গান্ধীর ভাষায়
একটি পরিচিত শব্দ ফিরে ফিরে আসে, অহিংসা। রবীন্দ্রনাথের বাণীতে সেই শব্দটি,
আনন্দ। এইখানে তাঁদের পার্থক্য। আবার এখানেই তাঁদের মিলও বটে। অহিংসারও
মূলে আছে আত্মার যোগ। তাই থেকে আনন্দ। যে হেতু এঁদের জীবনের অভিজ্ঞতায় বহু
বৈসাদৃশ্য, একজনের কর্মের ধারা আশ্রম থেকে প্রবাহিত হয়েছে রাজনীতির দিকে,
অন্যজন রাজনীতিকে আশ্রমের বাইরে রাখতেই চেয়েছেন, চিন্তা করেছেন এঁরা নিজ
নিজ পথে স্বাধীনভাবে, সে জন্য এঁদের ধ্যানধারণায় অমিল অপ্রত্যাশিত নয়।
আশ্চর্য হতে হয় এঁদের চিন্তার সাদৃশ্যে। রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর চরিত্র ও
কণ্ঠস্বর স্বাতন্ত্র্যে চিহ্নিত। সত্যের উচ্চারণ স্বভাবত বৈচিত্র্যে বিধৃত।
কোথাও সাদৃশ্যের কোথাও বা পরিপূরকতায় গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও
কর্ম আমাদের পরম সম্পদ।
একটা মিল প্রথমেই চোখে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ও
গান্ধী দুজনেরই নির্বাচিত কর্মক্ষেত্র ছিল পল্লির প্রাঙ্গণে। সেইখানে তাঁরা
বিশ্বকে আহ্বান করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জন্ম সেই কলকাতা মহানগরীতে,
ভারতের তদানীন্তন রাজধানী এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর বলে
যার খ্যাতি ছিল সেইকালে। গান্ধী তাঁর প্রথম যৌবনের কয়েকটি বছর কাটিয়েছিলেন
লন্ডনে ও ভারতের পশ্চিমপ্রান্তের বৃহত্তম নগরে। অর্থাৎ, কলকাতা এবং
মুম্বাই যদি রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর প্রধান কর্মস্থান হতো তবে সেটা
স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু জীবনের ঠিক মধ্যবিন্দুতে এসে
রবীন্দ্রনাথ তাঁর আশ্রম ও কর্মক্ষেত্র হিসবে বেছে নিলেন শান্তিনিকেতন এবং
সুরুলের গ্রাম। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজসংগঠন নিয়ে বীরভূমের ওই পল্লি
পরিবেশে চলল চল্লিশ বৎসরব্যাপী তাঁর অক্লান্ত সাধনা। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে
স্থায়ীভাবে ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর গান্ধী তাঁর আশ্রম স্থাপন করলেন প্রথমে
সবরমতিতে, পরে সেবাগ্রামে। যদিও রাজনীতির স্বাভাবিক কেন্দ্র রাজধানী, তবু
গান্ধী তাঁর কর্মের কেন্দ্রকে প্রতিষ্ঠিত করলেন গ্রামে।
বাঙালি সমাজের
ভিত্তিতে চাই স্বনির্ভর গ্রাম, শহরের শোষণ থেকে গ্রামকে মুক্ত করতে হবে এবং
সেজন্য গ্রামবাসীর কাছে তুলে ধরতে হবে সমবায়ের পথ, এই কথাগুলো রবীন্দ্রনাথ
ও মহাত্মা গান্ধী দুজনের চিন্তাতেই সমানভাবে উপস্থিত। এটাকে তাঁরা
বলেছিলেন সত্যের পথ। সত্য শব্দটার বিশেষ ব্যবহার দুজনের লেখাতেই চোখে পড়ে।
ভারতবর্ষে সমবায়ের ‘বিশিষ্টতা’ বিষয়ে লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
“দারিদ্র্য হোক, অজ্ঞান হোক, মানুষ যে গভীর দুঃখ ভোগ করে তার মূল্যে সত্যের
ত্রুটি।” মানুষকে মানুষের কাছ থেকে যা কিছু বিচ্ছিন্ন রাখে তাতে পূর্ণ
সত্য নেই। সেই দৃষ্টি সত্যদৃষ্টি যার সাহায্যে বিচ্ছিন্ন মানুষ বৃহত্তর
যোগের ভিতর দিয়ে সার্থকতা অর্জন করতে পারে।
১৯২০ সালের কাছাকাছি
বছরগুলোতে গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে একটা
বিশেষ কারণে। আসলে ওই সময়ে তাঁদের কর্মক্ষেত্রের ভিন্নতাই বিপরীতদিকে
দুজনকে আকর্ষণ করেছিল। গান্ধী তখন দেশকে প্রস্তত করছেন বিদেশি শাসনের
বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের জন্য। আর রবীন্দ্রনাথ তখন তৈরি হচ্ছেন এমন একটি
বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য যেখানে ভারত এবং বিশ্ব একটা অবারিত আতিথ্যের
মধ্যে মিলিত হতে পারবে। গান্ধী-রবীন্দ্রনাথের তৎকালীন মতভেদের ভিতর বিশুদ্ধ
নীতির দ্বন্দ্ব খুঁজতে গেলে একটু ভুল থেকে যায়, পরিস্থিতিগত পার্থক্যটাও
বিবেচনার ভিতর রাখা আবশ্যক।
বিজ্ঞান ভাবনার ক্ষেত্রেও এই দুই সার্থক
মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ বারবার
বিজ্ঞানশিক্ষার উপর জোর দিয়েছেন। ‘পল্লীপ্রকৃতি’তে তিনি বলছেন, “বিজ্ঞান
মানুষকে মহাশক্তি দিয়েছে। সেই শক্তি যখন সমস্ত সমাজের হয়ে কাজ করবে তখনই
সত্যযুগ আসবে।” লোকশিক্ষা গ্রন্থমালার বিজ্ঞপ্তিতে তিনি লিখেছিলেন :
“বুদ্ধিকে মোহমুক্ত ও সতর্ক করার জন্য প্রধান প্রয়োজন বিজ্ঞানচর্চার।” দুটি
কথা লক্ষ করার মতো। এদেশের মানুষের মনে এমন অনেক কুসংস্কার আছে যার ফলে
একদিকে আসে মিথ্যা ভেদাভেদ, সামাজিক যোগসাধনের পথে যেটা বাধা, আর অন্যদিকে
মানুষ নানা দুর্বোধ দুর্বিপাকের ভয়ে অন্তরের তেজ হারিয়ে ফেলে। কৃষির
উন্নয়নের কাজে রবীন্দ্রনাথ আরও বুঝেছিলেন যে, উৎপাদনের নানা স্তরে। বিজ্ঞান
একই সঙ্গে মানুষকে নিয়মের দ্বারা শাসিত এবং আশার দ্বারা আশ্বস্ত করে।
এবার
গান্ধীর কথায় আসা যাক। আধুনিক বিজ্ঞানের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য
পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিকে ঝোঁক। গান্ধীর স্বভাবে ওই গুণটি ছিল। কোনো কথা যখন
তাঁর কাছে মূল্যবান মনে হয়েছে তখন তিনি সেটা নিয়ে বেশি দার্শনিক তর্কে না
গিয়ে সেটাকে প্রয়োগের দ্বারা পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছেন। বারবারই ছোটো-বড়ো
নানা ব্যাপারে এটা তাঁর জীবনে দেখা গেছে। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। রাসকিনের
বই, টহঃড় ঞযরং খধংঃ, পড়ে ভালো লাগল গান্ধীর। ঘটনাটি তিনি আত্মজীবনীতে
লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রথমেই বইটির প্রয়োগিক তাৎপর্য তিনি তিনটি সূত্রের আকারে
লিখে ফেললেন। তারপর বেশি বাক্যব্যয় না করে তিনি ওই চিন্তা কর্মে পরিণত
করতে উদ্যোগী হলেন। সংক্ষেপে তিনি লিখেছেন : ও ধৎড়ংব রিঃয ঃযব ফধহি, ৎবধফু
ঃড় ৎবফঁপব ঃযবংব ঢ়ৎরহপরঢ়ষবং ঃড় ঢ়ৎধপঃরপব,” এটা ছিল তাঁর জীবনের একটা বড়ো
পরীক্ষা। তাঁর সারা জীবন জুড়েই ছিল ছোটো-বড়ো আরও নানা পরীক্ষা।
একথা
বলা হয়েছে যে, গান্ধী ছিলেন যন্ত্রের বিরোধী। কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়, আবার
ভুলও নয়। তিনি নিজে বলেছেন, যন্ত্রের বিরোধী হব কী করে। মানুষের দেহটাই তো
হলো এক অতি সূক্ষ্ম যন্ত্র। তবে একথাও তিনি যোগ করেছেন, যন্ত্র যখন মানুষের
উপর চেপে বসে তখন আমি যন্ত্রের বিরোধী। এটাই গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গির মূল
কথা। রবীন্দ্রনাথও ছিলেন যান্ত্রিকতার বিরোধী। তবু এ ব্যাপারে দুজনের আবারও
ঝোঁকের একটা পার্থক্য আছে। আধুনিক যন্ত্র– বৃহৎ যন্ত্র ও বৃহৎ শিল্প– এমন
এক সমাজ তৈরি করতে চলেছে যেখানে ক্ষমতা কেন্দ্রীয়ভূত হচ্ছে নগরে,
ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানে, শাসনযন্ত্রে। এতে মানবিক সম্পর্কগুলো গুঁড়িয়ে
যাচ্ছে, মানুষ নিজেই হয়ে যাচ্ছে একটা যন্ত্র অথবা যন্ত্রের দাস। এ অবস্থায়
আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যাকে শুধু তার শক্তিতে মুগ্ধ হয়ে গ্রহণ করাটা মানুষের
কর্তব্য নয়, বরং মনুষ্যত্বের আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যন্ত্র ও
প্রযুক্তিকে নতুনভাবে নির্মাণ করাই জরুরি। গান্ধী এইভাবে চিন্তা করেছিলেন।
এই চিন্তা ক্রমশ প্রভাব বিস্তার করছে। এতদিন প্রযুক্তি এগিয়ে গেছে নিজ
অন্ধগতিতে, আর সমাজ নিজেকে বদলে নিয়েছে তারই সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। আজ কিছু
মানুষ প্রশ্ন তুলছেন, সমাজের আদর্শ কেন পাবে না অগ্রাধিকার? প্রযুক্তিকে
কেন নিয়ন্ত্রণ করা হবে না তারই সঙ্গে মিল রক্ষা করে? এই নতুন চিন্তায় আছে
গান্ধীর প্রভাব। তাঁর মূল চিন্তা ও আশঙ্কাকে আজ শুধু অতীতমুখী বলে সরিয়ে
রাখা যায় না।
জীবনযাত্রায় সরলতা ও সংযমের কথা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ
দুজনই বলেছেন। শান্তিনিকেতনের আশ্রম-জীবনে একদিন এইসব গুণের প্রশ্নাতীত
প্রাধান্য ছিল। এই শতাব্দীর প্রারম্ভে রবীন্দ্রনাথ ধর্মের সরল আদর্শ
ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, “ব্রহ্মকে পাইবার জন্য সোনা পাইবার মতো
চেষ্টা না করিয়া আলোক পাইবার মতো চেষ্টা করিতে হয়। সোনা পাইবার মতো চেষ্টা
করিতে গেলে নানা বিরোধ বিদ্বেষ-বাধাবিপত্তির প্রাদুর্ভাব হয়, আর আলোক
পাইবার মতো চেষ্টা করিলে সমস্ত সহজ-সরল হইয়া যায়।” বিশ বছর পর তাঁকেই বলতে
শুনি, “মানুষের মনে ধনভোগ করার ইচ্ছা আছে, সেই ইচ্ছাকে কৃত্রিম উপায়ে দলন
করে মেরে ফেলা যায় না। সেই ইচ্ছাকে বিরাটভাবে সার্থক করার দ্বারাই তাকে তার
সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করা যেতে পারে।” বলা বাহুল্য, আধুনিক যুগের আন্তরিক
বাসনার সঙ্গে এই দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটিরই সামঞ্জস্য বেশি। তবে মনে রাখা ভালো
যে, রবীন্দ্রনাথ এই উক্তিটি করেছিলেন সমবায়নীতি নিয়ে আলোচনার প্রসঙ্গে।
অর্থাৎ ধনীর নয়, দরিদ্র সমবায়ীর উন্নত জবিনযাত্রার ইচ্ছাটাকেই এখানে সমর্থন
করা হয়েছে।
দারিদ্র্যকে : গান্ধীও আদর্শ করে তোলেননি। তাঁর সেই
স্মরণীয় উক্তি উদ্ধৃত করার প্রয়োজনও হয় না, ক্ষুধার্তের কাছে ঈশ্বরও দেখা
দিতে পারেন শুধু অন্নদাতৃরূপে। তিনি সেই গ্রামই চেয়েছিলেন যেখানে সকলের
জন্য শ্রমের সুযোগ আছে, অন্নবস্ত্র আশ্রয় শিক্ষা ও আরোগ্যের উপায় আছে।
কিন্তু ভোগের বাসনার সপক্ষে কোনো উক্তি গান্ধীর লেখায় খুঁজে পাওয়া কঠিন
হবে।
গান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গিতে আবারও এখানে কিছুটা
ভিন্নতা দেখা যায়। আধুনিক প্রযুক্তি ও সভ্যতা মনুষের হাতে যে শক্তি দিয়েছে,
বাহ্যপ্রকৃতির উপর যে কর্তৃত্ব দিয়েছে, তার ফলে শক্তি নিয়ে
প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর অপরিমিত ভোগের ইচ্ছা বেড়ে চলেছে। ভোগের কোনো উপকরণই আর
মানুষকে স্থায়ীভাবে তৃপ্ত করে না, আরও নতুন উপকরণের জন্য শুরু হয়
কাড়াকাড়ি। গান্ধীর দৃষ্টিতে এটা আধুনিক সভ্যতার একটা বিষম ব্যাধি। ভোগের
বৃদ্ধির দ্বারা এর নিরাময় সম্ভব নয় সংযমের দ্বারাই সম্ভব। প্রেম এবং ভোগের
মধ্যে একটা বিরোধ আছে। ভোগের দৃষ্টিতে সবই উপকরণ; মানুষকে ভোগের দৃষ্টিতে
দেখতে সেও হয়ে ওঠে একটা উপকরণবিশেষ। সভ্যতা যখন ভোগের তৃষ্ণাকে প্রবল করে
তোলে তখন তাতে মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মার যোগ খর্ব হয়, ভালোবাসাও পরিণত
হয় পুণ্যে। তা ছাড়া পৃথিবীতে যতদিন দারিদ্র্য অবশিষ্ট আছে ততদিন প্রয়োজনের
অধিক ভোগের মধ্যে একটা কুশ্রীতাও আছে। এইসব কথা রবীন্দ্রনাথের কাছেও
গ্রাহ্য ছিল। কিন্তু গান্ধী তাঁর বাক্যে ও জীবনে এই কথাগুলো ব্যক্ত করেছেন
অনেক বেশি প্রবলতার সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ ভোগের বাসনাকে সংযুত করতে চেয়েছেন
প্রধানত সৌন্দর্যবোধের দ্বারা, গান্ধী নৈতিকতার দ্বারা। তবে গান্ধীর
নৈতিকতাও ছিল না শুষ্কনীতিবোধ, তার উৎস ছিল প্রেমের শক্তিতে।
এই
প্রেমের শক্তিতে বিশ্বাসের উচ্চারণে গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের ভিতর বিস্ময়জনক
মিল লক্ষ করা যায়। এক অবিশ্বাসী যুগের কাছে একই প্রত্যয় তাঁরা প্রকাশ
করেছেন প্রায় একই ভাষায়। হিংসা ও বিশ্বাসঘাতকতায় অভ্যস্ত মানুষকে তাঁরা
বলেছেন, সৃষ্টি যে আজও ধ্বংস হয়ে যায়নি, মানুষ যে বেঁচে আছে, এতে প্রমাণিত
হয় যে প্রেমের শক্তি পরাস্ত হয়নি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কথাটা শোনা যাক :ঞযব
ঢ়বৎঢ়বঃঁধষ ঢ়ৎড়পবংং ঃযধঃ রং মড়রহম ড়হ রহ ঃযব ড়িৎষফ ধৎড়ঁহফ ঁং রং ধ ংঃৎঁমমষব
ভড়ৎ ঃযব ারপঃড়ৎু ড়ভ ষড়াব...রভ ারপঃড়ৎু বিৎব হড়ঃ ধষধিুং নবরহম ধপযরবাবফ নু
মড়ড়ফহবংং ধহফ নবধঁঃু, ঃযবহ ষড়হম নবভড়ৎব ঃযরং, বাবৎুঃযরহম ড়িঁষফ যধাব নববহ
ফবাধংঃধঃবফ. ডব ধৎব ঃযবহ ভধপবফ রিঃয ঃযরং মৎবধঃ ভধপঃ ড়ভ ঃযব বীরংঃবহপব ড়ভ
ঃযব টহরাবৎংব. ঞযরং ড়হব ভধপঃ, ঃযধঃ ঃযবৎব রং ংঃরষষ ষরভব, ঢ়ৎড়াবং ঃযধঃ ষরভব
পধহ নব ধহফ রং ারপঃড়ৎরড়ঁং ড়াবৎ ফবধঃয...ঃযরং মৎবধঃ রফবধ ড়ভ ষড়াব, ধষধিুং
ভরমযঃরহম ঃযব ংরহ বি যধাব রহ ঃযব যবধৎঃ ড়ভ ড়ঁৎ যঁসধহরঃু, রং ঃযব ৎবধংড়হ যিু
বি ংযড়ঁষফ হড়ঃ ফবংঢ়ধরৎ ড়াবৎ ংরহ.”এই কথাগুলো রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন
আর্জেন্টিনাতে ১৯২৪ সালে। অপ্রেমের সঙ্গে সংগ্রাম চলেছে প্রেমের। বিশ্বের
অস্তিত্বই প্রমাণ করে যে মৃত্যু এখনও জয়ী হয়নি। এরই পাশে রাখা যাক গান্ধীর
কয়েকটি বাক্য : ঞযব ভধপঃ ঃযধঃ ঃযবৎব ধৎব ংড় সধহু সবহ ংঃরষষ ধষরাব রহ ঃযব
ড়িৎষফ ংযড়ংি ঃযধঃ রঃ রং নধংবং হড়ঃ ড়হ ঃযব ভড়ৎপব ড়ভ ধৎহং নঁঃ ড়হ ঃযব ভড়ৎপব
ড়ভ ঃৎঁঃয ড়ৎ ষড়াব. ঞযবৎবভড়ৎব, ঃযব মৎবধঃবংঃ ধহফ সড়ংঃ ঁহরসঢ়বধপযধনষব
বারফবহপব ড়ভ ঃযব ংঁপপবংং ড়ভ ঃযরং ভড়ৎপব রং ঃড় নব ভড়ঁহফ রহ ঃযব ভধপঃ ঃযধঃ,
রহ ংঢ়রঃব ড়ভ ঃযব ধিৎং ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ, রঃ ংঃরষষ ষরাবং ড়হ....খরঃঃষব য়ঁধৎৎবষং
ড়ভ সরষষড়হং ড়ভ ভধসরষরবং রহ ঃযবরৎ ফধরষু ষরাবং ফরংধঢ়ঢ়বধৎ নবভড়ৎব ঃযব
বীবৎপরংব ড়ভ ঃযরং ভড়ৎপব ....ঐরংঃৎড়ু ফড়বং হড়ঃ ধহফ পধহহড়ঃ ঃধশব হড়ঃব ড়ভ ঃযরং
ভধপঃ.”
এই শেষ বাক্যটি লক্ষ করার মতো। জগতে যত কলহ, রাজায় রাজায়
যুদ্ধ, জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ, সেই সব লিখিত থাকে ইতিবৃত্তে। যে স্নেহ,
প্রীতি, সহযোগিতা নিঃশব্দে মানুষের সমাজকে রক্ষ করে চলেছে তার ইতিহাস নেই,
হতে পারে না। কথাগুলো আছে গান্ধীর হিন্দ স্বরাজ-এ, রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী
সমাজ-এর বছর পাঁচেক পরেই যার রচনাকাল।
গান্ধীর এক প্রিয় শিষ্যা
রবীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, দুজনের ভিতর পার্থক্য কোথায়? সেটা ১৯২৯
সালের শেষ দিকের কথা। রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে উত্তর দিয়েছেন। তিনি লিখেছিলেন :
অপপড়ৎফরহম ঃড় ঃযব টঢ়ধহরংযধফ ঃযব ৎবপড়হপরষরঃরড়হ ড়ভ ঃযব পড়হঃৎধফরপঃরড়হ
নবঃবিবহ ঃধঢ়ধংুধ ধহফ ধহধহফধ রং ধঃ ঃযব ৎড়ড়ঃ ড়ভ পৎবধঃরড়হ-ধহফ গধযধঃসধলর রং
ঃযব ঢ়ৎড়ঢ়যবঃ ড়ভ ঃধঢ়ধংুধ ধহফ ও ধস ঃযব ঢ়ড়বঃ ড়ভ ধহধহফধ.”“প্রমের প্রকাশ কখনো
তপস্যায়, কখনো আনন্দে। এদের অভিন্ন বলা ভুল, এদের ঐক্য অস্বীকার করাও ভুল।
সত্যের এই দুই ভিন্ন প্রকাশ।
যদিও গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ পল্লিসংগঠনের
উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন তবু আদর্শ সমাজে নগরেরও প্রয়োজন আছে একথা
তাঁরা অস্বীকার করেননি। গান্ধী বলেছেন, ওহ সধু ঢ়রপঃঁৎব ড়ভ ঃযব ৎঁৎধষ
বপড়হড়সু ঃযব পরঃরবং ড়িঁষফ ঃধশব ঃযবরৎ হধঃঁৎধষ ঢ়ষধপব.” পল্লিভিত্তিক সমাজেও
নগরের একটা স্বাভাবিক স্থান থাকবে। রবীন্দ্রনাথের কথা, “আমি যখন ইচ্ছা করি
যে আমাদের দেশের গ্রামগুলি বেঁচে উঠুক, তখন কখনো ইচ্ছে করি নে যে,
গ্রাম্যতা ফিরে আসুক। গ্রাম্যতা হচ্ছে সেই রকম সংস্কার ...যা গ্রামসীমার
বাইরের সঙ্গে বিযুক্ত।”
বস্তুত নগরের পরিবেশে এমন কিছু চিন্তা ও আদর্শ
গড়ে উঠেছে যাকে প্রয়োজন মতো শোধন করে যত্নের সঙ্গে মানবজাতির ক্রমবর্ধমান
ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার আবশ্যক। এর কিছু পাওয়া যাবে বিজ্ঞান
শিক্ষায়, যার খানিকটা আলোচনা আগেই করা গেছে। আরও কিছু আছে
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধারণায়, যাকে স্বার্থসর্বস্বতা থেকে উদ্ধার করে
রক্ষা করা প্রয়োজন। ব্যক্তির ‘বহুমুখী সম্ভাবনা’ সম্বন্ধে নগরই আমাদের
বিশেষভাবে সচেতন করে তুলেছে। আমরা জেনেছি যে, মানুষের বৃত্তি অথবা
বিশ্বাসের জগতের সীমানা একান্তভাবে নির্ধারিত হয়ে যায় না জন্মসূত্রে। নিজের
অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে ব্যক্তিকে অর্জন করতে হয় তার স্বকীয় সত্যানুভূতি।
এইসব
কথা রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গিতেও খুঁজে পাওয়া যায় স্মরণীয় রূপে।
প্রথম যৌবনে রবীন্দ্রনাথকে আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করতে
হয়েছি। সে দায়িত্ব তিনি কিছুকাল যথাসাধ্য সুচারুভাবে পালন করেছিলেন।
কিন্তু এই দায়িত্ব পালনের ভিতর দিয়েই আবার তিনি নিজের অন্তঃপ্রকৃতির সঙ্গে
আরও গভীরভাবে পরিচিত হন। ক্রমেই তাঁর কাছে একথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কোনো
বাইরের ধর্ম তাঁর অন্তরের ধর্ম হতে পারে না। ব্যক্তি তাঁর নিজস্ব পথে
সত্যকে লাভ করে, সত্যোপলব্ধির অন্য কোনো যথার্থ উপায় নেই। শিল্পের ক্ষেত্রে
একই কথা। ঐতিহ্যশাসিত প্রাচীন সমাজে শিল্পীর প্রায়শ কোনো স্বতন্ত্র পরিচয়
ছিল না, শিল্পকর্ম ছিল ঐতিহ্যের একান্ত অনুবর্তী। রবীন্দ্রনাথের কাছে
কিন্তু শিল্পকর্ম সর্বোপরি শিল্পীর নিজস্ব ব্যক্তিত্বের প্রকাশ। ছবিটা
এবার এইভাবে তুলে ধরা যেতে পারে। সমাজের ভিত্তিতে থাকবে স্বায়ত্তশাসিত
গ্রাম। বিজ্ঞান ও সমবায়কে ভিত্তি করে তৈরি হবে গ্রামের আর্থিক উন্নয়নের পথ।
গ্রামের সঙ্গে যোগ থাকবে শহরের, কিন্তু সেই যোগ হবে না আধিপত্য ও অধীনতার,
শোষক ও শোষিতের। সেই যোগের ভিতর দিয়ে অবিরত চেষ্টা চলবে এক নতুন সমন্বয়ের।
গ্রামের ভিত্তিতে এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রত্যক্ষ হৃদয়ের যোগ।
দারিদ্র্যের মলিন স্পর্শ থেকে মুক্ত করে একে রক্ষা করতে হবে। শহরের
স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে বাঁচিয়ে গ্রহণ করতে হবে বিজ্ঞানের আগ্রহ আর
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মূল্য। একটা ঐক্যের মধ্যে এইসব উপাদানকে সংগ্রহ করা
কঠিন কাজ। কিন্তু এটাই গ্রামীন যুগের যথার্থ কাজ, তার ঐতিহাসিক ও
সাংস্কৃতিক দায়িত্ব।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মূল্য রবীন্দ্রনা স্বীকার
করেছিলেন প্রধানত শিল্পীর দৃষ্টি নিয়ে, আর গান্ধী বিবেকী মানুষের
বিচারবুদ্ধি নিয়ে। তাই রবীন্দ্রনাথের ‘একলা চলো রে’ গানটি ছিল গান্ধীর
একান্ত প্রিয়। সমাজের সেবা করা ব্যক্তির কর্তব্য। কিন্তু সেই সেবার পথ বেছে
নেবে ব্যক্তি নিজে। যদি সে পথ স্বেচ্ছায় নির্বাচিত না হয় তবে তার কোনো
নৈতিক মূল্যই নেই। ব্যক্তির স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়ে কোনো আদর্শ সমাজ
একেবারেই সম্ভব নয়। হরিজন পত্রিকার পাতায় তিনি দ্বিধাশূন্য ভাষায় বলেছিলেন,
ব্যক্তিস্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই। কথাটা তাঁর ভাষাতেই শোনা যাক : ওভ ঃযব
রহফরারফঁধষ পবধংবং ঃড় পড়ঁহঃ, যিধঃ রং ষবভঃ ড়ভ ংড়পরবঃু? ওহফরারফঁধষ ভৎববফড়স
ধষড়হপব পধহ সধশব ধ সধহ াড়ষঁহঃধৎরষু ংঁৎৎবহফবৎ যরসংবষভ পড়সঢ়ষবঃবষু ঃড় ঃযব
ংবৎারপব ড়ভ ংড়পরবঃু...ঘড় ংড়পরবঃু পধহ ঢ়ড়ংংরনষু নব নঁরষঃ ড়হ ধ ফবহরধষ ড়ভ
রহফরারফঁধষ ভৎববফড়স.”
ব্যক্তি তার বিবেকের অনুসরণ করবে। একজন্য যদি
তাকে সমাজের ঐকমত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয় তবে সেটাই হবে তার কর্তব্য। একই
সত্য কি তবে ভিন্ন ভিন্ন রূপে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছে দেখা দিতে পারে?
গান্ধীর উত্তরে আবারও কোনো দ্বিধা নেই। তিনি বলেছেন : উড়বং হড়ঃ মড়ফ ঐরসংবষভ
ধঢ়ঢ়বধৎ ঃড় ফরভভবৎবহঃ রহফরারফঁধষং রহ ফরভভবৎবহঃ ধংঢ়বপঃং?.... ঃযবৎব রং
হড়ঃযরহম ৎিড়হম রহ বাবৎুড়হব ভড়ষষড়রিহম ঞৎঁঃয ধপপড়ৎফরহম ঃড় যরং ষরমযঃং.
ওহফববফ রঃ রং যরং ফঁঃু ঃড় ফড় ংড়.”
আসল প্রশ্ন, সত্যের জন্য আমরা কতটা
মূল্য দিতে রাজি আছি? ব্যক্তির সততার সর্বশেষ পরিচয় তার বিদ্বেষমুক্ত
নির্ভীকতায়, তার দুঃখবরণের আগ্রহে। সর্ববিধ ভয় জয় করা ছিল গান্ধীর জীবনের
তপস্যা, যেমন জীর্ণতাকে জয় করাতেই ছিল রবীন্দ্রনাথের আনন্দ। এই দুই পথে
ঘটেছিল দুজনের ব্যক্তিত্বের আশ্চর্য উন্মোচন।
গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের
ভিতর বহুবার মতবিরোধ ঘটেছে। প্রতিবার তাঁদের ভিন্নতাকে তাঁরা প্রকাশ করেছেন
অকপটভাবে, সুস্পষ্ট ভাষায়, অথচ পরস্পরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রক্ষা করে।
এমন বিদ্বেষহীন বিরোধের উদাহরণ কোনো দেশেই বড়ো দেখা যায় না। নাগরিকতার
শ্রেষ্ঠ ফল যে-ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য তাকে রক্ষা করেই এঁরা গ্রামের সেবায়
আত্মনিয়োগ করেছিলেন। সমস্ত সাময়িক দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন
সত্যের প্রতি আগ্রহকে। এ আমাদের বিরল সৌভাগ্য যে, এঁদের আমরা পেয়েছিলাম একই
কূলে। তা নইলে সত্যের ভিন্নমুখী আহ্বানের এমন শোভন সহাবস্থান আমাদের দেখা
হতো না। যেখানে এঁরা ভিন্ন আর যেখানে অভিন্ন, দুয়ের ভিতর দিয়েই সত্যকে আমরা
পাই আরও সমগ্রভাবে।
আমৃত্যু রক্ষা করে গেছেন দুজনই মানুষের প্রতি
মৃত্যুহীন বিশ্বাস। গান্ধী বলেছিলেন–ঞযবৎব ধৎব পযড়ৎফং রহ বাবৎু যঁসধহ
যবধৎঃ. ওভ বি ড়হষু শহড়ি যড়ি ঃড় ংঃৎরশব ঃযব ৎরমযঃ পযড়ৎফ, বি নৎরহম ড়ঁঃ ঃযব
সঁংরপ.”
আর রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত উক্তির সঙ্গে তো আমরা সবাই
পরিচিত; “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারোনো পাপ।” এখানেও কথার সুরে একটু
পার্থক্য আছে। একজন যেন ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, তুমি বাজাতে শেখে।
অন্যজন বলছেন বিশ্বকে উদ্দেশ করে, শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ। শোনার
যোগ্য বাণী রেখে গেছেন দুজনই।