নরম
রসমালাই আর সূক্ষ্ম খাদির মতোই কুমিল্লার মানুষের হৃদয়ে লুকিয়ে আছে আরেকটি
সোনালি ঐতিহ্য-বাটিক শিল্প। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে হাতে হাতে গড়ে ওঠা
এই শিল্প কুমিল্লার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নীরব গর্ব। পর্যাপ্ত সরকারি
পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এর জৌলুস কিছুটা ম্লান হলেও আজও টিকে আছে বাটিক ঐতিহ্য
বাঁচিয়ে রাখার স্বপ্ন। ছোট ছোট উদ্যোক্তা ও শ্রমজীবী মানুষের নিরলস
প্রচেষ্টায় বেঁচে আছে কুমিল্লার বিখ্যাত বাটিক শিল্প।
প্রতিদিন ভোরের
প্রথম আলো ফুটতেই বাটিকপল্লীর কর্মশালাগুলো জেগে ওঠে। রঙের ঘ্রাণ, গরম
পানির বাষ্প আর কারিগরের যত্নমাখা স্পর্শে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ।
প্রায়
৫০ বছর আগে কুমিল্লার সদর উপজেলার কমলপুর গ্রামে লাল মিয়া ও মোহন মিয়া নামে
দুই ভাইয়ের হাত ধরে বাটিক শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। ভারত থেকে বাটিকের কৌশল
শিখে এসে তারা এই শিল্পের ভিত্তি গড়ে তোলেন। সময়ের পরিক্রমায় তাদের হাতে
তৈরি বাটিক ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। কমলপুর ও আশপাশের কয়েকটি গ্রামে বর্তমানে
গড়ে উঠেছে প্রায় ২৫টি কারখানা। এসব কারখানায় দীর্ঘদিন ধরে নান্দনিক
ডিজাইনের বাটিক শাড়ি, থ্রি-পিস, শার্ট, লুঙ্গি ও বেডশিট তৈরি হচ্ছে।
স্থানীয়
চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এসব বাটিকপণ্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের
বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে। এমনকি বিদেশেও রপ্তানি হয়ে সুনাম অর্জন
করেছে কুমিল্লার বাটিক। ঐতিহ্যবাহী খাদির পর জনপ্রিয়তার দিক থেকে বাটিক এখন
কুমিল্লার অন্যতম পরিচয়। কুমিল্লা নগরীর মনোহরপুর, কান্দিরপাড় ও রামঘাট
এলাকার প্রায় দুই শতাধিক দোকানে কমলপুরের বিখ্যাত বাটিকপণ্য বিক্রি হচ্ছে।
কারখানার
ভেতরে প্রতিদিন চলছে রঙ আর নকশার নিরবচ্ছিন্ন শ্রম। কেউ গরম পানিতে কাপড়ের
অপ্রয়োজনীয় ‘মার’ তুলে ফেলছেন, কেউ রঙের কড়াইয়ে তৈরি করছেন নীল, হলুদ, লাল
আর মাটির রঙের মায়াজাল। সেই রঙিন কাপড়ে মোমের নকশা, ফুলের ছাপ আর ঢেউয়ের
রেখায় ফুটে ওঠে শিল্পীর কল্পনা।
দীর্ঘ এক যুগ ধরে বাটিক কারখানায় কাজ
করছেন শ্রমিক হামিদ চৌধুরী। তিনি কাপড়ের বিহারি, ওয়াশ ও ডাইনের কাজ করেন।
একাই সামলাচ্ছেন তিনটি দায়িত্ব। তিনি বলেন, ‘বিহারি শেষ করে মোম তুলে কাপড়
ওয়াশ করা হয়, এতে কাপড় পরিষ্কার ও উজ্জ্বল হয়।’
আরেক শ্রমিক মুশফিকুর
রহমান মোন্না জানান, তিনি থ্রি-পিসের কাজ করেন। সাদা কাপড়ে মোম দিয়ে ব্লক
করার পর নারীরা তুলি দিয়ে রঙ করেন। প্রতিদিন তিনি ২০ থেকে ৩০টি থ্রি-পিসের
মোম ব্লক সম্পন্ন করতে পারেন।
রঙ করা কাপড় মাঠে সারি সারি করে রোদে
শুকানো হয়। কয়েকজন কর্মী সারাক্ষণ কাপড় উল্টে-পাল্টে ঠিক করে দিচ্ছেন।
রোদের আলোয় প্রতিটি নকশা হয়ে উঠছে আরও প্রাণবন্ত।
