শুক্রবার ২৮ নভেম্বর ২০২৫
১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
একযুগ ধরে অপেক্ষায় স্বজনরা
লাকসামের দুই বিএনপি নেতার আজও খোঁজ মিলেনি!
সৈয়দ মুজিবুর রহমান দুলাল
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৫, ১২:৩০ এএম আপডেট: ২৮.১১.২০২৫ ১:০৭ এএম |


লাকসামের দুই  বিএনপি নেতার  আজও খোঁজ মিলেনি! লাকসামের গুম হওয়া দুই বিএনপির নেতার আজও কোনো খোঁজ মিলেনি। একযুগ ধরে অপেক্ষায় রয়েছেন স্বজনরা। দুই নেতাকে ফিরে পাবার আশায় দলের নেতাকর্মী ও স্বজনেরা বছরের পর বছর পথ চেয়ে থাকলেও তাদের প্রতিক্ষার প্রহর যেনো শেষই হচ্ছেনা।
গতকাল বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) কুমিল্লার লাকসামের বিএনপি’র শীর্ষ দুই নেতা লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. সাইফুল ইসলাম হিরু এবং লাকসাম পৌর বিএনপির সভাপতি মো. হুমায়ুন কবির পারভেজ গুমের একযুগ পূর্ণ হয়েছে। 
২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর রাতে ওই দুই নেতা গুম হয়েছিলেন। লাকসামের বিএনপির গুম হওয়া ওই দুই নেতার স্বজনেরা একযুগ ধরে অপেক্ষা করছেন। তাঁদের ফিরে পাবার আশায় বুক বেঁধেছেন। এখনো অপেক্ষার প্রহর গুনছেন স্বজনেরা। 
গুম হওয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. সাইফুল ইসলাম হিরুর ছেলে রাফসান ইসলাম এবং পৌরসভা বিএনপির সাবেক সভাপতি মো. হুমায়ুন কবির পারভেজের ছেলে শাহরিয়ার কবির রাতুল তাঁদের বাবাকে ফিরিয়ে পেতে সরকারের কাছে জোর দাবি জানান।
গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কথিত ‘আয়নাঘর’ থেকে গুম হওয়া একাধিক ব্যক্তি ফিরে আসার খবরে তৎপর হয়ে ওঠেন লাকসামের গুম হওয়া ওই দুই বিএনপি নেতার পরিবারের সদস্যরা। তবে হিরু ও হুমায়ুন আদৌ বেঁচে আছেন-এমন কোনো আশ্বাস পাননি তাঁরা।
স্থানীয় বিএনপি ও দুই পরিবারের স্বজনদের অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠ ও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির টানা অবরোধ কর্মসূচি চলছিলো। সময় ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর। রাত ৯টার দিকে কুমিল্লার লাকসামে বিশেষ অভিযান চালায় র‌্যাব-পুলিশসহ যৌথ বাহিনী। একপর্যায়ে লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরুর মালিকানাধীন ‘লাকসাম ফ্লাওয়ার মিলে’ ঘণ্টাব্যাপী অভিযান চালিয়ে ৯ জনকে আটক করা হয়।
যৌথ বাহিনীর অভিযানের খবর পেয়ে ওই রাতেই উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. সাইফুল ইসলাম হিরু, লাকসাম পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জসিম উদ্দিন একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে লাকসাম থেকে কুমিল্লার উদ্দেশে রওনা করেন। কুমিল্লা-নোয়খালী আঞ্চলিক মহাসড়কের লালমাই উপজেলার হরিশ্চর-আলীশ্বর এলাকায় পৌঁছালে সাদাপোশাকধারী একদল লোক অ্যাম্বুলেন্সের গতি নিয়ন্ত্রণ করেন। র‌্যাব পরিচয়ে দিয়ে ওই তিন বিএনপি নেতাকে অন্য একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে কুমিল্লার দিকে নিয়ে যান তাঁরা। পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে জসিম উদ্দিন ও লাকসামে আটক হওয়া অপর ৯ জনকে লাকসাম থানায় হস্তান্তর করে র‌্যাব। পরদিন ২৮ নভেম্বর সকালে ওই ১০ জনকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কুমিল্লার আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠায় লাকসাম থানা পুলিশ। এরপর থেকে বিএনপি নেতা সাইফুল ইসলাম হিরু ও হুমায়ুন কবির পারভেজের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ঘটনার পর থেকেই পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীর দাবি, স্থানীয় বিএনপির ওই দুই শীর্ষ নেতাকে র‌্যাব সদস্যরা অপহরণের পর গুম করেছেন। অপহরণ ও গুমের অভিযোগে ২০১৪ সালের ১৮ মে র‌্যাবের ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কুমিল্লার আদালতে একটি মামলা করেন হুমায়ুন কবির পারভেজের বাবা রঙ্গু মিয়া। 
ওই মামলার আসামিরা হলেন র‌্যাব-১১–এর বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া সাবেক অধিনায়ক (সিইও) ও নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, র‌্যাব-১১–এর তৎকালীন কুমিল্লা ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা কোম্পানি অধিনায়ক-২ মেজর শাহেদ হাসান (রাজীব), উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) শাহজাহান আলী, উপপরিদর্শক (এসআই) কাজী সুলতান আহমেদ ও অসিত কুমার রায়।
সেদিনের ঘটনার কথা বলতে গেলে এখনো আঁতকে ওঠেন র‌্যাবের হাতে আটক ওইদিন অ্যাম্বুলেন্সে থাকা প্রত্যক্ষদর্শী জসিম উদ্দিন।তিনি বলেন, ‘আমাদের তিনজনকে আটকের পর চোখ বেঁধে ফেলা হয়। পরে চোখ খোলার পর দেখি, গভীর রাত। আমি তখন লাকসাম থানায়। ওই সময় চারদিকে খোঁজ করেও হিরু ভাই ও হুমায়ুন ভাইকে দেখতে পাইনি। 
তিনি আরো বলেন, যেহেতু আমাকে র‌্যাব আটক করার পর লাকসাম থানায় দিয়ে গেছে। তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ওই দুই নেতাকে র‌্যাবই গুম করেছে।'
২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট ছেলে হারানোর শোকে মারা যান মামলার বাদী রঙ্গু মিয়া। বর্তমানে রঙ্গু মিয়ার ছেলে হুমায়ুন কবির পারভেজের ছোট ভাই পৌরসভা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. গোলাম ফারুক মামলাটির বাদী।
নিখোঁজ হুমায়ুন কবির পারভেজের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার এ সম্পর্কে বলেন, ‘প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনামতে র‌্যাবই তাঁর স্বামী লাকসাম পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ এবং লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরুকে গুম করেছে।
তিনি বলেন, লাকসামের এই শীর্ষ দুই নেতাকে গুম করার মূল কারণ হলো রাজনীতি। তাঁদের সরিয়ে দিয়ে প্রতিপক্ষ দলের স্থানীয় শীর্ষ নেতারা লাভবান হয়েছিলেন। 
নিখোঁজ হুমায়ুন কবিরের স্ত্রী শাহনাজ আক্তারের দাবি, ঘটনার পর পরিবারের সদস্যরা অনেক চেষ্টার পর তারেক সাঈদের সঙ্গে একবার দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তখন তারেক সাঈদ তাঁদের তৎকালীন সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলার পরামর্শ দেন। এরপর তাঁরা মো. তাজুল ইসলামের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন। বারবার আকুতি-মিনতি করেও কোনো কাজ হয়নি।
শাহনাজ আক্তার বলেন, ‘আজও জানি না, আমার স্বামী হুমায়ুন কবির পারভেজ এবং বিএনপি সাইফুল ইসলাম হিরুর ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছে। আমরা জানতে চাই, তাঁরা কি জীবিত, নাকি তাঁদের মেরে ফেলা হয়েছে? অন্তত এইটুকু জানার অধিকারও কি আমাদের নেই?’
মামলার বাদী বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির পারভেজের ছোট ভাই লাকসাম পৌরসভা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. গোলাম ফারুক বলেন, গত বছর ৫ আগষ্টের পর অনেকে আয়নাঘর থেকে ফিরে এসেছেন-এ খবর পেয়ে আমরা ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছি। কিন্তু এখনো কোনো হদিস মেলেনি আমার বড়ভাই বিএনপি নেতা মো. হুমায়ুন কবির পারভেজ এবং মো. সাইফুল ইসলাম হিরুর। তাঁর দাবি, এখন কোনো চাপ নেই; তাই আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) দুপুরে বাদীপক্ষের প্রধান আইনজীবী মুহাম্মদ বদিউল আলম সুজন জানান, অপহরণ ও গুমের অভিযোগে ২০১৪ সালের ১৮ মে র‌্যাবের ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কুমিল্লার আদালতে একটি মামলা করেন হুমায়ুন কবিরের বাবা রঙ্গু মিয়া। 
একই বছর ৩১ আগস্ট ছেলে হারানোর শোকে মারা যান মামলার বাদী রঙ্গু মিয়া। বর্তমানে রঙ্গু মিয়ার ছেলে হুমায়ুন কবির পারভেজের ছোট ভাই মো. গোলাম ফারুক মামলাটির বাদী। 
আইনজীবী বদিউল আলম সুজন জানান, মামলাটির প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন কয়েক দফা সময় নিয়ে ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর মনগড়াভাবে আদালতে দাখিল করে লাকসাম থানার পুলিশ। পরে পুলিশের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে বাদি নারাজি আবেদন দিলে ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি আদালত মামলাটি সিআইডিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। 
তিনি জানান, সিআইডি সাড়ে ৫ বছরে অন্তত ৬৩ বার আদালত থেকে সময় নিয়ে২০২০ সালের ২৭ আগস্ট মনগড়া একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। এরপর পিবিআইও একই কাজ করেছেন। কয়েক দফা তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একবারও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি।
আইনজীবী মুহাম্মদ বদিউল আলম সুজন জানান, ‘শুরু থেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ঘটনাটি ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। তাঁর ভাষ্য, আগে যাঁরা মামলাটির তদন্ত করেছেন, তাঁদের কেউ চাননি মামলাটি আলোর মুখ দেখুক। এজন্য তাঁরা তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণ করেছেন।
তিনি আরও জানান, সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠিত হয়েছে। সেখানে সব তথ্য-উপাত্ত জমা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে মামলাটি বিজ্ঞ আদালতে বিচারাধীন।
এই ব্যাপারে গতকাল বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) দুপুরে লাকসাম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাজনীন সুলতানা মুঠোফোনে এই প্রতিনিধিকে বলেন, অনেক আগেই মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়েছে। বর্তমানে মামলাটি বিজ্ঞ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।













http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
প্লট দুর্নীতির মামলায় শেখ হাসিনা ও দুই সন্তানের সাজা
বিশিষ্ট গাইনি চিকিৎসক ফাহমিদা আজিম কাকলির জানাজা সম্পন্ন
খালেদা জিয়ার জন্য দোয়া চেয়ে কাঁদলেন হাজী ইয়াছিন
আদালত ও কালিয়াজুরি এলাকায় মনিরুল হক চৌধুরীর গণসংযোগ
নির্বাচনকে সামনে রেখে সীমান্তে অনুপ্রবেশে রোধে কঠোর থাকবে প্রশাসন
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লায় অস্ত্রশস্ত্রসহ ডাকাত দলের ৫ সদস্য আটক
কুমিল্লায় প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ
তারেক-ইউনুস ঐতিহাসিক বৈঠকই নির্বাচনের রোডম্যাপ নিশ্চিত করছে
কুমিল্লার নতুন পুলিশ সুপার আনিসুজ্জামান
কুমিল্লায় ইসলামী মহাসম্মেলন
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২