন, কিন্তু এই সাদামাটা কথাটা যথেষ্ট নয়। আরও একটু তলিয়ে
ভাবতে হবে। শিল্পোন্নত দেশগুলিতেও বেকার সমস্যা আছে, এই কথাটুকু বলাও
যথেষ্ট নয়। আরও কিছু কথা আছে।
আমরা আজ শিল্পায়নের পথে চলেছি। আজকের
শিল্পোন্নত দেশগুলি এই পথটা অতিক্রম করেছে আরও শতাধিক কাল আগে। ওদের
অবস্থার সঙ্গে আমাদের পরিস্থিতির কিছু বড় রকমের প্রভেদ আছে। ওরা যখন
শিল্পায়নের প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল, তখন ওদেরও অনিচ্ছাকৃত বেকারত্বের একটা
কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু ওদের সামনে সমস্যা লাঘবের জন্য
অন্য পথ খোলা ছিল, নিজ দেশের সীমানার বাইরে বহু বিস্তৃত উপনিবেশে জীবিকা
অর্জনের সহায়ক পথ। আমাদের পরিস্থিতি ভিন্ন। কিছু কুশলী মানুষকে সীমিত
সংখ্যায় আমরা বিদেশে পাঠাতে পারি, কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের অধিকার ভিন্ন
বস্তু।
আমাদের অগণিত জনতার জন্য জীবিকার সুযোগ চাই দেশের সীমানার ভিতর।
গ্রামের কিছু মানুষ শহরে কাজ পাবে। কিন্তু কোনও নিরাপদ সময়সীমার ভিতর বৃহৎ
ব্যবসায়ে ও বৃহৎ শিল্পে অধিকাংশের জন্য কাজের সুযোগ হবে না। বৃহৎ শিল্প
মোটের ওপর পুঁজিনিবিড় প্রযুক্তি নিয়ে চলে, অর্থাৎ, পুীঁজর পরিমাণের তুলনায়
সেখানে শ্রমিক নিযুক্ত হয় অল্প সংখ্যায়। এই অবস্থায়, গ্রামাঞ্চলে কাজের
সুযোগ কীভাবে বাড়ানো যায়, সেই চিন্তা করা আবশ্যক। নইলে গ্রামের উদ্বৃত্ত
মানুষের ধাক্কায় নগর বেসামাল ও অসুস্থ হয়ে পড়বে। গ্রামকে অসুস্থ রেখে শহর
সুস্থ থাকতে পারবে না, গণতন্ত্রকে রক্ষা করা যাবে না। এটাই এই সময়ের এক
প্রধান শিক্ষা। নগর চাই; গ্রাম চাই; প্রয়োজন এদরে সুস্থ সহাবস্থান।
গ্রামীণ
অর্থনীতির সুস্থতার জন্য একদিকে যেমন কৃষির উন্নয়ন প্রয়োজন, অন্যদিকে
তেমনই কৃষির পরিপূরক অন্য বহুবিধ কর্মোদ্যোগের বিকাশ আবশ্যক। কেবল কৃষির
উপর নির্ভর করে গ্রামীণ অর্থনীতি পূর্ণতা লাভ করে না। চাই কৃষিনির্ভর
গ্রামীন শিল্প, ফলের, সবজির ও ভেষজের চাষ, জৈবসারের উৎপাদন, মাছের চাষ,
বনসৃজন, পানির ও বাসস্থানের সুব্যবস্থা, এই সবের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা এবং এই রকমের আরও নানা ক্রিয়াকর্ম। এইভাবে
সৃষ্টি করা যায় পল্লির পরিধির ভিতরই বর্ধিত কর্মসংস্থান এবং স্বাচ্ছন্দ্যের
উপকরণ, ভোগের সীমাহীন আকাক্সক্ষা ত্যাগ করলে যেটা সন্তোষদায়ক। একটা
মাত্রার পর উপকরণের আকাক্সক্ষা যত বাড়ে ততই বাড়ে অশান্তি। আরও একটি কথা
আছে, যেটি রবীন্দ্রনাথ আমাদের বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
গ্রামোন্নয়নের জন্য চাই সমবায় ও আত্মশক্তির ওপর নির্ভরতা, সরকার অথবা
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ওপর অত্যধিক নির্ভরতার অভ্যাস সযত্নে বর্জন করা
বাঞ্ছনীয়।
পল্লীসংগঠন বিষয়ে তাঁর বিশিষ্ট চিন্তাভাবনাকে রবীন্দ্রনাথ
স্থাপন করে যেতে চেয়েছিলেন শ্রীনিকেতনে। আমাদের দুর্ভাগ্য, বাঙালির মন
সেদিকে আকৃষ্ট হয়নি। অনেকে বলেন, আজকের অবস্থার সঙ্গে শ্রীনিকেতনের আদর্শের
সামঞ্ছস্য নেই। মনে রাখা আবশ্যক, শিক্ষা ও গ্রামোন্নয়ন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের
চিন্তা তাঁর সমকালেও ছিল এক উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদী চিন্তা, প্রতিষ্ঠিত
ব্যবস্থার সঙ্গে তার মিল ছিল না। বিকল্প সমাজচিন্তা হিসেবেই তার
প্রাসঙ্গিকতা। চলতি ধারার সঙ্গে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনকে যাঁরা মিলিয়ে
নিতে চাইছেন, তাঁরা রবীন্দ্রনাথের গঠনমূলক প্রতিবাদকেই অস্বীকার করছেন। এক
ভোগবাদী সমাজের ঘনীভূত সংকটের কাছে আত্মসমর্পণ করার চেয়ে মহত্তর কোনও
ভাবনাকে তাঁরা মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারছেন না। এঁরা সংখ্যায় অনেক, এঁদের
সমবেত শক্তিকে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং শঙ্কার চোখে দেখেছেন। বিশ্বভারতী বহুকাল
হল তার ঐতিহাসিক উদ্দেশ্য হারাচ্ছে। সংকট আরও কত গভীর হলে আমাদের চৈতন্যোদয়
হবে-কখনও হবে কি না-কে জানে! তবু আশা রক্ষা করে কিছু কথা বলে যেতেই হয়।