নিজস্ব প্রতিবেদক: কুমিল্লার রসমালাইসহ দেশের চারটি পণ্য সর্বশেষ জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। নতুন জিআই স্বীকৃতি পাওয়া অন্য তিন পণ্য হলো টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা এবং বাংলাদেশ ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল। এ নিয়ে ২০২৩ সালে ১০ পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেল। ডিপিডিটি কোনো পণ্যের জিআই স্বীকৃতি দেয়।
ডিপিডিটির মহাপরিচালক মো. মুনিম হাসান বলেন, ‘নতুন চার পণ্যের মাধ্যমে এখন দেশের ২১টি পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেল। আরও অন্তত ১১টি পণ্য এখন আমাদের বিবেচনায় রয়েছে। সেগুলো নিয়েও কাজ চলছে।’
কুমিল্লার রসমালাই, টাঙ্গাইলের চমচম এবং কুষ্টিয়ার রসমালাইয়ের জন্য ওই তিন জেলার জেলা প্রশাসক এবং বাংলাদেশ ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর আবেদন করে।
জিআই স্বীকৃতি কী:
কোনো একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখ-ের মাটি, পানি, আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটে সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে সেই দেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কোনো একটি পণ্য চেনার জন্য জিআই স্বীকৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো পণ্যের বিস্তারিত না জানলেও খ্যাতির ওপর নির্ভর করেই সেই পণ্যটি ব্যবহার করতে পারেন ভোক্তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘কোনো পণ্যের জিআই হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার প্রথম গুরুত্ব হলো এর মাধ্যমে কোনো পণ্য কোনো নির্দিষ্ট এলাকার বলে চিহ্নিত হয়। এর বৈশ্বিক স্বীকৃতি মেলে। দ্বিতীয় গুরুত্ব হলো, এর মাধ্যমে পণ্যটির বাণিজ্যিকীকরণের সুবিধা হয়। পণ্যটি যখন বাইরের দেশে পাঠানো হয়, তখন জিআই স্বীকৃতি পণ্যের মান ও দাম নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে।’
দেশে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন পাস হয় ২০১৩ সালে। দেশের প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পায় জামদানি। এরপর একে একে জিআই পণ্য হিসেবে গত ১০ বছরে স্বীকৃতি পায় ইলিশ, ক্ষীরশাপাতি আম, মসলিন, বাগদা চিংড়ি, কালিজিরা চাল, বিজয়পুরের সাদা মাটি, রাজশাহীর সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম। বিদায়ী বছরের জুন মাসে শীতলপাটি, বগুড়ার দই, শেরপুরের তুলসীমালা ধান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম এবং নাটোরের কাঁচাগোল্লা জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পায়।
গবেষকেরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে দেশের ঐতিহ্যবাহী পণ্যের জিআই স্বীকৃতি যত দ্রুত করা যায়, তত ভালো। যেমন বাংলাদেশের জামদানি শাড়ি এবং ইলিশ প্রায় হাতছাড়া হতে যাচ্ছিল। ভারতের ‘জামদানি’ জিআই স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছিল।
পরে অবশ্য ওই জামদানি ‘উপধা জামদানি’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আর বাংলাদেশের জামদানি ‘জামদানি শাড়ি’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পণ্য বা ঐতিহ্য কম নয়। কিন্তু গত ১০ বছরে মাত্র ১১টি পণ্যের জিআই স্বীকৃতি হয়েছে। আর এবার মাত্র এক বছরেই ১০টি পণ্যের স্বীকৃতি মিলেছে।
ডিপিডিটি সূত্র জানিয়েছে, এ স্বীকৃতি ত্বরান্বিত হওয়ার পেছনে ই-কমার্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (ইডিসি) নামের একটি বেসরকারি সংগঠনের অবদান আছে। ইডিসির প্রেসিডেন্ট কাকলী তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জিআই পণ্যের জন্য আবেদন প্রস্তুত এবং তা নিয়ে সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে আমরা আবেদনকারীকে সহায়তা করেছি। তাই এক বছরে ১০টি পণ্যের স্বীকৃতি মিলেছে।
নতুন চার পণ্য সমাচার
ডিপিডিটির সহকারী পরিচালক (পেটেন্ট) নীহাররঞ্জন বর্মণ বলেন, কোনো পণ্যের জিআই স্বীকৃতির আবেদন এলে তা যাচাই-বাছাই করে জার্নাল আকারে প্রকাশ করা হয়। এরপর দুই মাস সময় দেওয়া হয়, এ নিয়ে কারও কোনো আপত্তি আছে কি না, তা জানতে। আপত্তি না থাকলে ওই পণ্যের স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়া হয়। নতুন চার পণ্যের ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি আসেনি। তাই এসব পণ্য এখন জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃত।
সনদ প্রাপ্তির পরের স্তর:
পণ্যের জিআই পাওয়া গেলে একটি সনদ পাওয়া যায়। তাতে পণ্যের একটি স্বীকৃতি মেলে। কিন্তু জিআই প্রাপ্তির পর সেই পণ্যের উৎপাদন নির্ভেজাল ও সঠিক উপায়ে করতে নজরদারি দরকার। পণ্যের আবেদনকারী কর্তৃপক্ষই এই নজরদারি করতে পারে। যেমন কুমিল্লার রসমালাইয়ের জিআই স্বীকৃতির পর এর উৎপাদন যেন মানসম্পন্ন হয় এবং যত্রতত্র না হয়, এর জন্য আবেদনকারী জেলা প্রশাসনকে দায়িত্ব নিতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান রসমালাই উৎপাদন করবে, তারা অনুমতি নেবে। তাদের পণ্যে প্রশাসনের কোনো হলমার্ক থাকতে পারে।
ডিপিডিটির মহাপরিচালক মো. মুনিম হাসান বলছিলেন, ‘আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানকে পণ্যের নজরদারি করার জন্য ক্ষমতায়িত করা হবে। আমরা এখন সেই উদ্যোগ নিচ্ছি। এতে পণ্যের মানের উন্নতি হবে, আবার নকল রোধ হবে।’