
অনেক দিন আগের একটি অতি ক্ষুদ্র ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ঘটনাটি ক্ষুদ্র হলেও বেশ একটু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বলতে হবে। উঠেছি অনায়াসে, কিন্তু প্রচণ্ড ভিড়, তাও জানা কথাই, ভিড়ে অভ্যস্ত ছিলাম, বাসে উঠে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকবর চেষ্টা করিনি। যত লোক বসার স্থান পেয়েছে তার চতুর্গুণ দাঁড়িয়ে আছে। মনে পড়ে গেল। আমার রূপদর্শীর জল্পনায় একবার বলেছিলাম বিআরটিসি বাসে নিত্য যাতায়াত করে ঢাকার লোকে আর কিছু না হোক, গোটা দুই-তিন স্টপ পার হওয়ার পরে একটি মেয়ে উঠল, বয়স কুড়ি-একুশের বেশি নয়, সপ্রতিভ চেহারা। দরজার পাশেই একটি বেঞ্চ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। সেখানে দুজন মহিলা বসে, পাশে একটি যুবক। মেয়েটি উঠতেই যুবকটি সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, বসুন। মেয়েটি বলল, আমি নয়, আমাকে দেখিয়ে বলল, উনি বসবেন। বলে ছেলেটির দিকে একটু তিরস্কারের দৃষ্টিতে তাকাল। ভাবটা যেন-উনি দাঁড়িয়ে থাকতে, আপনি বসুন। আমি ব্যস্ত হয়ে, বললাম, না, না, আমার দাঁড়িয়ে কোনো কষ্ট হয় না। যথেষ্ট অভ্যাস আছে। তুমি বসো। মেয়েটি হেসে বলল, তাই কি হয়? নাছোড়বান্দা মেয়ে– আমাকে বসতে হলো। আমি যে বেশ একটু অস্বস্তি বোধ করছি, মেয়েটি তা বুঝতে পেরেছে। বলল আপনি একটুও ভাববেন না, আমি আমার জায়গা করে নিচ্ছি। বলে, ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল মিনিট চার-পাঁচ পরে হঠাৎ নজরে এলো ভিড়ের ফাঁকে মেয়েটি হাত নেড়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। হাসিমুখে বলল, আমি বসেছি।
এইটুকুই ঘটনা, কিন্তু আমার মনে অনেক কথা ভিড় করে এসে গেল। ভাবছিলাম, এককালে সভ্য সমাজে শিভ্যালরি (পযরাধষৎু) নামে একটি গুণের মস্ত বড় একটা স্থান ছিল। শিভ্যালরি বলতে বোঝায় বীরের ব্রত। সে ব্রত পালন শুধু রণক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল না। শত্রু সংহার নয়, তাঁদের প্রধান কাজ ছিল বিপন্নের এবং অসহায়ের উদ্ধার বিশেষ করে বিপন্ন নারীর। অনুমান করা কিছুই কঠিন নয় যে এই ব্রতচারীরা সকলেই ছিলেন পুরুষ এবং বীরপুরুষ। মধ্যযুগে রাজা আর্থার বিপন্নের উদ্ধারকারী বীরকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করে তাঁর সুবিখ্যাত রাউন্ড টেবিল-এ বীরমণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত করে নিতেন। ঐ যুগকেই বলা হয়েছে শিভ্যালরির যুগ। পরবর্তী কালের সুসভ্য সমাজ শিভ্যালরিকে অনেক সহজ-সরল ঘরোয়া অর্থে গ্রহণ করেছে। ভেবেছে, নারী আর পূর্বের ন্যায় যত্রতত্র বিপদগ্রস্ত নয়, তবে নানাবিধ বিধিনিষেধের ফলে শশব্যস্ত। এ যুগের শিভ্যালরি নিষিদ্ধ জগতের দ্বার সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দিয়েছে, এমন নয়। শুধু বলেছে লেডিজ ফার্স্ট অর্থাৎ নারীর কথা সর্বাগ্রে বিবেচ্য, তার সুখ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দিতে হবে সর্বাগ্রে। অবাক হয়ে ভাবছিলাম, যে গুণ ছিল পুরুষের আচরণীয়, আজ তা প্রকাশ পেল একটি তরুণীর আচরণে। যে নারীর রক্ষার্থে শিভ্যালরি নামক বীর ব্রতের সৃষ্টি হয়েছিল সেই ব্রত আজ পালন করেছে নারী নিজেই পুরুষের কল্যাণার্থে।
তরুণীটির ব্যবহার নিঃসন্দেহে অতি সুন্দর তা হলেও বলতে হবে, এর ফল অবিমিশ্র শুভ নয়। শিভ্যালরি নামক গুণের চর্চাটি পুরুষের চরিত্র গঠনে অনেকখানি সহায়তা করেছে। নারী রক্ষায় ব্রতী হয়ে পুরুষকে একাধারে সৎসাহসী এবং সচ্চরিত্র হতে হয়েছে। আমাদের দেশে যে বলেছে, বীরভোগ্য নারী, তার অর্থ এই নয় যে নারীকে বাহুবলে অধিকার করতে হবে। এর অর্থ যিনি যথার্থ বীরপুরুষ একমাত্র তিনিই নারীর প্রেম লাভের যোগ্য। সে বীরত্ব প্রকাশের জন্য অস্ত্র ধারণ করতে হয় না; নিত্য দিনের সাধারণ কর্মে চিন্তায় তা প্রকাশ পায়। এখন লক্ষ করার বিষয় যে অবলা নারী সবলা হয়ে ওঠার দরুন পুরুষের শিভ্যালরি চর্চা অনাবশ্যক বিবেচিত হচ্ছে। এর ফলে পুরুষ চরিত্রে একটা শৈথিল্য এসেছে। এতে শুধু নারীর নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়, সমগ্র সমাজের শ্লীলতার মর্যাদা রক্ষা ছিল ব্রতচারী পুরুষদের লক্ষ্য। শিভ্যালরি সমাজে একটা রুচিবোধ এনে দিয়েছিল। এখন সেটি অন্তর্ধান করছে। নারী সম্পর্কে পুরুষের মনে একটা সমীহ ভাব ছিল। এক দল পুরুষ যেখানে উল্লাসে অধীর কিংবা তর্কিত উত্তেজনায় বেসামাল তখন একজন মহিলার আগমনে এক মুহূর্তে সমস্ত কলরব স্তব্ধ হতো। বেসামালরা নিজেদের সামলে নিয়ে সংযত হয়ে বসত। এখন মেয়েরাও সেই উল্লাস বা উত্তেজনার অংশীদার, কাজেই তাদের উপস্থিতিতে ছেলেরা সংযত ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন বোধ করে না। নারীর প্রতি সমীহ ভাবটা কমে যাওয়াতে পুরুষের আচার-আচরণে একটা যেনো স্থূলতা দেখা দিয়েছে। এক সময়ে নারীর অলক্ষ্য অবস্থানও সমাজের ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। পুরুষের রুচি রোচন আচরণ, শোভন সৌজন্য অনেকাংশে নারীর প্রভাব-জাত। আমি শিক্ষিত সমাজের কথাই বলছি। আজকে নারী আর অলক্ষ্যচারিণী নন। তথাপি বলতে হবে একদা অলক্ষ্যচারিণী রমণী পুরুষের মনে যতখানি রোমাঞ্চের সঞ্চার করতেন আজকের প্রকাশ্যচারিণী রমণীরা ততখানি কৌতূহলের উদ্রেক করেন না। নারী সম্পর্কে নির্বিকার ভাব পুরুষের পক্ষে স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়। মেয়েরা বহু ক্ষেত্রেই কৃতিত্বের পরিচয় দিচ্ছেন। ছেলেদের ডিঙিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে ছেলেরা বোধ করি একটু নিস্তেজ হয়ে পড়ছে, বোধ করি একটু রহভবৎরড়ৎরঃু পড়সঢ়ষবী বা হীনম্মন্য ভাব এসে যাচ্ছে। এটা আদৌ বাঞ্ছনীয় নয়। নারীর অগ্রযাত্রা যদি পুরুষের অধোগতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তা হলে সেটা হবে একটা মস্ত বড় ট্র্যাজেডি।
স্বামী-স্ত্রী যেমন হাত মিলিয়ে সংসার পরিচালনা করে, নারী-পুরুষ তেমন হাত মিলিয়ে সমস্ত সমাজ তথা সমগ্র দেশের পরিচালনার ভার গ্রহণ করবে। এটাই স্বাভাবিক, এর মধ্যে কোনো বিরোধ বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাব থাকার কথা নয়। কিন্তু পুরুষ শাসিত সমাজে নারীকে নানা ন্যায্য অধিকার থেকেই বঞ্চিত রাখা হয়েছে। সেজন্য একটা বিরোধের ভাব এসে গিয়েছে। মেয়েরা নানা অধিকার দাবি করছে; কিন্তু দাবিটা যদি করতে হয় পুরুষের কাছে তা হলে তো পুরুষের আধিপত্য মেনেই নেওয়া হলো। এটা দাবির প্রশ্ন নয়, অধিকার নিজ গুণে অর্জন কর নিতে হয়, প্রবন্ধের সূচনায় যে কাহিনিটি বলেছি তাতে দেখা গেল, নারী বা বৃদ্ধের প্রতি সহৃদয় আচরণ-শিভ্যালরি-একদা যা পুরুষের কর্তব্য বলে বিবেচিত হতো-পূর্বোক্ত মেয়েটি কত সহজে এবং শোভন ভঙ্গিতে সে কর্তব্য পালন করল। এর মধ্যে নারীর অগ্রগতি প্রমাণিত হয়েছে; এর জন্য নারী-আন্দোলনের প্রয়োজন হয় না। এ ব্যবহার অতি স্বাভাবিক সৌজন্য এবং শুভবুদ্ধির প্রকাশ মাত্র। একমাত্র শিক্ষাবিস্তারের দ্বারাই নারীসমাজে বিপ্লব ঘটতে পারে। নারী-আন্দোলনের কোনো প্রয়োজন নেই।
আন্দোলনের ফলে নারী এবং পুরুষ সর্ব ব্যাপারে সমকক্ষ, এটা প্রমাণ করার দিকে একটা ঝোঁক এসেছে। পুরুষ যা করতে পারে নারীও তাই করতে সক্ষম, এ কথা প্রমাণের জন্য নারীকে যদি এভারেস্ট শৃঙ্গে আরোহণ করতে হয় তা হলে বলতে হবে সেটা নিতান্তই গাণিতিক হিসাবে সমকক্ষতা প্রমাণের চেষ্টা। সমকক্ষতার প্রমাণ শারীরিক দক্ষতার ততখানি নয়, যতখানি মননশীলতার পরীক্ষায়। মাদাম কুরি ঘরে বসেই প্রমাণ করেছেন যে, তিনি আইনস্টাইন-এর সমপর্যায়ের, সমপঙ্ক্তির মানুষ। শওকত ওসমান এবং সুফিয়া কামাল সম্পন্ন প্রতিভার অধিকারী, কেউ কারও চাইতে কম নয়।
প্রকৃতপক্ষে নারী পুরুষ সমকক্ষ নয়, তারা সমব্রর্তী-সমাজের সংরক্ষণ উভয়ের মিলিত ব্রত। সে ব্রত পালনে কোনো বিরোধের স্থান নেই। বিরোধ ঘটলে সমাজে বিশৃঙ্খলতা দেখা দেবে। আর এ কথাও মেনে নিতে হবে যে নারী-পুরুষ সমতা নেই, অসমতা আছে এবং সেই অসমতাই একের প্রতি অপরের আকর্ষণ বাড়িয়েছে। জোর করে সে অসমতা দূর করার চেষ্টা বৃথা। নারী হৃদয়ের রহস্য পুরুষ পুরোপুরি জানে না, কবির ভাষায় বলতে গেলে– কিছু তার দেখি আভা, কিছু পাই অনুমানে, কিছু তার বুঝি না বা। আবার পুরুষের জগৎটাকেও নারী পুরোপুরি চেনে না। এই চেনা-অচেনার মিলনই নারী পুরুষের জীবনকে মধুময়, মোহময় করেছে। গধহ রং সধহ, ড়িসধহ রং ড়িসধহ, ুবৎ ঃযব ঃধিরহ ংযধষষ সববঃ ধহফ সববঃ ভড়ৎ বাবৎ.
ছেলেদের মেয়েলিপনা যেমন অত্যন্ত বিরক্তিকর, মেয়েদের পুরুষালি ভাবও তেমনি পীড়াদায়ক। নারী তবে আপন মর্যাদা এবং মহিমাকে অক্ষুণ্ন রেখেই পুরুষের একচেটিয়া সকল অধিকারেরই অংশভাগী হতে পারে; কিন্তু নারীত্বকে খর্ব করে নয়। বরং বলব মেয়েরা যোগদান করাতে ঐ খেলার মানমর্যাদা অনেকখানি বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু মেয়েদের ফুটবল খেলাটা কারও কাছেই খুব মানানসই মনে হবে না। যা যাকে মানায় তাই মানানসই। সকল জিনিস সকলকে মানায় না বিক্রম প্রকাশের অধিকার মেয়েদেরও আছে, কিন্তু বলবিক্রম বলতে আমরা যা বুঝি, নারীর বিক্রম ঠিক তা নয়। পুরুষের মনে নারী আপন স্বভাব গুণে যে সম্ভ্রমের উদ্রেক করে তাতেই তার বিক্রমের প্রকাশ। পুরুষের শ্রেষ্ঠ গুণ তার পৌরুষ। রমণীর শ্রেষ্ঠ গুণ তার রমণীয়তা। নিজ নিজ গুণ দুজনকেই সর্ব সযত্নে রক্ষা করতে হবে। সমকক্ষতার প্রতিযোগিতায় রমণীয় রমণীয়তা তিলমাত্র যদি খোয়া যায় তা হলে সেটাই হবে এক বিষম পরাজয়। রবীন্দ্রনাথ আধুনিকাকে পরিহাস করে বলেছিলেন-শুনেছিনু নাকি মোটরের তেল/পথের মাঝেই করেছিল ফেল/তবু তুমি গাড়ি ধরেছ দৌড়ে-/হেন বীর নারী আছে কি গৌড়ে-। আছে বৈকি, আছে, অনেক আছে। তবে না থাকলেই ভালো হতো- বঙ্গ ললনার লালিত্য বজায় থাকতো। শুধু গাড়ি ধরা নয়, মেয়েরা এখন আকাশের চাঁদ ধরতে পারে। চন্দ্রলোকে, মঙ্গলগ্রহে অভিযানের জন্য প্রস্তুত, মরু বিজয়ের কেতন উড়ছে নারী হস্তে। সোজা কথায়, পুরুষ যা পারে নারীও তা পারে। কোনো কিছুই নারীর ক্ষমতার অতীত নয়।
তা হলেও বলব, কী পারে আর কী পারে না তাই দিয়ে যে মানুষের গুণাগুণ বিচার, এও এক ভ্রান্ত রীতি, এক ধরনের কুসংস্কারই বলা চলে। চুরি-জোচ্চুরি করতে পারে না, ঘুস নিতে পারে না, তহবিল তছরুপের কলাকৌশল আয়ত্ত করেনি-এসব অক্ষমতা কি দোষাবহ না গুণের পরিচায়ক? অক্ষমতার মধ্যেও ক্ষমতা প্রকাশ পায়। সে কথাটা ভুললে চলবে না। বিধাতা যে নারীকে সবলা না করে অবলা করেছেন, সেটাকে আমি খুব একটা অবিবেচনার কাজ বলে মনে করি না। সব দিক ভেবেচিন্তেই করেছেন। নারী-পুরুষ কাউকেই কোনো অধিকার থেকে বঞ্চিত করেননি। খুব আলগোছে বলেছেন, যার যার স্বভাব মেনে চলবে। মেয়েরা স্বভাববশে লজ্জাবতী, অবশ্য তাই বলে পুরুষকে বলেননি, তোমরা নির্লজ্জ হবে। তাকেও বে-মানান কিছু করলে চলবে না। সমাজসেবায়, দেশসেবায় নারী-পুরুষ হাত মিলিয়ে কাজ করবে, কিন্তু মহিলাদের মনে রাখতে হবে যে তাদের গলায় গান যতখানি শ্রুতিমধুর, সেøাগান ততখানি নয়। রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শনকারী ছেলেমেয়েরা হাত-পা ছুড়ে যেভাবে সমস্বরে চ্যোঁচায় তাতে শোভাযাত্রায় শোভা বৃদ্ধি পায় বলে মনে হয় না। ব্যাপারটা চোখে একটু অস্বাভাবিক এবং অশোভন ঠেকে। তেজ-বীর্য মেয়েদের পক্ষে বেমানান নয়; তবে পুরুষ-সুলভ বল-বীর্য নারীর মাধুর্য হরণ করে। আবার পুরুষকেও মনে রাখতে হবে, লজ্জা যেমন নারীর ভূষণ, বীরত্ব তেমনি পুরুষের ভূষণ। কিন্তু বীরত্ব এবং হিংস্রতা এক জিনিস নয়। আমাদের স্বদল-বৎসল কেড়ারবাহিনী অবলীলাক্রমে যে খুনখারাপি করে বেড়াচ্ছে, তাকে বীরত্ব বলে না, তার নাম পশুত্ব। পুরুষ সেখানে পশুতে পরিণত হচ্ছে। মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে নারীর নারীত্বের হানি ঘটে, পুরুষের পৌরুষের। খুব দুঃখের কথা যে শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর সর্বত্র বীরত্ব আর বর্বরতায় ব্যবধান কমে যাচ্ছে। আমার তো অনেক সময় মনে হয় বিধাতা যখন আদি মানব আদমকে সৃষ্টি করেন তখনও সৃষ্টির পরে মানব সন্তানটিকে দেখে বিধাতার নিজেরই ঠিক মন ওঠেনি। দেখতে সুদর্শন নয়, চালচলন, আচার-আচরণও বড় সুরুচিসম্মত নয়-ইংরেজিতে যাকে বলে পষঁসংু. বিধাতা ভাবলেন, মানব সন্তান সৃষ্টির কাজে নতুন করে আবার হাত লাগাবেন। খ্রিষ্টান পুরাণ কাহিনি মতে আদমের দেহ থেকেই কিছু হাড়গোড় মাংসপিণ্ড বের করে নিয়ে বিধাতা দ্বিতীয় মানব সন্তান ঈভ-এর সৃষ্টি করলেন। গড়নে বরণে মরমে সেই অপূর্ব সৃষ্টি দেখা দিল রমণী মূর্তি ধারণা করে। দেখে সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং চমৎকৃত; যেমনটি চেয়েছিলেন ঠিক তেমনিট। নিত্য দিনের একটি সঙ্গী পেয়ে আদম উল্লসিত। তার ওপরে নিজ দেহ থেকে হাড়মাংসের ভার কমে যাওয়াতে তার ধ্যাবড়া চেহারাটায় যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে, সে এখন সুপুরুষ। বিধাতার দুই সন্তান- মানব মানবী, দুজন একই অঙ্গের অংশভাগী। আমাদের ভাষায় যে অর্ধাঙ্গিনী কথাটি আছে তাতে মনে হয় আমাদের প্রাচীনেরাও কোনো সময়ে হয়তো এভাবে ভেবে থাকবেন। তা যেমনই হোক, আমি ভাবছি ইংরেজ অতি সুচতুর জাতি। সে অর্ধাঙ্গিনীর মন রাখার জন্য মিষ্টি করে বলেছে- ঃযব নবঃঃবৎ যধষভ আমাদের বুদ্ধিতে অতখানি কুলোয়নি; আমরা বোকার মতো ভাগ করেছি সবলে আর দুর্বলে। মেয়েদের অবলা আখ্যা দিয়ে অচল করে রেখেছি।
বাঙালিদের দোষ দিলে কী হবে, স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই তাঁর নারীরূপিণী দ্বিতীয় সন্তানটিকে অবলা হিসেবেই দেখেছেন। আদমকে মজবুত হাড়, পেশি সংবলিত একটি বলবান মনুষ্যরূপে গড়েছিলেন। সে মাটি খুঁড়বে, গাছে চড়বে, ফল পাড়বে, কাঠ কাটবে, বনেবাদাড়ে পশু-পাখি শিকার করবে। এক কথায় সে হবে করিৎকর্মা পুরুষ। পরে যখন দ্বিতীয় মনুষ্য মূর্তিটি গড়তে বসলেন তখন পূর্ব পরিকল্পনাটি পরিত্যাগ করে অতি কোমল হস্তে যে তিলোত্তমাটির সৃষ্টি করলেন, তার বেলায় ভাবলেন, একে কিছুই করতে হবে না, কিছু না করলেই ওকে মানাবে ভালো। সে তার রূপলাবণ্য নিয়ে চলবে- ফিরবে, মিষ্টি করে কথা বলবে, ইচ্ছে করে তো গান করবে, চতুর্দিকে সৌন্দর্য মাধুর্য বিকীর্ণ করবে। এর চাইতে বড় কাজ আর কী হতে পারে? বিশেষ করে লাভবান হলো আদম। সারাক্ষণ মোটা রকমের কাজকর্ম নিয়ে থাকত ব্যস্ত; এই প্রথম সুন্দরের মধুরের স্বাদ পেল। আদমের স্থূল মনে রুচিবোধ এলো ঈভ প্রথমাবধিই তিলোত্তমা, তার সংস্পর্শে এসে আদম হলো পালঙ্ক পুরুষ। কিন্তু ঐ যে বলেছি, ঈভ কিছু না করেও সমস্ত পরিবেশকে শ্রীমণ্ডিত করেছে, সেটা যেমন সত্য, অপর দিকে তেমনি আবার সমস্যারও সৃষ্টি হয়েছে। হাতে যদি কাজ না থাকে তা হলে মাথায় কু-বুদ্ধি এসে জোটে।
বিধাতার সমস্ত পরিকল্পনা বাচনাল করার সুযোগ খুঁজছিল তাঁর পরম শত্রু স্যাটান। সে উদ্দেশ্যে হাত করার চেষ্টা করেছে দুই মানব সন্তানকে। ওদের কানে ক্রমাগত মন্ত্র জপিয়েছে, সৃষ্টিকর্তা নানাভাবে তোমাদের বঞ্চিত করছেন, কত রকম বিধিনিষেধ আরোপ করছেন। এই তো দেখ না, নন্দনকাননের সবচেয়ে নামজাদা যে বৃক্ষটি-জ্ঞানবৃক্ষ, তার ফল আস্বাদনের লোভ প্রবল হয়ে দেখা দিল ঈভ-এর মনে। আদমকে দিয়ে স্বয়ং স্যাটান যা করাতে পারেনি, তাই করিয়ে নিল ঈভ। ঈভ-এর প্ররোচনায় আদমকে জ্ঞানবৃক্ষে আরোহণ করে নিষিদ্ধ ফল সংগ্রহ করতে হলো। ফল আস্বাদন করল দুজনে মিলে, তৃপ্তি পেল, জ্ঞান লাভও কিঞ্চিৎ হলো। জ্ঞান লাভ মাত্র তন্মুহূর্তে যে ফল হলো তার নাম লজ্জাবোধ, অপরাধবোধ। তা হলে লক্ষ করার বিষয় যে জ্ঞান লাভ করে মনুষ্য সন্তান এই প্রথম লজ্জিত বোধ করল এবং নিজেকে অপরাধী জ্ঞান করল। তাই যদি হয় তা হলে বলতে হবে, বিধাতার মতলবটিও বড় উঁচুদরের ছিল না। মনে হয়, তিনি চেয়েছিলেন, মনুষ্য সন্তান দুটি একটু যেন হাবাগোবাই থাকে। প্রয়োজনের অধিক জানা-বোঝাটা তাঁর আদৌ পছন্দ হয়নি। তার ওপরে বিধাতার শাসন একেবারে ডিক্টোটারি শাসন। তাঁর আদেশ লঙ্ঘন করা অমার্জনীয় অপরাধ। স্বর্গবাসের অযোগ্য বিবেচনায় মানব সন্তানদ্বয়কে স্বর্গ থেকে বহিষ্কৃত করা হলো। বিধাতার মনে সন্তানের প্রতি একটু বোধ করি মমতা ছিল, তাই নরকে না পাঠিয়ে মর্ত্যলোকে নির্বাসিত করলেন। আদম অতি সবলচিত্ত মানুষ, একটু হাবাগোবাই বলা চলে। অভাবনীয় দুর্ঘটনায় সে দুঃখিত। মনে মনে সে ঈভকে দোষী সাব্যস্ত করছে। যেন তার প্ররোচনাতেই কাণ্ডটি ঘটেছে। সবকিছুর মূলে যে স্যাটান সে কথা এরই মধ্যে সে ভুলেছে। অবশ্য ভুলেছে বললে ঠিক বলা হয় না, আসলকথা, ভাবছে স্যাটান-এর কথা সে অগ্রাহ্য করতে পারত কিন্তু ঈভ-এর কথা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা তার ছিল না। এখানে দুটি জিনিস লক্ষণীয়। পুরুষ অনেক সময় আপন দুর্বলতাজাত কৃতকর্মের জন্য নারীকে দায়ী করে। অপরটি আরও গুরুতর, আদম বা পুরুষ যেন বলতে চাইছে, নারীর কাছে স্যাটান কোথায় লাগে! পূর্বদেশিয়রা তো বলেই রেখেছে, নারী মর্ত্যলোকস্য দ্বারী-নারীর দোষেই স্বর্গলোক ছেড়ে মর্ত্যলোকে আসতে হয়েছে। নারীনিন্দায় কেবল বাঙালিরাই মুখর এমন নয়, পশ্চিমীরা সে ব্যাপারে কিছু কম জানে না। বীরচূড়ামণি স্যামসন-এর কাহিনিতে দেখা যায় নারীই পুরুষের শক্তি হরণকারিণী। স্যামসন-পত্নী ডেলাইলা বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে পঙ্গু করে দিয়ে শত্রু হস্তে অর্পণ করেছিল।
যা হোক, আদমের কাহিনিটিই বিশেষভাবে বিবেচ্য। বিধাতার আদেশ লঙ্ঘন করার স্পর্ধা-র কারণে স্বর্গ থেকে নির্বাসন। আপাতদৃষ্টিতে অমার্জনীয় অপরাধ মনে হতে পারে কিন্তু ধীরভাবে ভেবে দেখলে বোঝা যাবে যে আদম এবং ঈভ অসম সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। জ্ঞানবৃক্ষের ফল ভক্ষণ করে তাঁরাই ভবিষ্যৎ মানবের জন্য জ্ঞানের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। তাঁরা নিঃসন্দেহে সকল মানুষের অশেষ কৃতজ্ঞতার পাত্র। এই সঙ্গে মনে পড়েছে খ্রিষ্টান পুরাণের বহু পূর্বে গ্রিক পুরাণের কাহিনিতে প্রমিথিয়ুস দেবতাদের ফাঁকি দিয়ে স্বর্গ থেকে অগ্নি সংগ্রহ করে এনেছিলেন। অগ্নির ব্যবহার মানব সভ্যতার অন্যতম প্রধান সোপান এই অপরাধের জন্য প্রমিথিয়ুসকে স্বর্গরাজ জিউসের হাতে সুদীর্ঘকাল কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল। মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রমিথিয়ুস মস্ত বড় হিরো হিসেবে স্থান পেয়েছেন। তা হলে জ্ঞানের দ্বার যাঁরা উন্মুক্ত করে দিলেন সেই আদম এবং ঈভকে কেন হিরো এবং হিরোইন হিসেবে দেখা হবে না আমি তা বুঝতে পারি না।
এই সূত্রে আরেকটি কথাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রমিথিয়ুস এবং আদম উভয়ে একই অপরাধে অপরাধী। দুজনেই দেব-বিদ্রোহী দেবতাকে অগ্রাহ্য করেছেন। দুজনকেই দণ্ডভোগ করতে হয়েছে। দেখা যাচ্ছে দণ্ডদাতাদের দণ্ডদানের রীতি দ্বিবিধ। গ্রিক স্বর্গরাজ জিউস মনে হয় অতিশয় প্রতিহিংসাপরায়ণ। স্বর্গের অগ্নিহরণকারীকে সুদীর্ঘকাল বান্দি রেখে কঠোরতম শাস্তিবিধান করেছিলেন। অপর দিকে খ্রিষ্টান বিধাতা, আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, আদম-ঈভকে অতি অল্পতেই রেহাই দিয়েছেন- স্বর্গ থেকে বহিষ্কার করেই ক্ষান্ত। আসলে কিন্তু বিধাতাপুরুষও বড় সহজ পাত্র নন। আপন মনে ক্রূর হাসি হেসে বলেছেন– দুদিন যাক্, বাছাধনরা টেরটি পাবেন। নিষিদ্ধ ফলের স্বাদটি পেয়েছ, এখন তার ঠেলা সামলাতে প্রাণিট যাবে, দেখে নিয়ো। জ্ঞানবৃক্ষের ফল জ্ঞানীর জন্য। মূর্খ তা হজম করতে পারে না। বদহজমের ফল হবে মারাত্মক। জ্ঞানবৃক্ষ বিষবৃক্ষ হয়ে দেখা দেবে। দেখতেই পাচ্ছি মর্ত্যলোকে এসেই মানুষ মারতে আর মরতে শিখেছে। এখন সারা দুনিয়া জুড়ে যে মরণলীলা চলেছে তাতে মর্ত্যভূমি হয়েছে বধ্যভূমি। এখন সেই কু-পরামর্শদাতা স্যাটান হয়েছে মানুষের সর্বক্ষণের সঙ্গী। তার পরামর্শ মতোই চলছে। স্বীকার করতে হবে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় তার নিরলস প্রয়াস। কিন্তু স্যাটান তার বুদ্ধি দিয়েছে গুলিয়ে। কাজ করে এক উদ্দেশ্য নিয়ে, ফল হয় তার বিপরীত। অদৃষ্টের পরিহাস বলতে হবে, জ্ঞানচর্চায় জ্ঞান যত বাড়ছে মানুষ তত বেশি দুর্দান্ত হয়ে উঠছে। বিধাতার সৃষ্টি মানব হয়েছে স্যাটান-এর হাতে গড়া দানব। আসল কথা, আমরা যাকে জ্ঞানচর্চা বলছি, সেটা প্রকৃতপক্ষে বিদ্যার্চ্যা। জ্ঞান আর বিদ্যা এক নয়। বিদ্যার মধ্যে অনেক ফাঁক, অনেক ফাঁকি। ফাঁকি দিয়ে কোনো মহৎ কর্ম সিদ্ধ হয় না। সেজন্য তথাকথিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় মানুষ জ্ঞানী হয়নি, বিজ্ঞ হয়েছে। বিকৃত জ্ঞান সম্পন্ন মানুষকেই বলে বিজ্ঞ। যা কিছু শিখেছে, জেনেছে তারই অপপ্রয়োগ হচ্ছে। অর্জিত জ্ঞানের ওপর তার কোনো কর্তৃত্ব নেই। জ্ঞানবৃক্ষের ফল অ-জ্ঞানের মতো ব্যবহার করছে। নির্বোধের জ্ঞান আত্মঘাতী। জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেলে কী হবে বুদ্ধির্যস্য ফলং তস্য, নির্বুদ্ধেস্তুু কুতো ফলম্। পৃথিবীময় আজ অশান্তি, মারামারি, হানাহানি। ক্রমাগত হিংসার চর্চা করে এখন মানুষ হয়েছে পৃথিবীর হিংস্রতম জীব। বোঝেনি যে জ্ঞানবৃক্ষের ফল চিবিয়ে কিংবা গিলে খাওয়া যায় না। সে ফল মন দিয়ে চেকে খেতে হয় অর্থাৎ তাকে অন্তরে গ্রহণ করতে হয়, হৃদয়ঙ্গম করতে হয়। তা না হলে জ্ঞানীর পক্ষে যা খাদ্য, মূর্খের পক্ষে তা বিষ হয়ে দেখা দেয়। বলেছি তো, জ্ঞানবৃক্ষ হয়েছে বিষবৃক্ষ।
কথায় কথায় দূরে চলে এসেছি। আলোচনার বিষয় ছিল নারী এবং পুরুষের দ্বন্দ্ব। এখন সেখানে ফিরে গিয়ে বক্তব্য শেষ করতে হবে। ভাবলে খুব অবাক হতে হয় যে শিক্ষিত সমাজেও বহু প্রচলিত ধ্যানধারণা এখনও বাসা বেঁধে আছে। এই যে সর্বক্ষণ সর্বক্ষেত্রে নারীর জয়জয়কার দেখেশুনেই বলছি নারী অবলা, বঞ্চিতা-এটি এক অতি অবাস্তব কথা, একটি আধুনিক কুসংস্কারও বলা যেতে পারে। আমি তো বলি, নারী জন্মাবধি সবলা। স্বর্গরাজ্যে প্রথম মানব সন্তান-পুরুষটি বড় উত্তম পুরুষ ছিল না। সে ছিল ভীরু, দুর্বলচিত্ত। বিধাতার আদেশ লঙ্ঘন করার মতো মনের বল কখনো তার হতো না। বর দিয়েছে সবল নারী ঈভ। বুদ্ধিবলেই সে সবলা। প্রমাণ করে দিয়েছে যে নারীর শাসনের কাছে বিধাতার অনুশাসনও টেকে না। নির্বাসনের পরে মর্ত্যভূমিতে এসে নারী একটু বেকায়দায় পড়েছিল। বুদ্ধিবল থাকলেও তার দৈহিক বল ছিল না। স্বর্গরাজ্যে দেব-দেবীরা ছিলেন তাদের প্রতিবেশী। মর্ত্যলোকে এসে সেই নিরাপত্তা হারাল। এখানে প্রতিবেশী জুটেছে বাঘ, ভালুক, জন্তুজানোয়ার। এদের ভয়ে নারীকে জোয়ান পুরুষের ওপরে নির্ভর করতে হলো। এই প্রথম নারী নিজেকে অবলা ভাবল। পুরুষ তার পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে। জ্ঞানবৃক্ষের ফল ভক্ষক এখন হলো নারীর রক্ষক। এ দিকে লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে যখন মনুষ্য প্রতিবেশীর সংখ্যা বাড়তে লাগল তখন দেখা গেল এসব প্রতিবেশীরাও বাঘ -ভালুকের চাইতে কিছু কম ভয়াবহ নয়। নারী রক্ষার জন্য নতুন নতুন বিধিনিষেধ আরোপিত হতে লাগল। নারী গৃহবান্দি হলো। কিন্তু গৃহবান্দি হলেও পুরুষ নারীর শক্তি হরণ করতে পারেনি। পুরুষের রাজ্য সদরে, নারীর অন্দরে। বহির্বাটিতে পুরুষের শক্তি প্রতিপত্তি যতই থাক অন্দরমহলের সম্রাজ্ঞী নারী। প্রতাপান্বিত পুরুষ সেখানে একান্ত অনুগত অনুচর। কাজেই পুরুষের দ্বারা নারী নির্যাতন। এটা একটা ভ্রান্ত ধারণা। নারীশাসিত অন্দরমহলে পুরুষই বোধ করি একটু নির্যাতিত। ইদানীং সকল দেশেই পুরুষশাসিত বলে সমাজের নামে একটা দুর্নাম রটেছে। অথচ চোখের সামনে দেখছি তিনটি দেশ– বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কায় প্রধানমন্ত্রীরা মহিলা। ভারতের ইন্দিরা গান্ধীই সর্বপ্রথম পথ দেখিয়েছেন। তা হলেই দেখুন এশিয়া মহাদেশের মস্ত বড় একটা অঞ্চলে বেশ কিছুকাল ধরে পুরুষ প্রজারা প্রজাবৎসল নারীর শাসনেই বাস করছে। নারীসমাজ গর্ব বোধ করতে পারে কিন্তু পুরুষরা খুব সুখে-শান্তিতে আছে বলে মনে হয় না, একটু নির্যাতিত বলেই মনে হয়। যাক্, শাসনক্ষমতা বাদ দিয়েও জীবনের সকল ক্ষেত্রেই নারী আজ প্রাধান্য বিস্তার করেছে এবং পুরুষকে রীতিমতো কোণঠাসা করেছে। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ওকালতি, ব্যারিস্টারি, জজিয়তি-কোনো কিছুতেই পিছিয়ে নেই। সর্বত্র পুরুষের সঙ্গে সমানে পাঞ্জা লড়ছে। এখন নারীসমাজেরই উচিত ঘোষণা করা যে তাঁরা স্বাধিকার রক্ষায় সম্পূর্ণ সক্ষম, পুরুষের ওপরে বিন্দুমাত্র নির্ভরশীল নন। কোনো অধিকার থেকে কেউ তাঁদের বঞ্চিত রাখতে পারবে না। কারও কাছে অধিকার চাইতে যাবেন না, ন্যায্য অধিকার কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা তাঁদের আছে। কেউ যদি তাতে বাধা দিতে আসে তা হলে সম্মুখসমরে তার নিষ্পত্তি হবে। নারী-পুরুষের দ্বন্দ্ব এখন শুধু সমানে সমানে নয়, সেয়ানায় সেয়ানায়। বুজবলে এখনও অপেক্ষাকৃত অবলা, তবে সেদিকেও বলবিক্রম পূর্বাপেক্ষা অনেক বেড়েছে। আর কূটবুদ্ধিতে, পাড়াগেঁয়ে ভাষায় যাকে বলে, পুরুষকে এক হাটে কিনে আরেক হাটে বেচতে পারে। সেই প্রাচীন কালে মুনি-ঋষিরা দুজনের হাত মিলিয়ে দিয়ে অতি মোলায়েম ভাষায় বলতে শিখিয়েছিলেন- আমার হৃদয় তোমার হউক, তোমার হৃদয় আমার। এখন সাদামাটা বাংলায় তার মানে হয়েছে-আমার মতলব তোমার হউক, তোমার মতলব আমার।