মন সোহাগীর পালা

সফিকুল বোরহান ।।
বউন্না ফুলের গাছ, নব বর্ষার খাল ভরা পানিতে ঝুকে পড়ে তার শাখা-প্রশাখার ঘনপাতাকে একটু ভিজিয়ে নিয়ে সবুজের উচ্ছাসে মেতে উঠছে। ওই পাশে হিজল ফুল লতাঝুমকা দুল হয়ে বাতাসে দোদুল দুলে নির্মল কাকচক্ষু পানির দিকে অবাক তাকিয়ে রয়। রাত ভর সে ঝরাবে তার গোলাপী-সবুজ রাঙা পাপড়ির দল। সেই হিজল পাপড়ি ভেসে ভেসে যাবে অনাদির দিকে, সে ভেসে যাবে কূলবধূর ঘাটের দিকে, সে ভেসে যাবে প্রণয় কুমারীর ওমভরা মায়াবী আঁচল তলে। এরকম হিজল, বউন্না, জারুল, ভাঁটফুল, লজ্জাবতীর কোল ঘেষেই নিদাঘ সময় কাটে জবানুরের এখন।
মধ্য বয়স পেরিয়ে জবানুর এখন অনেকটাই একাকী। জীবনের হিসেব-নিকেষ করার কোনো মানে হয় নি কখনো। শুধু একাকিত্ব বড়ো যন্ত্রনা দেয় মাঝে মধ্যে। শিশুকালে নিটোল গ্রামীণ পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠা। তারপর যাপিত জীবনের হাত ধরে এগিয়ে চলা। পড়াশুনা শেষ করেই চাকরি, বিয়ে। রাফিজুলের হাত ধরে কত পথ, কত মত যে পাড়ি দেয়া হলো। নতুন যারা এলো মধ্যবর্তী জীবনে তারাও এখন বড়ত্বের প্রভায় জাঁকিয়ে, হাঁকিয়ে বেড়ায় অনিন্দরূপে। বেশি বেশি মন খারাপের উপকরন যে আসেনি তা নয়, রাফিজুল অতি মমতায় আগলে রেখেছে যতটুকু পারে। কিন্তু অনাবিল দ্যোতনায় জীবনের সবটাই কেটেছে মায়াময়ী হয়ে।
রাফিজুল, প্রথম কলেজ সময়ের বন্ধু হয়ে এসেছিল। তারপর দীর্ঘ পথচলা, কখনো হাতে হাত রেখে, কখনো চিঠির মধুরিম ছন্দে, কখনো দীর্ঘ বিরহ কাহনে, কখনো রবীন্দ্র লহমায়, কখনো নজরুল-সুকান্ত-জীবনানন্দের মর্মরে। আর সেই ছবিঘরের রঙিন আলোয় মৃণাল, সত্যজিত, জহির রায়হান, মোর্শেদুল ইসলাম, তানভির মোকাম্মেল চষে বেড়াতো মনের অলিন্দে শোভিত হয়ে। দিনে দিনে জবানুর এতো উদ্বেল হয়ে উঠতো রাফিজুলের প্রচ্ছাসে, বিবর্তিত সময় কখন এক সুতোর বাধনে আসবে তার প্রহর গুনতে গুনতে অস্থিরতা চলে আসতো।
এরকম বহতা স্রোতে বাবাই কেবল পাশে থেকেছে পরম বন্ধু হয়ে। মায়ের ভীত উৎকন্ঠাকে বাবা কোনোভাবেই সামাল দিতে পারতেন না। মায়ের মন সন্তানের মাঙ্গলিক অভিধায় দিনে দিনে কেমন ম্রিয়মান হয়ে উঠতো। মা প্রেম-ভালবাসার অকথিত কাঙ্খিতকে কখনোই মেনে নিতে পারতেন না। বোঝাই যাচ্ছে দিন কটেছে মায়ের চোখের পানি ফেলেই। হল থেকে বাড়ি ফিরেই মায়ের জেরায় নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে কতকাল, কত সময়। হাজারো মিনতি, হাজারো অভিমান, হাজারো নিষেধ কাটতে কাটতে শেষমেষ শেষ সময় চলেই এলো। রাফিজুলের পরিবার থেকে যখন লোক এলো কথাবার্তা বলতে, শেষটায় মাকে এই প্রথম একটু সাবলীল মনে হয়েছে। তারপর ফুল-ডালা আর দিনক্ষণের পালায় কোনদিক দিয়ে যে বড়ো রকমের বিবর্তিত সময় পার হয়ে গেল টেরই পায়নি জবানুর।
কর্মক্ষেত্র এদেশে যেরকম, সেরকম ভাল-মন্দ আবর্তনেই কেটেছে। কেটেছে মানে কাটাতে হয়েছে। রাফিজুলের প্রানময় অগ্রগামিতা জীবন চলার মত সাবলীল ছিলই, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। রাফিজুল কখনোই জবানুরের চলতি পথে প্রশ্নাতুর অধ্যায় আনেনি। শুধু বলেছে মাঝে মধ্যে ‘এই পরিশ্রমটা না করলেও চলতো।’ জবানুরের উত্তরটা ছিল ‘নিজের জন্য নয়, বাচ্চাদের পরিধি, মানসিকতার উৎকর্ষনের জন্য চাকরিটা থাকতে হবে।’ আর আর্থিক ব্যাপারটাকে কোনোভাবেই এড়ানো যায় না বলেই সাচ্ছন্দ সুখের প্রিয়তি সঙ্গী হয়ে ওঠে। যতটুকু প্রয়োজন, তারচে আয়োজন মাঝে মধ্যে বেশী হয়ে গিয়ে দুর্বিনীত মনখোরাক কিংবা সন্তানদের বিলোল পথচলায় প্রশান্তিই সপ্তডানা মেলে ধরে বড়ো আবেগী হয়ে, বড়ো পরিতৃপ্তি হয়ে।
মা ছাড়া কিচ্ছুই বোঝেনা জেরিন, শৈলী, তন্ময়। বাবার কাছে শুধু আব্দার বেড়াতে নিয়ে যাবার, দেশে, পাশর্^দেশে, সমুদ্রে, পাহাড়ে, লাইব্রেরিতে, মেলায়, দাদাবাড়ি, নানাবাড়ি, বন্ধুবাড়ি, স্কুলে, কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে। কোনো কেনাকাটায় বায়না নেই, কোনো খাওয়ায় বায়না নেই, কোনো পোষাক কেনায় বায়না নেই। শুধু প্রয়োজনটা বেশী হলে মুঠোফোনের ফ্ল্যাক্সি লোড আর স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির বেতন, রেজিষ্ট্রেশন ইত্যাদি। আর ওদের মা জবানুর, হাজার প্রয়োজনীয় উপকরনের এতো যোগান কোত্থেকে যে দেয়! কোন পোষাক, কোন সেন্ডেল, কোন জামা, কোন জুতো, কোন লিপষ্টিক, কোন প্যান্ট, কোন খাবার, কোন প্রসাধনী, কোন ক্রিম, কোন লোশন, কোন অন্তর্বাস, কোন অসুধ..., রাফিজুল অবাক হয়। মেয়েদের দাঁড়াতে হয় কীভাবে, হাসতে হয় কীভাবে, চলতে হয় কীভাবে, শুতে হয় কীভাবে, ছেলের কোন দুস্টুমি করতে হয় না, কত জোরে শব্দ করে পড়তে হয়, কীভাবে বাজার করতে হয়, কীভাবে কথা বলতে হয়, মা-বাবার সাথে কীরকম আচরন করতে হয়, বোনদের সাথে কীরকম আচরন করতে হয়...ইত্যাদি, ইত্যাদি।
রাফিজুল চাকরি থেকে অবসর নিয়েই ঘোষণা দিল, ঢাকায় থাকবে না। বাড়িতে চলে যাবে। শুনে জবানুর একটু মগ্ন হয়। এতোদিন ঢাকায় থেকে, শহরের জীবনে অভ্যস্থ হয়ে গ্রামে কি আত্মস্ত হওয়া যাবে? যদিও চিরটাকাল তারা গ্রামের বাড়ির সাথে খুব বেশী যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা রেখে আসছিল। গ্রামের বাড়িতে সবই আছে, বিশাল বাড়ি আছে, ফল বাগান আছে, দীঘি, পুকুর আছে, ধান-সবজির খেত আছে, অবারিত উঠোন আছে, নির্মল বায়ু আছে, পাখির কিচির-মিচির আছে। বেশী যেটা আছে সেটা হলো বাড়ির আত্মীয়, গাঁয়ের আপনজনেরা। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। জেরিন এখন বরের সাথে নেদারল্যান্ডে, শৈলী খুলনায় জাঁকিয়ে সংসার করছে। ওর বর ওখানকার একটি জুট মিলের জেনারেল ম্যানেজার। তন্ময় এবং তার বৌ দুজনেই কর্পোরেট জব করছে একই নামকরা একটা প্রতিষ্ঠানে। তন্ময়ের মেয়েটা ওদের প্রানপাখি। প্রায় নির্জন বাসাটায় নাতনি তিতলি একটা জমজমাট আবহ করে রাখে। বাসার চারজনেই যখন চাকরির পেছনে ছুটছিল তিতলি তখন গাঁ থেকে আসা দূরাত্মীয় সেলিনার কোলেপিঠে মানুষ হচ্ছিল। তাছাড়া নিয়মিত দাদি-নানি-খালা-ফুফু কোনো না কোনো সময় পালা করে থাকছিলই। তিতলি এখন ছয় বছরের। দাদা রাফিজুলের ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘোষনা কী ম্রিয়মান এনে দিল পরিবারটায়!
নিয়মিত মেইল, ফোন, আকুল আকাঙ্খায় মেয়েদের বোঝাতে চেষ্টা করে তাদের বাবা। রাফিজুলের দেশপ্রেম, মানবীয় গুণাবলীর দিকগুলি সর্বজনবিদিত। জবানুরের একটাই আকুলতা তিতলি থাকবে কী করে! আর তিতলিকে ছাড়া ওদেরইবা চলবে কী করে। বাস্তবতার অমোঘ নিয়মের কথা ঘুরেফিরে চলতে থাকে। ঢাকার ফ্ল্যাটটা তন্ময়ের নামে রেজিষ্ট্রি করা হলো। তন্ময়ের এক কথা, বাবা-মা চলে গেলে তার বৌকে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে। রাফিজুল আর তন্ময়ের বৌ রায়মার অভিমত, চাকরিটা থাকতে হবে। জবানুর বাস্তবতার পেষনে লুকিয়ে কেঁদে চোখ ভাসায়। তারপর একদিন রাফিজুলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে বাসাভরা আত্মীয়-স্বজনের মিলনমেলায় ক্রান্ত পরিবেশে ঢাকার নিজেদের দীর্ঘজীবনের সংসারটাকে একটু ব্যথাতুর করে সবাই মিলে গাঁয়ের পথে রওনা হয়।
জবানুরের চাকরি আছে আর চৌদ্দ মাস। রাফিজুলকে বাড়িতে থিতু করে দিয়ে জবানুর ঢাকায় চাকরি, নাতনি আর নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে শুরু করে। সাময়িক বিচ্ছেদেও এত বেদনা থাকতে পারে কল্পনাও করতে পারে না জবানুর। রাফিজুল ঢাকা-বাড়ি-ঢাকা করে সময় পার করে দেয়। দেখতে দেখতে বছর গড়ায়। কর্মক্ষেত্রের বিচ্ছেদও এত জ¦ালাময়ী হতে পারে! সয়ে উঠছে তিতলি। দিন গড়াতে থাকলে তন্ময়ের ভেজা চোখ আর বাবা-মাহীন একাকীত্বের দখল মুষড়ে আসলেও সামালতো দিতে হবেই। বোনেদের চলে যাওয়ার করুণাত্মক দৃশ্য ভোলা কি যায়? চলে যাওয়া মানে তো চলে যাওয়া নয়। ফিরে ফিরে আসে পারিবারিক বন্ধন, কিন্তু বাবা-মায়ের চলে যাওয়া আর কখনো চিরন্তন একীভূত না হওয়া মনকে কেমন করে প্রবোধ দেয়া যায়? অবশ্য এটাইতো নিয়ম। কখনো সাময়িক যাওয়া, কখনো একেবারে চলে যাওয়া। একটা সময়তো স্থায়ীভাবেই চলে যেতে হয় সবাইকে। সেধারায় আবারো বছর দেড়েক পর তন্ময় জেরিনের পথ ধরে নেদারল্যান্ডে চলে যায় বৌ-বাচ্চাসহ।
জবানুরের কোল একদম খালি হয়ে গেল। খালিইতো ছিল একরকম, এবার শুন্যতা সপ্তডানা বিস্তার করে উঠল।রাফিজুল মেতেছে গ্রাম উন্নয়নে। পিছিয়ে পড়া বাড়ির পাশের হাইস্কুলটাকে রাতারাতি উন্নতির শিখরে নিয়ে এলো। রাস্তাঘাট যা ভাঙ্গাচোরা ছিল বন্ধু চেয়ারম্যানকে ধরে, এমপি-কে ধরে চলনসই করে নিল। জমি-জিরাত যা বাবা পোষানি দিয়ে গেছিলেন, সব খারিজ করে নিজেই চাষবাস শুরু করে দিল। ঢাকা থেকে এক্সপার্ট এনে ফল-সবজির আবাদে প্রাণ নিয়ে এলো। শূন্য গোয়াল গরুতে পরিপূর্ণ করা শুরু করলো। পুকুর-দিঘিতে মাছের পুষ্প সঞ্চালন দেখার মতো। মুরগি-হাঁসের ডাকে মুখর সারা বাড়ি। কামলা-মুনিদের আধুনিক পোষাকে, আধুনিক উপকরনে কত কী যে করতে চাচ্ছে রাফিজুল, জবানুরের মেনে নিতে খারাপ লাগে না। একটাই কারন, সূযোগ পেলেই রাফিজুল বেশ সময় দিতে চেষ্টা করে আর নিদারুন দেশজ সৃষ্টি কার না ভাল লাগে!
রাতচাঁদ যখন সারা আকাশ ছেপে জোসনার বান আনে, তখন বেরিয়ে পড়ে জবানুর-রাফিজুল। কতদূর চলে যায় হাঁটতে হাঁটতে। ওই দূরে খালপাড়ে যে বটগাছটা আছে, তার নীচে যে পাকা বেঞ্চ আছে তাতে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্পের ফোয়ারা বইতেই থাকে। খালঝোপের জোনাকি কন্যারা তাদের এই প্রেমজ কাহন অবাক হয়ে দেখে নেয়। কোনো একসময় রমনার লেক, টিএসসির নীচু দেয়াল, শিল্পকলা চত্তর, বেইলি রোড ওদের হাতের নাগালে চলে আসে। কোনো এক সময় রিকশার হুড তোলা হয়ে যায়, আবার কোনো এক সময় হাতে হাত ধরে রমনার এ মাথা থেকে ওমাথা চষা হয়ে যায়। আবার সংসার যাপনে যেসব উপক্রমণিকা এসেছিল তার চর্চা হয় গল্পে, চোখের পানিতে, হাসিতে, স্বস্তিতে। আবার দিনমানে, বিকেলে কর্মচাঞ্চল্য যখন থিতু হয়ে আসে তখন ওই কাঠগোলাপ গাছের ফুটন্ত হলদেছোয়া সাদা ফুলেদের নিরাভরন হাসিতে নিজেরা অজান্তে হেসে উঠতে হয়। সাদা বেলি-কামিনীর নিদাঘ ঘ্রাণ আবেশী এনে পেরুনো ক্লান্তিকর কিংবা অতিব্যস্ততার সময়গুলোকে পরিচ্ছন্নকরে তোলে।
কিন্তু তিতলি, শৈলী, জেরিন, তন্ময়, রায়মা, তাদের তনয়-তনয়াদের মুখচ্ছবি মনে হতেই ব্যাথাতুর মনটা বিবাগী হয়ে ওঠে। অজান্তে বুকের পাথরটা কান্নার আবরনে তরল করে নিতে হয়। আজকাল আবার রাফিজুল অতি ব্যস্ততায় মেতেছে। ক্রমে জবানুর আরো একাকী হয়ে উঠছে। রাফিজুলের ভালবাসা, কেয়ারিং, সময় দেয়ার পরও নিঃসীম সময় কোনো কোনো সময় কাটতেই চায় না। মুঠোফোন, বই, রবীন্দ্রনাথ, রান্নাবান্না, টেলিভিশন, সংসার, প্রতিবেশী এসবেরও পর কখন অজান্তে চলে যাওয়া হয় পুকুর পাড়ে, হিজলতলায়। সীমাহীন দৃষ্টি পলকে চলে যায় সন্তানদের কাছে। ‘চলে আয় বাছারা’, বলেই চলে, বলেই চলে। হ্যাঁ, ওরাতো আসেই, বছরে একবার, দু’ বছরে একবার, কোনো কোনো সময় তিন বছরে একবার। ওই একবার আসাটাতে বুকটা কি পরিপূর্ণ হয়? ওই আসাতে কি হৃদয়ের সবটা আকুলতা মিইয়ে আসে? ওদেরতো চলে যেতেই হয়, ওদেরতো চলে যেতেই হবে, যেমন জবানুর-রাফিজুলদের চলে যেতে হয়েছিল ওদের বাবা-মা’র পরিধি থেকে। অন্ধস্নেহ তবে কী সব পরিজনদের এভাবেই কাঁদায়!
সব বোঝে রাফিজুল, সব বোঝে। সেই তরুন বয়সের উদ্যাম ভালবাসায় যেরকম জবানুরকে আগলে রেখেছিল আজও ঠিক তেমনি রাখতে সচেষ্ট হয়। বুকের সবটা আগল তো জবানুরের জন্যই তোলা, কিন্তু পরিধির বেড়াজাল একটুতো বৈষম্য আনেই। না, বসে থাকে না ওরা। বেরিয়ে পরে ঝোলায় কাপড়-চোপর নিয়ে। চষা হয়ে যায় মধুখালী দ্বিপ, সাজেক, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার। চষা হয়ে যায় রোয়াংছড়ি, সিলেটের হাওড়, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়। ছুটে চলে যায় পাশর্^দেশে, একটু দূরদেশে। একবার বড় মেয়ে আর ছেলের ডেরাতেও যাওয়া হয়ে গেছে। খুলনাতো কাছেই, ওখানেও যাওয়া হয়ে গেছে। তারপরও অবিরাম সময়ের কাছে নতজানু হতেই হয়। তারপরও মন সোহাগীর পালায় নিজকে সঁপে দিয়েও সকলের মাঙ্গলিক কামনায় উন্মুখ থাকতে হয় নিরন্তর। অনাদির এ স্রোতে কতকাল যে ভাসতে হবে, ডুবতে হবে কে জানে!
সফিকুল বোরহান
কথাসাহিত্যিক
অন্বেষা, রানির দিঘির পূর্ব পাড়, কুমিল্লা
০১৭১৪-৩৭২২০০
tanhaborhan@gmail.com
-------------------------------------কবিতা-----------------------------
ক্রমশ
পিয়াস মজিদ ।।
রোজ অনেকেই নক করে
চিনতে চায় আমাকে
চেনাতে চায় নিজেকে
তাদের কী করে বলি
নিজেকে কতটা অ-চিনি!
পাতালে হৃদয় রেখে দেখি
আকাশের নীল গান জমে জমে
শাদা কাফনে তারাদের জন্ম হয়।
সবাই বলে, আমি খুব দ্রুত হাঁটি
আমি তো আমার সন্দেহজনক গতিবিধির পিছু নিতে থাকি
ক্ষমা করো বোন
আলমগীর কবির ।।
আমাদের বোন আজ বিবস্ত্র—
আচ্ছাদন ছিঁড়ে গেছে সভ্যতার মুখে,
এ যেনো উলঙ্গ হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ নিজেই,
ধ্বংস হয়েছে লজ্জা, বিবেক, আর মর্যাদার শেষ রেখাটি।
তোমার কান্না শুধু এক নারীর নয়,
সেটা গোটা জাতির পতিত আত্মার আর্তনাদ।
তুমি যখন কাঁদো—
তখন কাঁদে ধানক্ষেত, কাঁদে পাখি,
আকাশও আর রাখে না চোখের জল।
আমরা কিন্তু ছিলাম চুপ,
দেখেও বলিনি কিছু,
শুধু মোবাইলের স্ক্রিনে নামিয়ে রেখেছি চোখ,
আর শেয়ার দিয়েছি—
তোমার সর্বনাশের ছবি,
ভিউজ আর লাইকের আশায়!
ক্ষমা করো বোনৃ
আমরা সবাই দোষী,
তোমার ঘর ভাঙার আগেই জানতাম ঝড় আসছে—
তবু বন্ধ করিনি দরজা।
তোমার ইজ্জত গেলো,
আর আমরা বসে বসে তর্ক করলাম—
ধর্ম, রাজনীতি, চরিত্র, জামা-কাপড়!
আমরা মুখে পুরুষ, বাস্তবে পশু নই—
পশুও লজ্জা পায় আমাদের পাশে দাঁড়াতে।
তুমি হয়তো মরেছো,
তবুও রেখে গেছো প্রশ্ন—
“বাংলাদেশ কি আমার বাড়ি ছিলো কখনও?”
আমরা কিছুই বলতে পারিনি,
পারবোও না,
কারণ আজ আমরাই সবচেয়ে বড় অপরাধী।
ক্ষমা করো বোন,
এই সমাজের নামের পাপীদের পক্ষ থেকে,
এই ভুয়া সভ্যতার ছায়ায় বেঁচে থাকা কাপুরুষদের পক্ষ থেকে,
ক্ষমা করো...
তোমার কান্না থামাতে পারিনি বলে।
তবে আজ, তোমার আর্তনাদে কাঁপুক আকাশ,
জেগে উঠুক প্রতিটি বিবেক,
এইবার যদি না দাঁড়াই,
তবে পতাকা উড়বে ঠিকই,
কিন্তু মাথা নত থাকবে চিরকাল।
ম্যান্ডেলিন
ইয়াসিন আশরাফ ।।
ম্যান্ডেলিনের অসীম দীর্ঘশ্বাসের দেয়ালে যারা
ভিড় করেছিল তাদের মধ্যে একজন ছিল
গ্রেটা থুনবার্গ
বাইশ বসন্তে যে জলবায়ুর টুকরো মেঘ থেকে
অর্জন করেছিল মানবতা
আর বারোজন নক্ষত্র সমস্বরে যে গান
ছুঁড়ে দিয়েছিল
বিশ্ব ইথারের হৃদপিণ্ডে ;
আমি দেখি সব হারিয়ে এখনও সমুদ্র কন্যা যায়
ভালোবেসে উপকূলে জীবিকার নোঙর
যেখানে তার।
অজস্র ব্যগ্র শোণিতে আরো কিছু লাল
স্নাত হতে হতে
অভুক্ত শিশুর নিস্পন্দ চোখ থেকে
প্রতিশোধ বেরিয়ে এসে
স্থাপিত হোক পারস্য মিশাইলে।
চৌপদি কবিতা
সৈয়দ মুজিবুর রহমান দুলাল'র ।।
কষ্টের নানাহ রঙ
কষ্ট আমার নিত্য সঙ্গী
কষ্টে ভরা বুক।
যতই কষ্ট দাও তুমি
তাতেই আমার সুখ।
কষ্ট দিয়ে আমায় তুমি
একটু পেলে সুখ।
এতেই আমার ঘুছে যাবে
সকল কষ্ট দুখ।
কষ্টে করছি দিনাতিপাত
বুঝলো না তো কেউ।
কষ্ট আমার আছড়ে পড়ে
সাত সমুদ্রের ঢেউ।
কষ্ট এতো নানাহ রঙের
বুঝিনি তো আগে।
কষ্টের রঙে মন রাঙাতে
সাধ কেবলই জাগে।
কষ্টগুলো যতন করে
হৃদয় মাঝে পুষি।
কষ্ট দেওয়া মানুষগুলো
থাকুক তবুও খুশী।
কষ্ট পেয়ে কাঁদি আবার
কষ্ট পেয়ে হাসি,
কষ্টগুলো কষ্ট করে
যত্নে ভালোবাসি।
কষ্ট আমার চিরসাথী
নিত্য বয়ে চলে।
কষ্টগুলো কষ্ট দিয়ে
কষ্টের কথা বলে।
কষ্টগুলো কষ্ট দিয়ে
দু'চোখ ভাসায় জলে।
কষ্ট পেয়ে হঠাৎ করে
একদিন যাবো চলে।
কষ্ট কেমন বুঝবে তখন
কষ্ট কতো সুখ।
কষ্ট পেয়ে চলে গেলে
দেখবে না আর মুখ।
কষ্ট কেমন বুঝতে যদি
থাকতে নাকো দূরে।
কষ্টের বোঝা নিয়ে এখন
আমি থাকি আচীনপুরে।
গন্তব্যের সুর
মশিউর রহমান রিপন ।।
এই যে পথ, নিঃশব্দ বাতাসের ভেতর
অদৃশ্য এক সুরে জড়িয়ে থাকে,
নির্দিষ্ট কোনো দিগন্ত দেখায় না;
তবুও এগিয়ে যাই,
নীরব আলোর ইশারায়,
যেন স্বপ্নেরা হাতছানি দেয় অচেনা দিকে।
জন্মের প্রথম শ্বাসে যে বাঁধন,
তা কি কেবল মায়ের হৃদয়ের উষ্ণতা,
না কি অজানা কোনো নিয়তির সুতোর স্পর্শ,
যা প্রতিদিনই টেনে নেয়,
অচেনা স্রোতের টানে?
কত শহর, কত মুখ, কত বিস্মৃত নাম
ফেলে আসি, তবুও মনে হয়
চলতে হবে আরও দূরে
যেখানে কোনো মানচিত্র নেই,
শুধু অন্তরের আলো
পথের নিশানা হয়ে থাকে।
রেখাচিহ্ন মুছে গেলেও
থামা নেই,
জীবনের মন্ত্রে বাঁধা
প্রতিটি পদক্ষেপ;
গন্তব্য হয়তো শুধুই নাম,
অথচ তার মাঝেই লুকানো
এক মহৎ আয়োজন
যেখানে আমরা হারাই,
আবার খুঁজে পাই নিজেকে।
উদ্দেশ্য
আহমেদ সাব্বির ।।
একটি কবিতা লেখার জন্য,
পেরিয়ে এসেছি বহু চোখ।
বহু বিপ্লবীর লাশ,
ইতিহাস থেকে ইতিহাসে
রক্তাক্ত ব্যবচ্ছেদ।
একটি কবিতা লেখার জন্য,
পেরিয়ে এসেছি বহু খোলা চুল৷
খোঁপা থেকে কাজলে,
শাড়ীর কুচি ধরে সাজিয়েছি
শায়েরী অভিধানের সার্কাস৷
একটি কবিতা লেখার জন্য,
পেরিয়ে এসেছি বহু
কাওয়ালী নিষিদ্ধ গজলের পথ।
আসমান থেকে জমিনে,
ফজর থেকে এশার আরশে
ঠুকেছি মাথা নিহত মোনাজাতে।
একটি কবিতা লেখার জন্য,
রবীন্দ্রনাথ থেকে শক্তি
লোরকা থেকে গালিব ঘুরেছি।
হয়রান মুসাফির গলা পর্যন্ত ক্লান্ত হয়ে,
জর্দা ঠোঁটে কয়েদ খুঁজেছে।
একটি কবিতা লেখার জন্য,
মৃত্যু থেকে মৃত্যু
জন্ম থেকে জন্ম
কয়লা থেকে ইস্পাত
অভ্যুত্থান থেকে রক্ত
৪৭ থেকে ৭১
ক্ষয় থেকে অক্ষয়
সচল থেকে অক্ষম
নগ্ন থেকে নগ্ন
পরিচয় থেকে অজ্ঞাত
সৃষ্টি থেকে ঘুণ
পুকুর থেকে সমুদ্র
ডাইনোসর থেকে এআই
সব দেখেছি৷
তবুও, কবিতার খোয়াব
খুঁজে ফিরে দুহাত।
মুক্তির সফেদ অশ্ব,
যেখানে নিশ্চিন্তে জাবর কাটে।
নায়াগ্রা যেখানে বরফ ভেঙ্গে,
সজোরে ঝাড়া দিয়ে ওঠে।
দান্তে ও ভার্জিল যেখানে নরক থেকে বাইনারি,
সীমানায় বেগুনাহ আলোর মুলাকাত ঘটায়।
সেই দুইহাত, মসলিন মোলায়েম
কবিতা খুঁজে ফিরে,
গৃহত্যাগী দুহাত।