মানুষের চোখ দিয়ে শুধু দেখে না-হৃদয়কেও গঠন করে। চোখ যা দেখে, তার প্রভাব সরাসরি মানুষের মন, চরিত্র ও ইমানের ওপর পড়ে। তাই ইসলামে শুধু হারাম দৃশ্য থেকে নয় বরং জায়েজ জিনিস থেকেও চোখকে নিয়ন্ত্রণ করার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। কারণ সব দৃশ্য চোখে গেলেও, দেখা বৈধ হলেও সব দৃশ্য হৃদয়ে ঢোকানো উচিত নয়।
আজকের যুগে চোখের সামনে অসংখ্য দৃশ্য- হারাম, অশ্লীল ও পাপের দিকে ডাকে; আবার কিছু দৃশ্য নিজে হারাম না হলেও তা মানুষের হৃদয়কে দুনিয়ার প্রতি অতিরিক্ত আসক্ত করে তোলে, ইমানকে দুর্বল করে দেয়, আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তাই ইসলামে শুধু নাজায়েজ জিনিস থেকে নয়, জায়েজ জিনিস থেকেও চোখকে নিয়ন্ত্রণ করার নির্দেশ দেয়; যার ফলে হৃদয় আধ্যাত্মিকভাবে সুস্থ থাকতে পারে।
১. দুনিয়ার প্রতি অতিরিক্ত আকাক্সক্ষা সৃষ্টি হয়
বাড়ি-গাড়ি, সহায়-সম্পদ, ভোগ-বিলাসিতার দৃশ্য যদিও জায়েজ কিন্তু এসব দৃশ্য হৃদয়কে দুনিয়ার প্রতি অতিরিক্ত ঝুঁকিয়ে দেয়; যা থেকে ইমানদারকে সতর্ক করেছেন স্বয়ং আল্লাহতাআলা। কুরআনে বিষয়টি এভাবে ওঠে এসেছে—
‘আর আপনি আপনার দুই চোখ কখনো প্রসারিত করবেন না (১) সে সবের প্রতি, যা আমরা বিভিন্ন শ্রেণীকে দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্যস্বরূপ উপভোগের উপকরণ হিসেবে দিয়েছি, তা দ্বারা তাদের পরীক্ষা করার জন্য। আর আপনার রবের দেওয়া রিজিকই সর্বোৎকৃষ্ট ও অধিক স্থায়ী।’ (সুরা ত্বহা: আয়াত ১৩১)
এই আয়াতে রাসুলুল্লাহকে (সা.) সম্বোধন করা হয়েছে, তার উম্মতকে সঠিক পথ প্রদর্শন করাই লক্ষ্য। বলা হয়েছে- দুনিয়ার ঐশ্বর্যশালী পুঁজিপতিরা হরেক রকমের পার্থিব চাকচিক্য ও বিবিধ নেয়ামতের অধিকারী হয়ে বসে আছে। আপনি তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপও করবেন না। কেননা এগুলো সব ধ্বংসশীল ও ক্ষণস্থায়ী। আল্লাহতাআলা যে নেয়ামত আপনাকে এবং আপনার মধ্যস্থতায় মুমিনদের দান করেছেন, তা এই ক্ষণস্থায়ী পার্থিব চাকচিক্য থেকে বহুগুণে উৎকৃষ্ট। (ফাতহুল কাদির)
আরও পরিষ্কার করে বলা যায়— দুনিয়ার চাকচিক্যময় বিষয়গুলো নিয়ে যার ভেতর আকর্ষণ এবং হীনমন্যতা বেশি কাজ করে, তার জন্য জরুরি এরকম ক্ষেত্রেও চোখের হেফাজত করা। যেমন- কারও লেটেস্ট মডেলের গাড়ি আছে, তা নিয়ে অন্যের মধ্যে ফ্যাসিনেশন আছে, এরকম গাড়ি চোখে পড়লেই তার জন্য চোখ সরিয়ে নেওয়া জরুরি। এভাবে সুন্দর বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট, লেটেস্ট মডেলের মোবাইল ফোন বা আকর্ষণীয় কোনো ড্রেস- যেগুলো দেখলে তার নিজের ভেতর আফসোস এবং আকর্ষণ তৈরি হয়, সে যেন এসব কিছু থেকেও দৃষ্টি বা চোখের হেফাজত করে। অন্য আয়াতে আল্লাহতাআলা প্রিয় নবীকে (সা.) উদ্দেশ্য করে আবারও ঘোষণা দেন-
‘আমরা তাদের বিভিন্ন শ্রেণীকে ভোগ-বিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি তার প্রতি আপনি কখনো আপনার দুই চোখ প্রসারিত করবেন না। তাদের জন্য আপনি দুঃখ করবেন না। আপনি মুমিনদের জন্য আপনার বাহু নত করুন।’ (সুরা হিজর: আয়াত ৮৮)
অর্থাৎ প্রত্যেক দেখা হালাল বা জায়েজ হলেও- মানুষের অন্তরে অহেতুক লোভ জাগাতে পারে। যে কারণে আল্লাহতাআলা প্রিয় নবী (সা.) লক্ষ্য করে কুরআনের এই দুইটি আয়াতে মানুষকে সতর্ক থাকতে শিক্ষা দিয়েছেন। যাতে মানুষ হৃদয়ের ব্যাধিতে আক্রান্ত না হয়।
২. অহংকার, ঈর্ষা ও অস্থিরতা জন্ম নেয়
জায়েজ বস্তুর প্রতি অতিরিক্ত দৃষ্টি কখনো কখনো ঈর্ষার আগুন জ্বালায়- ‘তার আছে, আমার নেই কেন?’ এই মানসিক অবস্থা ইমানকে দুর্বল করে দেয়, দোয়া ও কুরআনের প্রতি মনোযোগ কমিয়ে দেয়।
৩. হৃদয় আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরে যায়
চোখ যখন চাকচিক্যময় দুনিয়ার চারদিকে ঘোরে, সৌন্দর্য আর আড়ম্বরের পেছনে দৌড়ায়, তখন মন অজান্তেই আল্লাহর জিকির থেকে সরে যেতে থাকে। আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল-নিজে হারাম না হলেও-হৃদয়কে ফাঁকা করে দেয়।
৪. অপ্রয়োজনীয় দেখা, অপ্রয়োজনীয় চিন্তা জন্ম দেয়
অনেক চাকচিক্যময় জিনিস দেখা জায়েজ হলেও বারবার তাকানো- সময় নষ্ট করে, চিন্তাকে বিভ্রান্ত করে, মনকে দুর্বল করে। আবার অপ্রয়োজনীয় জিনিসের দিকে প্রথম দৃষ্টিতে গুনাহ নেই, কিন্তু অযথা আরেকবার তাকানো-হৃদয়ের জন্য ক্ষতিকর। এ কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-‘প্রথম দৃষ্টি ক্ষমাযোগ্য, দ্বিতীয় দৃষ্টি তোমার জন্য নয়।’ (আবু দাউদ ২১৪৯)
৫. চোখের নিয়ন্ত্রণ-হৃদয়ের পরিশুদ্ধতা
ইবন আল-কাইয়্যিম (রহ.) বলেছেন- ‘দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ হৃদয়কে শক্ত করে, ইমানকে সতেজ করে।’ কারণ চোখ যত সংযত, হৃদয় তত স্বচ্ছ।
ভাবনার বিষয়! কুরআনের এই আয়াত অনেকেই জীবনভর তেলাওয়াত করছে, নিজেরাও হয়তবা বারবার তেলাওয়াত করেছি কিন্তু নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের সঙ্গে এভাবে ফিট করার সুযোগ কখনো হয়নি। তাই সাবধান এখনই সময় কিছু কিছু বৈধ বা জায়েজ জিনিস থেকেও নিজের চোখকে হেফাজত করা জরুরি।
মনে রাখবেন, জায়েজ জিনিস দেখা নিষিদ্ধ নয়- কিন্তু অপ্রয়োজনীয় দেখা অনেক সময় হৃদয়ের শান্তি, ইমানের দৃঢ়তা ও মনোযোগ নষ্ট করে দেয়। তাই একজন মুমিন শুধু হারাম থেকে নয়, বরং এমন সব জিনিস থেকেও নিজের চোখকে হেফাজত করবে, যা তার ইমানকে দুর্বল করতে পারে। কারণ চোখকে নিয়ন্ত্রণ করা মানে- হৃদয়কে রক্ষা করা। এটাই মুমিনের সৌন্দর্য, এটাই তাকওয়ার পরিচয়।
