নিজস্ব প্রতিবেদক:
কুমিল্লার
মুরাদনগরে মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগেগণপিটুনিতে মা-মেয়েসহ একই পরিবারের
তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) মুরাদনগর উপজেলাধীন
বাঙ্গরা বাজার থানার কড়ইবাড়ি গ্রামে এই ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন- কড়ইবাড়ি
গ্রামের জুয়েল মিয়ার স্ত্রী রোকসানা আক্তার রুবি (৫৫), তার ছেলে রাসেল মিয়া
(২৮) এবং মেয়ে জোনাকি আক্তার (২২)। গণপিটুনিতে রুবির আরেক মেয়ে রুমা
আক্তার মারাত্মক আহত হয়েছেন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা
হয়েছে।বাংগরা বাজার থানার ওসি মাহফুজুর রহমান এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত
করেছেন।
মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পুলিশের তালিকায় নাম থাকা রুবির বিরুদ্ধে
থানায় একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে। এর আগে সে মাদকসহ গ্রেপ্তার
হয়েছিলো বলেও জানিয়েছে পুলিশ।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, বাঙ্গরা
বাজার থানাধীন কড়ইবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা জুয়েল মিয়ার স্ত্রী রোকসানা আক্তার
রুবি ‘অন্তত ৪০ বছর’ ধরে মাদক ব্যবসাসহ অন্যান্য অসামাজিক ও অপকর্মের
সঙ্গে জড়িত। তিনি সেখানে নিজ নামে ‘রুবি আক্তার মঞ্জিল’ নামে ৬ তলা ভবন
নির্মাণ করেছেন। তার সাথে তার ছেলে, দুই মেয়ে ও মেয়ের জামাতারা থাকেন। এ
পরিবারের সবাই মাদক ও অন্যান্য অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। বিভিন্ন স্থান থেকে
উশৃঙ্খল ছেলেরা এখানে এসে আড্ডা দেয়, ঝামেলা বাধায়। তাদের ‘অত্যাচারে
অতীষ্ঠ’ এলাকাবাসী বুধবার সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত নেয় এই গ্রামকে ‘মাদকমুক্ত’
করার। সেই সিদ্ধান্তের জের ধরেই বৃহস্পতিবার সকালে তাদের উপর হামলা হয়।
তবে
অপর একটি সূত্র বলছে, বুধবার রাতে রুবির এক মেয়ের জামাতা এক স্কুলের স্কুল
শিক্ষকের মোবাইল ছিনতাই করে। এ ঘটনার পর এলাকাবাসী আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে
বৃহস্পতিবার সকালে তাদেরকে জিজ্ঞাবাদের সিদ্ধান্ত হয়। সকালে এ নিয়ে
‘হট্টগোল’ হয় এবং এক পর্যায়ে গ্রামবাসী পিটিয়ে ওই পরিবারের তিনজনকে হত্যা
করে। এসময় রুবির বাড়িটিতেও ব্যাপক ভাংচুর চালানো হয়।
কড়ইবাড়ি গ্রামের
মো. মোস্তফা জানান, আগের দিন (বুধবার) সন্ধ্যায় এলাকাবাসী সিদ্ধান্ত নেয় যে
সকালে তাদেরকে এলাকা থেকে উচ্ছেদ করা হবে। তিনি দাবি করেন, রুবি দীর্ঘদিন
ধরে মাদক ব্যবসা করে আসছিল। আগের দিন সে স্থানীয় মেম্বার ও কয়েকজনকে মারধর
করে। গ্রামবাসী, এলাকাবাসী, চেয়ারম্যান-মেম্বার সবাই মিলে মাদক কারবারিদের
উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রত্যক্ষদর্শী আরেক বাসিন্দা বলেন,
বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই ঘটনার সূত্রপাত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত ও তাদের অত্যাচারে
অতিষ্ঠ জনগণ আস্তে আস্তে তাদের বাড়ির আশপাশে জড়ো হতে থাকে। এই এলাকার মানুষ
মাদকের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে, এটাই মূল ঘটনা।
বাংগরা বাজার থানার
ওসি মাহফুজুর রহমান জানান, ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ তিনজনের মরদেহ উদ্ধার
করেছে। প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি- মাদক ব্যবসা ও এই পরিবারের উশৃঙ্খলতার
কারণে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ ছিলো। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে সহকারে খতিয়ে দেখা
হচ্ছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে এসেছেন। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর
একাধিক টিম বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কুমিল্লার
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খান জানান, কেউ এলাকায় কোন অপরাধ
কর্মকাণ্ড সংঘটিত করলে জনগণের উচিত তাকে পুলিশে সোপর্দ করা। এভাবে আইন হাতে
তুলে নেওয়া কোনোঘাবেই কাম্য নয়। যারা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাদেরকে আইনের
আওতায় আনা হবে।
হত্যাকাণ্ডের সূত্রপাত যেভাবে:
স্থানীয় একটি
সূত্র বলছে, বুধবার বিকেলে ওই এলাকায় রুহুল আমিন নামে এক স্কুল শিক্ষকের
মোবাইল ফোন ছিনতাই হয়। মাদক বিক্রেতা রুবির মেয়ের জামাতা মনির হোসেন এটি
ছিনতাই করেন বলে অভিযোগ করা হয়। এ নিয়ে বুধবার বিকেলে রুবিকে জিজ্ঞাসাবাদের
সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার সকালে স্থানীয় ইউপি
সদস্য বাচ্চু মিয়া এবং আকাবপুর ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল রুবিকে
জিজ্ঞাসা করতে গেলে তাদের ওপর হামলা করা হয়। এতে এলাকায় চরম উত্তেজনার
সৃষ্টি হয়। এ সময় ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল এবং ইউপি সদস্য বাচ্চু
মিয়া দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। খবর পেয়ে এলাকার শতাধিক লোক ঘটনাস্থলে
গিয়ে তাদেরকে গণপিটুনি দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই রুবি, তার ছেলে রাসেল এবং মেয়ে
জোনাকি নিহত হয়। আহত হয় আরেক মেয়ে রুমা আক্তার।
আকাবপুর ইউনিয়ন পরিষদের
চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল সাংবাদিকদের বলেন, মোবাইল ছিনতাইয়ের একটি ঘটনা
আমি জিজ্ঞেস করতে গেলে আমাকে এবং ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়াকে মারধর করা হয়।
আমরা সম্মান বাঁচাতে ঘটনা এড়িয়ে এলাকায় চলে যাই। পরে গ্রামবাসীর সঙ্গে তারা
সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে গণপিটুনিতে মাদক ব্যবসায়ী রুবি, তার ছেলে এবং মেয়ে
নিহত হয়। আসলে এমন হত্যাকাণ্ড কোনভাবেই কাম্য নয়।
অপরদিকে গণপিটুনিতে
নিহত রাসেলের স্ত্রী মীম আক্তার বলেন, সম্প্রতি মারুফ নামে এক ছেলে চুরির
ঘটনায় ধরা পড়লে তাকে ছাড়িয়ে আনতে যান শাশুড়ি রোকসানা আক্তার রুবি। এ সময়
স্থানীয় বাসিন্দা বাছিরের সাথে তার বাগবিতণ্ডা হয়। এরই সূত্র ধরে আমাদের
বাড়িতে হামলা ভাঙচুর হয়। গণপিটুনি দিয়ে আমার স্বামী শাশুড়ি এবং ননদকে মেরে
ফেলা হয়েছে।
তিনি জানান, বুধবার সন্ধ্যায় এই হামলা করার পরিকল্পনা করে
প্রতিপক্ষের লোকজন। এভাবে যে তিনজন মানুষকে মেরে ফেলা হবে সেটা বুঝতে
পারিনি। হামলায় আমার আরেক ননদের অবস্থাও গুরুতর। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে,
সে বাঁচে না মরে ঠিক নাই।