কথায়
আছে, ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, আর উলুখাগড়ার প্রাণ যায়!’ আমাদের পরিস্থিতিটা
ঠিক তেমনই। হাজার মাইল দূরে ইরান আর ইসরায়েলের মধ্যে চলছে তুমুল লড়াই।
ইসরায়েল ড্রোন হামলা চালাচ্ছে ইরানের ওপর, আর ইরান পাল্টা আঘাত হানছে
ব্যালিস্টিক মিসাইল দিয়ে। এই সংঘাতকে উসকে দিচ্ছেন ডনাল্ড ট্রাম্প,
ইসরায়েলকে বলছেন ‘লড়ে যাও, আমরা তোমাদের পেছনে আছি।’ যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহুও
হামলা চালিয়ে যাচ্ছেন, আর ইরানও সমানতালে পাল্টা জবাব দিচ্ছে, সঙ্গে
ইসরায়েলের সব মিত্র দেশকে হুমকি দিচ্ছে। ট্রাম্পও পাল্টা হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন
যে আমেরিকার গায়ে আঁচ লাগলে ইরানকে গুঁড়িয়ে দেবেন। আরব বিশ্বের বাকি
দেশগুলো দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে। এটিই হলো বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনীতির
এক ভয়ঙ্কর চিত্র।
এই প্রেক্ষাপটেই আসে 'উলুখাগড়া'র প্রশ্নটি। যুদ্ধ
দূরে। কিন্তু দহন লাগতে যাচ্ছে আমাদেরও ঘরে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ
বাংলাদেশেরও ব্যাপক ক্ষতি বইয়ে আনতে যাচ্ছে, আর এর মূল কারণ হলো জ্বালানি
অর্থনীতি।
এই অর্থনীতির হিসাব বুঝতে হলে প্রথমে পশ্চিম এশিয়ার মানচিত্র
এবং ইরানের অবস্থান জানা জরুরি। ইরান বিশ্ব মানচিত্রের ঠিক মাঝামাঝি
অবস্থানে। এটি এশিয়াকে একদিকে ইউরোপ এবং অন্যদিকে আফ্রিকার সঙ্গে সংযুক্ত
করেছে। ইরানের পূর্বে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান; পশ্চিমে
ইরাক, তুরস্ক; এবং উত্তর-পশ্চিমে আর্মেনিয়া, আজারবাইজান। এছাড়া, এর একদিকে
কাস্পিয়ান সাগর এবং অন্যদিকে পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগর।
এবার আসা যাক
হরমুজ প্রণালীতে। এটি পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগরের মধ্যবর্তী একটি সরু
প্রণালী, মাত্র ৩৩ কিলোমিটার বিস্তৃত। কিন্তু এই ক্ষুদ্র প্রণালীই বিশ্ব
জ্বালানি রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু।
বিশ্বের মোট তেল ও গ্যাসের ২০ শতাংশ
সরবরাহ হয় এই হরমুজ প্রণালীর মাধ্যমেই। ইরাক, কুয়েত বা সংযুক্ত আরব
আমিরাতের মতো দেশগুলোকে জলপথে এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে
হলে হরমুজ প্রণালী ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কাতারের ক্ষেত্রেও একই কথা
প্রযোজ্য। হরমুজে অবস্থিত সাতটি ছোট দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ ইরানের হাতে।
এছাড়াও, প্রণালীর ঠিক মুখে রয়েছে ইরানের বন্দর আব্বাস। ইরান চাইলে এখান
থেকে তাদের নৌবাহিনী ব্যবহার করে পুরো হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দিতে পারে।
সেক্ষেত্রে জলপথে পশ্চিম এশিয়া সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এর পরিণতি কী
হবে?
প্রতিদিন এই প্রণালী দিয়ে প্রায় ২ কোটি ব্যারেল তেল ও গ্যাস,
অর্থাৎ প্রায় ৩০০ কোটি লিটার জ্বালানি সরবরাহ হয়। হরমুজ বন্ধ হলে এই পুরো
সরবরাহ আটকে যাবে। বাংলাদেশের জন্য এর প্রভাব বিশাল। কারণ, বাংলাদেশ যে
পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানি করে, তার প্রায় ৯২শতাংশ এবং প্রাকৃতিক গ্যাসেরও
একটা বড় অংশ এই পথেই আসে। অপরিশোধিত তেল শুধু পেট্রোল-ডিজেল তৈরি করে গাড়ি
চালানোর জন্যই ব্যবহৃত হয় না, এটি সার উৎপাদনে, শিল্পে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে,
রান্নার গ্যাস তৈরিতে এবং আরও অনেক কিছুতে ব্যবহৃত হয়। ইরান এখনও হরমুজ
প্রণালী বন্ধ করেনি, কিন্তু যদি তারা এই পদক্ষেপ নেয়, তবে এর প্রভাব সারা
বিশ্বে পড়বে, বিশেষ করে উপমহাদেশে।
হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে
তেল-গ্যাস আসার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। সৌদি আরব অবশ্য লোহিত সাগর এবং
বাব-আল-মান্দেব প্রণালী পেরিয়ে আরব সাগরে ঢুকতে পারবে, কিন্তু ইরাক বা
কাতারের মতো দেশের সেই উপায় নেই। তাতে খরচও এত বেশি হবে যে তা ‘খাজনার চেয়ে
বাজনা বেশি’ প্রবাদের মতোই হবে। যদি একান্তই বিকল্প রুট বা দেশ থেকে
জ্বালানি আমদানি করতে হয়, তবে অনেক বেশি খরচ গুনতে হবে, যার বোঝা বহন করতে
হবে আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে।
এরপর দ্বিতীয় আশঙ্কা হিসেবে আসে
বাব-আল-মান্দেব প্রণালী বন্ধ হওয়ার বিষয়টি। ইউরোপ থেকে লোহিত সাগর হয়ে এই
প্রণালীর মাধ্যমেই সব পণ্যবাহী জাহাজ আরব সাগরে আসে। এই কাজটি ইরানকে
সরাসরি করতে হবে না, বাব-আল-মান্দেব সংলগ্ন ইয়েমেনই এটি করবে। বলা ভালো,
তারা ইতিমধ্যেই করছে। এই প্রণালী দিয়ে ইসরায়েলি, ব্রিটিশ বা মার্কিন জাহাজ
গেলেই হুথিরা সেগুলোকে নিশানা করছে।
কারা এই হুথি? তারা হলো শিয়া
কট্টরপন্থী অস্ত্রধারী গোষ্ঠী, যারা ইরানের সমর্থনে ইয়েমেনের এক-তৃতীয়াংশ
নিয়ন্ত্রণ করে। হুথিরা একা নয়। বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিদের মদত দেওয়া
তেহরানের নীতির মধ্যেই পড়ে। ফিলিস্তিনে হামাস, লেবাননে হিজবুল্লাহ, সিরিয়ায়
ফাতেমিয় ব্রিগেড, ইরাকে আল-বদর– এদের সম্মিলিতভাবে বলা হয় ‘অ্যাক্সিস অব
রেজিস্ট্যান্স’ বা প্রতিরোধের অক্ষ। এই অক্ষের লক্ষ্য হলো ইরানের
শিয়া-প্রধান রক্ষণশীল সরকারের বিরোধিতা যারা করবে, তাদের ‘শিক্ষা দেওয়া’।
কাতার,
সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কুয়েতের সব তেলের ভাণ্ডার উপকূলের কাছে, ইরানের
ঠিক উল্টোদিকে। তেহরানের সঙ্গে ঝামেলায় তারা কিছুতেই জড়াতে চাইবে না। কারণ
খোমেনি প্রশাসন আগেই হুমকি দিয়েছে যে, এই দেশগুলোর মধ্যে যারা তাদের
বিরোধিতা করবে, তাদের তেলের ভাণ্ডার উড়িয়ে দেবে ইরান। তাই বাধ্য হয়ে তারা
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরানের পক্ষেই আছে। যদিও নীরবে।
যদি হরমুজ ও
বাব-আল-মান্দেব প্রণালী দুটোই বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে উভয় সংকট তৈরি হবে। বাকি
থাকবে কেবল পানামা খাল, কিন্তু সেখানে রয়েছে পানির সমস্যা। এর ফলে বিশ্ব
অর্থনীতিতে ধস নামবে, এবং বাংলাদেশও এর বাইরে থাকবে না।
যদি অপরিশোধিত
তেলের দাম সত্যিই সীমা ছাড়িয়ে যায়, তবে এর বোঝা আমাদেরই বইতে হবে, অর্থাৎ
আম জনতার। তখন পেট্রোলের দাম ১৪০ টাকা কিংবা ডিজেল ১৫০ টাকা হলেও অবাক
হওয়ার কিছু থাকবে না। অপরিশোধিত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বাড়লে
স্বাভাবিকভাবেই এলপিজির দাম বাড়বে। কারণ, রান্নার গ্যাস উৎপাদনের জন্য যে
প্রোপেন ও বিউটেন তৈরি হয়, সেই হাইড্রোকার্বন আসে অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম
থেকেই। ফলে গ্যাসের দামও আর ১০৮০ টাকায় থেমে থাকবে না।
ডিজেলের দাম
বাড়লে পরিবহন খরচও পাল্লা দিয়ে বাড়বে। বাসভাড়া বাড়বে, নয়তো বাসের সংখ্যা
কমবে। নিত্যপণ্যের দাম এখনই আকাশছোঁয়া, তখন তা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার
বাইরে চলে যাবে। কারণ, সরকার তখন আর জনতার কথা ভাববে না। কারা এই জনতা?
যাদের মাসের গড় আয় ৩০০০ টাকাও ছাড়ায় না, যারা এখনও ন্যায্যমূল্যের ট্রাকের
আশায় বসে থাকে। এরাই সেই ‘উলুখাগড়া’, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে যাদের প্রাণ
যায়।
চারিদিকে আলোচনা চলছে, প্যানেল বসছে, সবার একই অভিমত–আমেরিকা অংশ
নিলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিশ্চিত। রাশিয়া ইরানকে বেশি দূর এগোতে দেবে না।
ইসরায়েলের ওপর বিরতির চাপ আসবে। কিন্তু এই উলুখাগড়াদের কথা কেউ বলছে না,
বলবেও না।
হ্যাঁ, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়তো হবে না। কারণ, তা হলে সেটা হবে
পারমাণবিক যুদ্ধ। সব দেশ নিউক্লিয়ার অস্ত্র ছুড়লে পৃথিবী আর বাসযোগ্য থাকবে
না। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে না, কারণ হরমুজ ও বাব-আল-মান্দেব প্রণালী বন্ধ
হয়ে যাওয়ার চড়া মূল্য বিশ্বের কোনো ক্ষমতাশালী দেশই দিতে চাইবে না। রসিকতা
বা অ্যাডভেঞ্চার ততক্ষণই ভালো, যতক্ষণ তা সহ্যের সীমার মধ্যে থাকে। তৃতীয়
বিশ্বযুদ্ধ হবে না, কারণ যুদ্ধ করলে নোবেল পাওয়া যায় না, যুদ্ধ থামালে
পাওয়া যায়। আর ডনাল্ড ট্রাম্পের লক্ষ্য এখন একটাই–নোবেল শান্তি পুরস্কার!
কিন্তু
তারপরও অশান্তি বজায় থাকবে। তাহলেই তো অস্ত্র বিক্রি হবে, প্রতিরক্ষায়
বরাদ্দ বাড়বে, অস্ত্র গবেষণায় বিনিয়োগ হবে। অর্থনীতি টালমাটাল হবে। কারো
পারমাণবিক স্থাপনা গুঁড়িয়ে যাবে, কারো প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডারে আগুন
লাগবে, কারো তেলের খনিতে বিস্ফোরণ হবে, কারো গোয়েন্দা হেডকোয়ার্টারে হামলা
হবে। এভাবেই বজায় থাকবে ক্ষমতার ভারসাম্য। আর একটি-দুটি দেশ রাজার মতো
মাথার ওপর বসে থাকবে, অন্তর্যামীর মতো হাসবে। এই পুরোটাই যে ক্ষমতায় টিকে
থাকার এক জঘন্য ফর্মুলা!
ক্ষমতার অলিন্দে কী খেলা চলছে, তা নিয়ে মাথা না
ঘামিয়ে বরং আমরা নিজেদের প্রস্তুত করি। মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে এই কঠিন
লড়াইয়ে আমাদের বুঝি কোমর বেঁধে নামতে হবে। কারণ আমরা ভালো করেই জানি, কেবল
প্রতিশ্রুতিতে পেট ভরে না। আপাতত এই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে, আর অপেক্ষা
করতে হবে ভোটের দিনের জন্য। কিন্তু সত্যিই কি দেশে ভোট হবে? আর ভোট হলে তখন
নিশ্চিত সুরাহা মিলবে? আমাদের জীবন তো ‘থোর বড়ি খাড়া, আর খাড়া বড়ি থোর’
লঙ্কায় যে যায়, সেইই রাবণ হয়ে দেখা দেয়। তবে কি রাবণরাই কেবল লঙ্কায় যায়?
লেখক: কলামিস্ট