বুধবার ২৬ নভেম্বর ২০২৫
১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
প্রগতি ও প্রত্যয়
জুলফিকার নিউটন
প্রকাশ: বুধবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৫, ১২:০৩ এএম |


 প্রগতি ও প্রত্যয়

বাক্ এবং অর্থ যেমন পরস্পর সম্পৃক্ত, প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধও তেমনি। এই সম্পর্কটাকে উপেক্ষা করলে বাক্য তার অর্থ হারায়, প্রতিষ্ঠান তার মূল্য। আদর্শ সমাজ নিয়ে আলোচনায় অনেক সময় বাইরের প্রতিষ্ঠানের দিকটাই লক্ষ করা হয় ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’, ‘সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা’, এইসব নিয়ে তর্ক চলে। মূল্যবোধের কথাটা উপেক্ষিত থেকে যায়। এর অবশ্য কিছু কারণ আছে। 
প্রতিষ্ঠান জিনিসটা বাইরের বলেই তার চেহারা বর্ণনা করা অপেক্ষাকৃত সহজ। মূল্যবোধ যেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, তা নিয়ে আলোচনা করতে অসুবিধা বোধ হতে পারে। আরও একটা ব্যাপার আছে। প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কিছু ঐতিহাসিক স্তরভেদের সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানীরা আমাদের পরিচিত করিয়েছেন। সবাই অবশ্য একমত নন ভুলেরও সম্ভাবনা খুবই। তবুও এ বিষয়ে আলোচনার কিছু পরিচিত উল্লিখবিন্দু আছে। মূল্যবোধের ক্ষেত্রে সেই পরিচয়টা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। এইরকমের কিছু কথা মনে হতে পারে। কিন্তু আসল বাধা অন্যত্র। আমরা বাইরের সঙ্গে ভিতরের যোগ ঘটানোর অভ্যাস হারিয়ে ফেলেছি। ফলে কিছুরই আর অর্থ থাকছে না। ভিতরের সঙ্গে বাইরেকে মিলিয়ে দেখা দরকার। 
মূল্যবোধের ক্ষেত্রে অন্বেষণটা বাইরে শুরু হলেও শেষ অবধি প্রত্যয়ের ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় চেতনার ভিতরে। আকাক্সক্ষার নানা স্তর আছে। এ আমরা সবাই জানি। তবু বিষয়টা ভেবে দেখার যোগ্য। এ ব্যাপারে চিন্তার পরিচ্ছন্নতা এলে আরও নানা বিষয় পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
সামান্য একটা উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। যেমন, খাদ্য ও পানীয়। নিতান্ত জৈব স্তরে এর প্রয়োজন। ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটানোর জন্য খাদ্য ও পানীয় চাই। দেহধারণের জন্য এটা দরকার। কিন্তু খাদ্যে শুধু খিদে মেটে, পেটের জ্বালা দূর হয়, তা তো নয়। তার অতিরিক্ত একটা সুখ, রসনার সুখ, সেইসঙ্গে পাওয়া যায়। রসনার সুখের সন্ধানে রান্না নিয়ে হরেক রকম পরীক্ষা চলে। উদ্ভাবিত হয় নানা রকমের রসুই। এটাই হয়ে ওঠে সংস্কৃতির একটা শাখা। ফরাসি রসুই, চীনে রান্না, মোগলাই, আরও কত রকম। পানীয়েরও আছে কত বিচিত্র রূপ। জৈব স্তর ছাড়িয়ে খাদ্য ও পানীয় পৌঁছে যায় আভিজাত্যের অন্য এক স্তরে। 
এর বিরুদ্ধেও আবার প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। অতি ভোজনে অসুখ বাড়ে। পৃথিবীর ধনী দেশে, ধনবানদের ভিতর, ভোজনের অতিশয্যই দৈহিক পীড়া এবং মৃত্যুর অন্যতম প্রধান করণ হিসেবে চিকিৎসকদের কাছে স্বীকৃত। পানীয়ঘটিত দুর্ঘটনার কথা সবাই জানেন। এসবের দুষ্ট ক্রিয়া শুধু দেহের ওপরই নয়, আক্রান্ত হয় মনও। খাদ্যে ও পানীয়ে যখন মানুষ আসক্ত হয়ে পড়ে তখন মনের পক্ষে সেটা একটা বন্ধনদশা। সুখের সন্ধানে যার শুরু তার পরিণতি এক বিশেষ ধরনের অসুখে। 
অর্থব্যয় করে মানুষ নিজের মনকে শৃঙ্খলিত করে। সেই শৃঙ্খলকেই আবার কেউ অলংকার জ্ঞান করে। দামি গয়না নিয়ে যেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে দামি খাদ্য, ধূম্র ও পানীয় নিয়েও সেইরকম। এইসব হয়ে ওঠে আভিজাত্যের মাপকাঠি। দরিদ্র মানুষ শাকান্ন থেকে যে তৃপ্তিলাভ করে ধনী সেটা পায় না বিলাসী আহার্য অথবা পানীয় থেকে, কিন্তু এই সবের অভাবটা ধনীর কাছে বড়োই দুঃখজন মনে হয়। 
মনের এই শৃঙ্খলিত অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। সরল আহারেই খুঁজে পাওয়া যায় দেহের স্বাস্থ্য, রসনার স্বাদ, মনের মুক্তি। খাদ্য ও পানীয়ের বিবর্তনে এটা তৃতীয় স্তর। দারিদ্র্যের অতি দীন আহার্য বাধ্যতামূলক, কুখাদ্যেও কেউ অভ্যস্ত হয়। আতিশয্য ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় সারল্যে প্রত্যাগমন রুচি ও মননের অন্য এক অবস্থা। খাদ্য ও পানীয় উদাহরণ মাত্র। উদ্দেশ্য ছিল, পরিচিত জীবনের মাঝখানে এনে চেতনা ও আকঙ্খার স্তরভেদ দেখানো। যে তিনটি স্তরের কথা বলা হলো, এদেশের ঐতিহ্যাশ্রয়ী ভাষায় তাদের তামসিক, রাজসিক ও সাত্ত্বিক বলে চিহ্নিত করা সহজ। কেবল বাইরের লক্ষণ দিয়ে চেতনার স্তরনির্ধারণ করতে পাছে অবশ্য ভুলের সম্ভাবনা থেকেই যায়। 
এই সঙ্গে বুঝে নিতে হবে আরও একটা কথা। প্রতিটি স্তরের ভিতরই প্রচ্ছন্ন আছে সেই শক্তি যার সাহায্যে আরোহণ করা যায় পরবর্তী স্তরে। তামসিক অবস্থাতেও থাকে সেই প্রাণশক্তির বীজ ও সুখের আকক্সক্ষা যাতে মানুষকে ঠেলে দেয় রাজসিকতার দিকে। রাজসিকতাও একটি স্থির অবিকল ভাব নয়। তাকে আছে নানা রঙের খেলা। কখনো জয়ের আকাক্সক্ষা প্রবল, কখনো ভোগের। আবার রাজসিকতার ভিতর থেকেই দেখা দেয় বন্ধন বিষয়ে সেই সচেতনতা যাতে ক্রমে উদ্ঘাটিত হয় মুক্তির নতুন দিগন্ত। 
যে গুণত্রয়ের বিষয়ে বলা হলো তাদের কোনো একটিকে শুদ্ধরূপে স্বতন্ত্রভাবে পাওয়া কঠিন। বরং মিশ্ররূপেই এদের আমরা পেয়ে থাকি। তবে কোথাও একটির অথবা অন্যটির প্রাধান্য। প্রাধান্যভেদেই গুণভেদ; যেমন শৃগালের তুলনায় সিংহের ভিতর রাজসিকতার প্রাধান্য। আরও একটি কথা যোগ করা দরকার। প্রতিটি গুণের ভিতরই এমন কিছু আছে যেটিকে প্রাণীর প্রয়োজন, অতএব যার মূল্য স্বীকার্য। তামসিকতার ভিতরও বোধ করি এমন একটি অন্ধ প্রাকৃত প্রেম আছে যার মূলোচ্ছেদ হলে প্রাণীর চলে না। এক স্তর থেকে অন্য স্তরে আরোহণ যে অনিবার্য এমন কোনা কথা নেই। অনেকেই আটকে থাকে এক স্তরে। তবে মানুষকে এবং তার ইতিহাসকে যখন আমরা সমগ্রভাবে দেখি তখন একটা চলমানতাই চোখে পড়ে। বাবুই পাখির যুগের পর যুগ একই গতিশলীতা আছে। এক স্তর থেকে অন্য স্তরে যাত্রার সব চেষ্টা সফল হয় না। তবু সেই চেষ্টার একটা বিশেষ মূল্য স্বীকার করি, এমনকি ব্যর্থ চেষ্টাও মূল্যহীন নয়। 
রবীন্দ্রনাথের একাধিক উপন্যাসে পাওয়া যাবে তামসিক অথবা রাজসিক চরিত্রের পশে একাটি সাত্ত্বিক মানুষ। টলস্তয়ের উপন্যাসেও এইরকম দেখা যায়। এইসব চরিত্রের জৈপরীত্যে ও ঘাতপ্রতিঘাতে কাহিনির ভিতরকার গতি স্মরণীয় হয়ে ওঠে। যেমন ব্যক্তির জীবনে তেমনি পরিবারের ইতিহাসেও গতি ও বৈপরীত্য চোখে পড়ে। দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন রাজসিক প্রকৃতির মানুষ। দেবেন্দ্রনাথ ঝুঁকেছিলেন সাত্ত্বিকতার দিকে। দুজনেই শ্রদ্ধার যোগ্য, তবে দুইভাবে। পিতা ও পিতামহের এই বৈপরীত্য কি ঐতিহাসিক সমন্বয় খুঁজেছিল রবীন্দ্রনাথে? 
ভোগবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার কিছু বিপদ আছে। প্রতিক্রিয়ার শক্তিটা কখনো কখনো আত্মপীড়ন ও পরপীড়নের রূপ নিয়ে ফিরে আসে। শাহজাহান ছিলেন রাজসিক ও ভোগবাদী। ঔরঙ্গজেবের ভিতর দেখা দিল প্রতিক্রিয়া। তাঁর জীবনযাত্রা ছিল সরল, তাঁর বিশ্বাস ছিল ধর্মে। কিন্তু তাঁর ভিতর ঔদার্যের অভাব ছিল, অন্তত অনেক ঐতিহাসিকেরই এই রায়। নানা গুণ সত্ত্বেও তাঁকে সাত্ত্বিক বলা যাবে না। ঔরঙ্গজেবের পর অবশিষ্ট রইল এক ক্ষয়িষ্ণু আভিজাত। অনেক রাজবংশেরই ইতিহাস এইরকম। আরম্ভে শৌর্যবীর্য। স্বর্ণযুগে দেখা যায় শিল্পসংগীতের বর্ণাঢ্য বিকাশ। তারপর নেমে আসে অমিতব্যয়িতা, উচ্ছৃঙ্খলতা ও অবক্ষয়ের ভিতর দিয়ে বংশের অবসান। রাজসিকতার ভিতর যে দ্বন্দ্ব তাকে একটা সার্থক সমন্বয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া কোনো কালেই সহজ হয়নি। ইতিহাসের পথের ধারে একের পর এক পড়ে আছে কত বিদতমহিমা রাজবংশের ধ্বংস্তূপ। 
ব্যক্তি পরিবার রাজবংশ এইসব ছাড়িয়ে মানুষের সমাজের বৃহত্তর ইতিহাসের দিকে যখন তাকাই তখন কি সেখানে স্তর থেকে স্তরান্তরে উন্নতির কোনো ছবি চোখে পড়ে? সমাজের সংগঠন যে বদলে চলেছে তাতে তো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা বলছি না শুধু বাইরের পরিবর্তনের কথা। এইসবের ভিতর দিয়ে মানুষের চেতনার পরিবর্তনের কোনো দিকনির্দেশ কি পাওয়া যায়? 

কোনো এক যুগে মানুষ ছিল প্রকৃতির বন্য সন্তান, ভীত মূঢ় অসহায়। ক্রমে বৃদ্ধি পেল প্রকৃতির ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণের শক্তি। এই শক্তি সমাজের সর্বস্তরে সমাজভাবে কাজে লাগেনি। তবু শুরু হয়ে গেল ইতিহাসের অন্য এক পর্ব। সমাজের ভিতর যে বিচিত্র ও বহুমুখী দ্বন্দ্ব তাকে বাদ দিয়ে এই পর্বের ইতিহাস বোঝা যায় না। আবার মানুষের ভিতর মুক্তি ও আত্মপ্রত্যয়ের যে বহুবিঘ্নিত প্রকাশ, শিল্প ও বিশ্বজনীনতার যে অস্ফুট উচ্চারণ, তাকে অগ্রাহ্য করলেও ইতিহাস মানবিক হয়ে ওঠে না। যেমন ব্যক্তি এই মুহূর্তের কোনো চিন্তা কিংবা কর্মেই তার সমগ্র চেতনা অথাব সম্ভাবনা রূপলাভ করে না, তেমনি কোনো বিশেষ সমাজবিন্যাস অথাব কর্মকাণ্ডেও মনুষ্যজাতির চেতনার সম্পূর্ণ পরিচয় ও সম্ভাবনা জানা যায় না। 
দ্বন্দ্বের প্রকারভেদ আছে। একদিকে দেখি বিভিন্ন বর্গ ও সম্প্রদায়ের ভিতর বিরোধ ও সমবায়। ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা ছেড়ে দিয়ে যদি সমষ্টিগত বিরোধের বিচার করা যায় তবু তার কত নাম, কত রূপ– বর্ণবিদ্বেষ, ধর্মযুদ্ধ, শ্রেণিসংগ্রাম, জাতিতে জাতিতে সংঘাত। অন্য দিকে পাই ভিন্ন এক দ্বন্দ্ব, পরিস্থিতির দাবির সঙ্গে মানুষের তৎকালীন চেতনার স্তরের বিরোধ। এইসব নিয়ে আরও কিছু আলোচনা পরে করা যাবে। তার আগে সংক্ষেপে যোগ করব একটি কথা। সমস্ত দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করে যে আদর্শ উঁকিঝুঁকি মারে তাকে শুধু ঘটনা থেকে পাওয়া যায় না। পরিস্থিতি সংকট সৃষ্টি করে বটে, কিন্তু সংকট থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার বুদ্ধি বাইরের পরিস্থিতি থেকে এককভাবে আসে না। অন্য এক তেজ বিশ্ব থেকেই মানুষ এসে পৌঁছেছে, আবার মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে বিশ্বের সঙ্গে মিলিত হওয়ার দিকে। 
প্রগতির সংজ্ঞা নিয়ে সাধারণ স্তরে একটা তর্ক আছে। সেখানেও জটিলতা সহজেই চোখে পড়ে, সেজন্য বেশি গভীরেও যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। প্রগতি কাকে বলে, এই প্রশ্নের উত্তর শুধু ঘটনার বিশ্লেষণ থেকে উদ্ধার করা সহজ নয়। আজকের জগতের উন্নত দেশগুলো বিজ্ঞান তথা প্রযুক্তির শক্তিতে অন্যান্য দেশ থেকে এগিয়ে আছে। তবু প্রযুক্তির অগ্রগতিকেই মানুষের প্রগতির সঙ্গে সমার্থক বলে অনেকেই মেনে নিতে চাইবেন না। সাম্যের একটা বিশেষ মূল্য অনেকের কাছেই স্বীকার্য। অথচ যদি দেখি যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রসর সমাজের তুলনায় সরল আদিবাসী সমাজে অসাম্য কম, তবু তো আদিবাসী সমাজকে আমরা তুলনায় বেশি প্রগতিশীল বলি না। আবার এরকম একটি শ্রমশিবিরের কথা সহজেই ভাবা যায়, যেখানে উৎপাদনের বণ্টনে অনেকটা সাম্য আছে, প্রযুক্তির মানও কিছুটা উঁচু, কিন্তু যেখানে শৃঙ্খলারই জয়জয়কার, ব্যক্তিস্বাধীনতার পরাজয়। প্রগতির বিচারে ঐ ব্যবস্থাকে আমরা কোথায় স্থান দেব? ঘটনার পর্যবেক্ষণ থেকে প্রগতির সংজ্ঞা সম্বন্ধে যদি কেউ বিভ্রান্ত বোধ করে তবে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। 
আমরা যখন রাজসিকতা অথবা সাত্ত্বিকতাকে তামসিকতার ঊর্ধ্বে স্থান দিই তখনও সেই প্রত্যয় কেবলমাত্র ঘটনা অথবা বহির্মুখী দৃষ্টি থেকে আসে না। বহির্দৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত হয় জীবনের চিচিত্র অভিজ্ঞতার রসাস্বাদন থেকে উদ্ভূত অন্য এক রসবোধ ও অন্তর্দৃষ্টি। আর তখনই শ্রেয় সম্বন্ধে আমাদের ধারণা যেন অন্য এক নিশ্চিতি লাভ করে। মানুষের যে বাইরের ইতিহাস সর্বজনের দৃষ্টিগ্রাহ্য, অতীতের কিছু কৃতি ও বহু ব্যর্থ সাধনার সেই চিত্রশালার সঙ্গে পরিচয় রক্ষা করা নিশ্চয়ই মূল্যবান। আরও আছে কিন্তু অন্য এক ইতিহাস, মানুষের চেতনার অন্তঃস্তল যা প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এদের যদি আমরা যুক্ত করে না দেখি তবে সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে মিলিতভাবে দেখা হয় না। মানুষের এই সভ্যতা তার নিজের অথচ নিজের নয়। মানুষ যখন জানবে যে একে সে নিজে সৃষ্টি করেছে, তখন সর্বশক্তি দিয়ে একে রক্ষা করতে চাইবে। মানুষের গভীরতম উচ্চকাক্সক্ষা এই যে, ইতিহাসের পথ ধরে এমন এক পৃথিবীর দিকে সে অগ্রসর হবে যাকে তার নিজেরই সৃষ্টি বলে সে মেনে নিতে পারবে। 
আশাবাদীরা বলেন, তারায় তারায় ঘোষিত হচ্ছে মানুষের জয়ের বার্তা। এমন ভবিষ্যদ্বাণীর সপক্ষে যুক্তি নেই। নৈরাশ্যবাদীরা বলেন, মানুষের সভ্যতার ধ্বংশ অনিবার্য। এমন সার্বিক নৈরাশ্যেরও সদর্থ হয় না। ঐতিহাসিক জানাতে পারেন অতীতের কিছু তথ্য ও বিশ্লেষণ। সমাজবিজ্ঞানী তাঁর বক্তব্যের পরিধির ভিতর তুলে ধরতে পারেন অন্য এক প্রশ্ন, কী সেই সমাজের বিন্যাস যাকে লক্ষ করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে? পূর্ব নির্ধারিত বলে কিছুই স্বীকার করে নেওয়া যায় না। শুধু বিবেচনা করা যায় কিছু বিকল্প, কিছু সম্ভাবনা। আমরা বুঝতে চেষ্টা করতে পারি, দ্বন্দ্বের জটিল বুনট, যার প্রতিটি সকল ভাষ্যেই আছে একদেশদর্শিতা। আমরা দাঁড়াতে পারি সেই কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি, সংকটের স্বরূপ কী? একটি ভবিষ্যদ্বাণীই সম্ভব কারণ সেটা আসলে বিকল্পেরই পুনরুচ্চারণ। মানুষের ইতিহাসে বহু সভ্যতা লুপ্ত হয়ে গেছে, তারই পাশে গড়ে উঠেছে নতুন সভ্যতা। সেই অতীতে পৃথিবীতে ছিল প্রশস্ত। আজ এক ছোটো পৃথিবীতে আমরা বাস করি যেখানে সকলের সঙ্গে ভাগ্য একই সূত্রে গাঁথা। যদি ধ্বংস আসে তবে সেটা হবে মানুষের সভ্যতার সামগ্রিক ধ্বংস। যদি উত্তরণ ঘটে তবে মানবজাতির সেটা সার্বিক উত্তরণ। 
মানুষজাতিকে আজ সমগ্রভাবে দেখা ছাড়া উপায় নেই। মানুষের এই সভ্যতা উচ্চতর স্তরে উন্নত হবে কি না আমরা জানি না। আমরা শুধু বুঝার চেষ্টা করতে পারি, আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে? কী আমাদের চাই? আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে তাতে সভ্যতার এক নতুন স্তরে উত্তরণ ছাড়া মানুষের বাঁচার কোনো উপায় আছে কি না? 
ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজে প্রাধান্য লাভ করেছে বিভিন্ন শ্রেণি। এই শ্রেণিসংগঠনের সঙ্গে মানুষের চেতনার বিবর্তনের কিছুটা সম্পর্ক প্রথম থেকেই লক্ষণীয়। মার্ক্সবাদীরা ‘শ্রেণি’ শব্দটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করে থাকে। আমরা ঠিক সেইভাবে ব্যবহার করছি না। বিবাহাদি সামাজিক বন্ধনের দ্বারা এক মনুষ্যগোষ্ঠী অন্যান্য গোষ্ঠী েেক আলাদা বলে চিহ্নিত হয়ে যায়। এইরকম কোনো গোষ্ঠী যদি সমাজের উচ্চ-নীচ বিন্যাসের অন্তর্ভুক্ত হয় তবে তাকে উচ্চ অথবা নীচ শ্রেণি বলে ধরা যেতে পারে। 
আধুনিক যুগে যুক্তিবাদী দৃষ্টি বলতে আমরা যা বুঝি তার গঠনে বাণিজ্যের বিস্তারের দান অনেকখানি। কোনো এককালে স্থানীয় আচারের প্রাব্যল সমাজ-জীবনে ছিল অপ্রতিহত। বণিক ছড়িয়ে পড়ল দেশ-দেশান্তরে। জানা গেল যে, বিভিন্ন দেশাচারের ভিতর ঐক্য নেই। বাণিজ্যিক কারণে প্রয়োজন হলো এমন কিছু নিয়মকানুন যেটা দেশাচারের দ্বারা খণ্ডিত নয়, বরং বিভিন্ন দেশের কাছেই গ্রাহ্য। বাণিজ্যিক বিচারে এমন কিছু উপাদান আছে যা মানুষকে উপজাতীয় বন্ধতার বাইরে নিয়ে যায়। মানুষের শেষ্ঠ আদর্শ বণিকের নয়, কিন্তু বাণিজ্যের অবদান উপেক্ষা করাটাও ভুল। 
সংশয়বাদের সঙ্গে যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির যে যোগ দেখা যায় সেটা আকস্মিক বা আপতিক নয়। তামসিকতা যখন সাত্ত্বিকতার মুশোখ পরে উপস্থিত হয় তখন সেই মুখোশ খুলে দেওয়া যুক্তিবাদের একটা প্রধান কাজ। এই কাজে কোনো শ্রেণির একক ভূমিকা নেই। বরং এক মিশ্র মধ্যশ্রেণির অন্তর্বিরোধ ও বিতর্কের ভিতর একে বিশেষভাবে পাওয়া যায়। চিন্তার ইতিহাস ও সমাজের ইতিহাস এখানে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এরই ভিতর প্রচ্ছন্ন আছে ভবিষ্যতের ছবি। সাম্প্রতিককালে যে মধ্যশ্রেণি প্রধান হয়ে উঠেছে তার গঠন পুরানো যুগের সঙ্গে মেলে না। উদ্ভব হয়েছে নতুন ‘বুদ্ধিজীবী’ শ্রেণির। কোনো কোনো দেশে যদিও সামরিক গোষ্ঠীর প্রাধান্য ও সুস্পষ্ট তবু আমলাতন্ত্রের শক্তিবৃদ্ধিই এ যুগের বৈশিষ্ট্য। সেই সঙ্গে আছে রাজনীতিবিদরা। পুরানো বণিক শ্রেণির স্থানে চোখে পড়ে শিল্প ও ব্যবসায়িক সংস্থার ডিরেক্টর ও পরিচালকগোষ্ঠী। যন্ত্রবিদ্ এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরাও নতুন মধ্য শ্রেণিতে উল্লেখযোগ্য স্থান নিয়ে আছে। সাবেকি উচ্চ শ্রেণির পরিবর্তিত রূপ এই নতুন মিশ্র শ্রেণি। মধ্যমিত্ত নামটারও বৈশিষ্ট্য আছে। আজকাল কেউ নিজেকে উচ্চ শ্রেণি বলে না। সবাই মধ্যম : কেউ উচ্চমধ্য, কেউ-বা নিম্নমধ্য। মার্ক্স বলেছিলেন যে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা বড়ো অংশ ভেঙে শ্রমিকশ্রেণির সঙ্গে এক হয়ে যাবে। কথাটা ক্রমে ক্রমে গ্রাহ্য হতে চলেছে উলটোভাবে। শ্রমিকশ্রেণির একটা অতুচ্ছ অংশ মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাচ্ছে। 
সমাজের ভিতর যে বিরোধ বারবার দেখা দেয় সেটা সর্বক্ষেত্রে উচ্চ শ্রেণি ও নিম শ্রেণির সংঘাত নয়। বরং বহুক্ষেত্রেই সেটা এক উচ্চবর্গের সঙ্গে অন্য উচ্চবর্গের দ্বন্দ্ব। অথবা, আজরেক পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, মধ্যবিত্তেরই একাংশের সঙ্গে অন্য অংশের বিরোধ। উচ্চ-নীচের দ্বন্দ্বও এরই সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এর বহু উদাহরণ দেওয়া যায়, কিন্তু সেটা নিষ্প্রয়োজন। যে বর্গ অথবা বংশ যখন আধিপত্য স্থাপন করে তারই একটা স্বাভাবিক চেষ্টা দেখা যায় সেই আধিপত্যের সমর্থনে কিছু বক্তব্য তুলে ধরার। এটাকে বলা যেতে পারে প্রতিষ্ঠিত প্রাধান্যের পক্ষে যৌক্তিকতার ও নায্যতার সন্ধান। বিভিন্ন যুগে এই চেষ্টা হয়েছে বিভিন্ন রূপে। যুগের চেতনার স্তরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করেই যৌক্তিকতার আকার-প্রকার নির্ধারিত হয়। কোনো এক যুগে জোর পড়েছিল বংশগৌরবের ওপর। রাজা যদি বন্দ্রবংশ অথবা সূর্যবংশের হন তবেই তাঁর সিংহাসনে অধিকার দৈবসিদ্ধ। পুরণে তাই বংশতালিকার গুরুত্ব বিরাট। পরবর্তী যুগে বংশতালিকার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেল ধর্ম। কোনো রাজা হয়তো গ্রহণ করলেন বৌদ্ধধর্ম বা মুসলিম ধর্ম রাজকীয় অধিকারের ধর্মীয় ভিত্তি। 

ক্রমে যৌক্তিকতার ভাষার আরও বদল হলো। ইতিহাসে যাকে ‘যুক্তির যুগ’ বলা হয়েছে তার গোড়াতেই এই পরিবর্তন চোখে পড়ে। বলা হলো, প্রকৃতি যেমন নিয়মের ওপর প্রতিষ্ঠিত সমাজও সেইরকম নিয়মের ওপর স্থাপিত হওয়া চাই। এই নিয়মগুলি কী, এই নিয়ে চলল তর্ক ও অনুসন্ধান। বিশেষ সমাজব্যবস্তার সমর্থনে বলা হলো, প্রকৃতির নিয়মের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য আছে অথবা মানুষের স্বাভাবিক অধিকার রক্ষার জন্যই এটা প্রয়োজন। 


প্রাকৃতিক আর সামাজিক নিয়মকে একই ভিত্তিতে দাঁড় করানোর চেষ্টাও স্থায়ী হলো না; আবারও কিছু আপত্তির কারণ দেখা দিল। এবার সমাজনীতির যৌক্তিকতা খোঁজা হলো উপযোগবাদে। আকাক্সিক্ষত সমাজব্যবস্থার সপক্ষে যুক্তির ভিত্তি ও বিন্যাস এইভাবে বদলে চলেছে। উপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গিও শেষ কথা নয়। দ্বন্দ্বের সঙ্গে যুক্ত করে পরিবর্তনকে বোঝার চেষ্টা হয়েছে। দ্বন্দ্ব আর সহযোগ কিন্তু একই সঙ্গে চলে। শুধু দ্বন্দ্ব অথবা সহযোগিতা দিয়ে এককভাবে পরিবর্তনের ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ হয় না। দ্বন্দ্বের প্রকৃতি দেখা দরকার সহযোগিতাকে পূর্ণ করে তোলার জন্য।
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংগ্রাম চলছে। আবার প্রকৃতির কাছ থেকে শক্তি আহরণ করেই মানুষ ধাপে ধাপে এগিয়েছে। কৃষির ক্ষেত্রে এর উদাহরণ সহজ। মাটিকে ভালো না বেসে কৃষক কৃষিকাজে সফলতা অর্জন করে না। অরণ্যকে ধ্বংস করার মধ্যে দ্বন্দ্বের দিকটা বড়ো হয়ে ওঠে। পৃথিবীকে শস্যশ্যামল করার ভিতর দিয়ে প্রকাশ পায় স্নিগ্ধ সান্নিধ্যের দিকটা। 
শিল্পবিল্পবের যুগ থেকে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে প্রকৃতি যেন বিরুদ্ধ পক্ষ, মানুষকে তার ওপর জয়ী হতে হবে। অথচ বিজ্ঞানী নিজের মতো করে প্রকৃতিকে ভালোবেসেছে, প্রকৃতি তার কাছে প্রতিপক্ষ নয়। কর্তৃত্ব বিস্তারের চিন্তাকে বড়ো করে তুলেছে কিছু বিশেষ পরিস্থিতি; যেমন, জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে বড়ো আকারে ব্যবহার করা হয়েছে যুদ্ধের স্বার্থে। একথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, প্রযুক্তির বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর অগ্রগতি ঘটেছে যুদ্ধসংক্রান্ত গবেষণার মধ্য দিয়ে। 
প্রযুক্তির অগ্রগতির ভিতর দিয়ে সমাজের গঠনবিন্যাস বদলে চলেছে। উৎপাদনের জন্য মানুষকে একরকমভাবে সংঘবদ্ধ হতে হয়। উৎপাদনের পদ্ধতি ও কৌশল বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে এই সংবদ্ধতার রূপেরও পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে ওঠে। তবে এটাও লক্ষ করা দরকার যে, প্রযুক্তির মোটামুটি একই স্তরে সমাজের বিভিন্ন বিন্যাসও সম্ভব। উৎপাদনের স্তর দিয়ে এককভাবে নির্ধারিত হয় না রাজনীতির কাঠামো, মানুষের মূল্যবোধ অথবা স্বাধীনতা সম্বন্ধে ধারণা। 
অনেকখানি জোরজবরদস্তি ছাড়া শিল্পবিপ্লব হয়নি কোনো দেশেই। অর্থশক্তি আর রাষ্ট্রশক্তি মিলিতভাবে ইে জরবদস্তি চালিয়েছে। ইতিহাসের এই পর্যায়টাকে রাজসিক বলা যাবে না, সাত্ত্বিক তো নয়ই। যদিও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে শক্তিমত্তার ভাবটা লক্ষ না করে উপায় নেই, তবু সেই রসিকতার সঙ্গে এসে মিশেছে ধনতন্ত্রের হিসেবি ব্যবহারিক বুদ্ধি। শ্রমিক শ্রেণির চেতনাতেও ক্রমে ক্রমে মিশেছে একদিকে সাহস অন্যদিকে সংঘবদ্ধ স্বার্থবুদ্ধি। বলা যেতে পারে, এর প্রয়োজন ছির। তবু এখানে স্থিতি সম্ভব নয়। একটা কথা আজ স্পষ্ট। শিল্পোন্নত দেশগুলোর ভিতর থেকেই এমন কিছু শক্তি বেড়ে উঠছে যাতে সমাজের আরও মৌল পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। 
শিল্পবিপ্লব প্রাচীন আত্মীয় সমাজকে ভেঙে ফেলেছে। তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। নতুন সমাজেও সমস্যার অন্ত নেই। অনুন্নত দেশগুলোতে দারিদ্রের সমস্যা প্রদান। উন্নত দেশগুলিতেও কিন্তু মানুষ সুখে নেই। যুদ্ধের আশঙ্কা তো মনের ওপর বিভীষিকার মতো ঝুলছেই। তার বাইরেও কিছু গভীর চিন্তার বিষয় আছে। শিল্পোন্নত দেশে মানুষের এক বড়ো সমস্য তার একাকিত্ব। ‘উন্নয়নশীল’ দেশগুলোর নাগরিক জীবনে আজ সেই সমস্যা উপস্থিত। যে সমাজবিন্যাস ও জীবনদর্শন নিয়ে মানুষ আজ বড়ো হচ্ছে তাতে একাকিত্ব থেকে সাময়িক মুক্তি পাওয়ার প্রধান উপায় কিছু ব্যয়সাপেক্ষে উত্তেজনা, পরিকল্পিত চাঞ্চল্য। এতে যে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে চারদিকে। নেশাগ্রস্ততা, অপরাধ-উল্লাস ও পৃথিবীজোড়া বিক্ষিপ্ত সন্ত্রাসবাদ এরই প্রত্যক্ষ লক্ষণ। দারিদ্র্য যেখানে দূর হয়েছে, সেখানেও দুঃখ দূর হয়নি। এ সেই দুঃখ নয় যাতে হৃদয় কোমল হয়। এক আত্মঘাতী কষ্ট শিল্পোন্নত সমাজকে ভিতর থেকে কুরে খাচ্ছে। 
এখানে অন্য এক দ্বন্দ্ব। সমাজসংগঠনের সঙ্গে উৎপাদনের সম্ভাবনার বিরোধ নিয়ে এর মূল কথা নয়। এতদিন প্রধান প্রশ্ন ছিল, সমাজব্যবস্থা কীভাবে বদলালে উৎপাদিকা শক্তি বাস্তবে বৃদ্ধি পাবে। সে প্রশ্ন অন্তত দরিদ্র দেশগুলোতে এখনও গুরুত্ব হারায়নি। তবু নতুন সমাজ নিয়ে চিন্তর ভিত্তি ক্রমে বদলে যাচ্ছে। শান্তি কোন পথে? এটাই প্রধান প্রশ্ন হয়ে উঠছে। 
মানুষ আবারও সমাজব্যবস্থার যৌক্তিকতার সন্ধানটাই করতে চলেছে নতুনভাবে। যুগসন্ধিতে বারবার এইরকমই ঘটেছে। ইতিহাসের যাত্রাপথে এই যে নতুন পর্যায়, এর বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত কিছু দ্বন্দ্বের প্রতি সংক্ষেপে দৃষ্টিপাত করা যাক। 
শিল্পবিপ্লবের দাপটে পৃথিবীটা হয়ে উঠছে নগরময়। আধুনিকতার প্রতীক নগর। মানুষের সভ্যতার গঠনে নগরের কিছু দান আছে। আধুনিক বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ বলতে আমরা যা বুঝি সেসব গঠিত হয়েছে প্রধানত নাগরিক সংস্কৃতির মধ্যেই। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মূল্য সম্বন্ধে নগর আমাদের সচেতন করেছে। বাস্তব অর্থে বিশ্বজনীনতা বলতে যা বোঝায় তার অনেকটাই নগরের দান। স্বাধীনতার অর্থ অসম্পূর্ণ থেকে যায় নগরকে বাদ দিলে। 
তবু পল্লির মাটির স্পর্শ চাই। সেই স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হলে মানুষের সংস্কৃতি হয়ে ওঠে যেন ফুলদানিতে সাজানো কাগজের ফুল। পল্লিতে মানুষ দরিদ্র, নিরক্ষর কুসংস্কারগ্রস্ত হতে পারে, তবু সে পাশের মানুষকে প্রতিবেশী বলে জানে। সেখানে মানুষ শুধুই মানুষ স্বার্থসাধনের যন্ত্র নয়। পুরানো পল্লি বিদায় নিচ্ছে। তবু মানুষের মনের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে হলে সমাজের ভিত্তিতে চাই এমন এক পল্লির আদর্শ যার আশ্রয়ে প্রতিবেশীবোধ, অন্তরের টান, সুখ-দুঃখে সংবেদনশীলতা রক্ষা পাবে, রসের অভাবে শুকিয়ে যাবে না। প্রশ্নটা শুধু মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নিয়েই নয়, বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কের কথাও একই সঙ্গে এসে যায়। নগরে আছে প্রমোদ, পল্লিতে আছে আত্মার বিশ্রাম। 
এই সবই আদর্শের কথা। নগর তার আদর্শরূপে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধারক, আর পল্লি আত্মীয়তার আধার। এ দুয়ের ভিতর কীভাবে সমন্বয় আনা যায়, এ প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। কিন্তু প্রশ্নটা আমাদের মনে পরিষ্কার হয়ে ওঠা চাই। নয় তো ভ্রান্ত উত্তরকেও সদুত্তর বলে মনে হতে পারে। 
এইসঙ্গে এসে যায় জাতীয়তাবাদের কথা। জাতীয়তাবাদ আর দেশপ্রেম এক বস্তু নয়। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি– এটা দেশপ্রেমের কথা। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যোগ আছে আধুনিক রাষ্ট্রের, ক্ষমতা নিয়ে জাতিতে জাতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার। প্রকৃতিপ্রেম অথবা আত্মীয়তাবোধের পুনরুদ্ধারের জন্য জাতীয়তাবাদের দ্বারস্থ হওয়ার অর্থ হয় না। আমাদের এ যুগের ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সমস্ত প্রধান প্রধান দেশেই জাতীয়তাবাদ প্রবল। তবু এ যুগের সমস্যার সমাধানের জন্য তার বেশি কিছু চাই। কেউ কেউ আশা স্থাপন করে এক ধরনের শ্রেণিতত্ত্বে। কিন্তু সেটাও দুর্বল আশ্রয়। জাতীয়তাবাদের মতোই শ্রেণিবাদও ক্ষমতালাভের জন্য সংঘবদ্ধ সংগ্রামের মন্ত্র কণ্ঠে নিয়ে জন্মলাভ করেছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের যে আদর্শ নাগরিক সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য দান তার যতটুকু মূল্যবান তাকেও রক্ষা করা কঠিন হয় শ্রেণিতত্ত্বের ব্যূহবদ্ধ অসহিঞ্চুতার ভিতর। 
শ্রেণিতত্ত্বকে কেউ কেউ মানবতাবাদের সঙ্গে কার্যত সমার্থক বলে দেখাতে চেয়েছেন। পার্থক্য তবু আছে। সেই পার্থক একই সঙ্গে দার্শনিক ও প্রায়োগিক। শ্রেণিতত্ত্বের পরিচিত ভাষ্য বলে যে, শ্রমিকশ্রেণির জয়লাভই মানবমুক্তির অপরিহার্য শর্ত। জাতীয়তাবাদীর কাছে যেমন স্বজাতির জয়ের চেয়ে বড়ো উদ্দেশ্য আর নেই, শ্রেণিসংগ্রামে বিশ্বাসী যোদ্ধার কাছে শ্রমিকশ্রেণির জয়লাভও সেইরকম। আজ হিংসার ক্ষমতা এতই মারাত্মক হয়ে উঠেছে যে, জাতিবিশেষের জয়লাভের আকাক্সক্ষা উগ্র রূপ ধারণ করলে মনুষ্যজাতিরই সামগ্রিক বিনাশের সম্ভাবনা। শ্রেণিসংগ্রামের ক্ষেত্রেও এই সমাধান বাণী উপেক্ষা করা যায় না। সব হিংসাত্মক সংগ্রামের মতোই শ্রেণিসংগ্রামেরও একটা মাদকতা আছে। মানবতাবাদের সঙ্গে এখানেই শ্রেণিবাদের অসামঞ্জস্য।
জাতিতে জাতিতে সংগ্রামে কোনো পক্ষই স্বীকার করে না যে, আঘাতটা সে প্রথম করেছে। প্রত্যেকেরই বক্তব্য, আত্মরক্ষার জন্যই কিংবা অন্যায়ের প্রত্যুত্তরে তাকে বাধ্য হয়ে আঘাত করতে হয়েছে। একই রকমের যুক্তি ব্যবহার করা হয়ে থাকে শ্রেণিসংগ্রামের ক্ষেত্রে, হিংসাকে সমর্থন করা হয় আত্মরক্ষার যুক্তিতে। এই পুরানো তর্ককে পিছনে ফেলে আসা সহজ নয়। অথচ অহিংসায় বিশ্বাস স্থাপন করতে হলে ঐ তর্ককে অতিক্রম করে যেতে হয়। ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। অহিংস যোদ্ধা ঝুঁকি নেন শান্তির সপক্ষে। 
এটা অবশ্য আনন্দের কথা যে, সোভিয়েত নেতা গর্বাচভ অহিংসার সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছেন। এতেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, তার কিছুদিন পরেই তিনি পারমাণবিক বোমা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা নতুন করে শুরু করার সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। যেকোনো রাষ্ট্রনেতার পক্ষেই এটা এক কঠিন পরিস্থিতি। 
নতুন পৃথিবী গড়ার আন্দোলনে তবে নেতৃত্ব দেবে কারা? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয়। অথচ আন্দোলনের শুরু হয়ে গেছে। তার উচ্চারণ সব সময় স্পষ্ট নয়, পদক্ষেপ নির্ভুল নয়। তবু তাকে নবযুগের আন্দোলন বলে চেনা যায়। 
নতুন আন্দোলনের পুরোভাবে দেখা যায় যুবশক্তিকে, সেই যুবশক্তি উৎপাদনের যন্ত্রে যে স্থায়ীভাবে বাধা পড়েনি। এর সংগঠন দুর্বল, স্থায়িত্ব কম, তবু ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের মতো আন্দোলনের ধারা আছড়ে পড়ছে। আরও আছে নারীমুক্তির সংগাম। কিছু আতিশয্য অতিক্রম করে সেই সংগ্রামও নতুন পৃথিবীর প্রতিশ্রুতি বহন করে চলেছে। গ্রামে গ্রামে কিছু আদর্শবাদী মানুষের সাক্ষাৎ মেলে, যারা নিযুক্ত গঠনমূলক কাজে। এদের অনেকেরই মনের দিগন্ত প্রশস্ত নয়। কিন্তু এরই ভিতর কারও কারও দৃষ্টি পরিচ্ছন্ন, কল্পনা সুদূরপ্রসারী। আরও আছে শান্তি আন্দোলনের কর্মীরা। আছে শিল্পী ও সাহিত্যিক। নতুন সমাজের ছোটো ছোটো প্রতিকৃতি, বিক্ষিপ্ত দ্বীপের মতো, সৃষ্টি করার কাজে নিযুক্ত কিছু মানুষ। কত দুর্বল মনে হয় এদের প্রচেষ্টা। তবু এদের ভিতর দিয়েই মানুষের প্রাণশক্তি নতুন জগৎ গড়ার পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। 
  












http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
কুমিল্লায় ব্যবসায়ী হত্যা মামলায় দুইজনকে মৃত্যুদণ্ড, পাঁচজনের যাবজ্জীবন
কুমিল্লায় রেললাইনে তরুণের লাশ মুখে ও মাথায় একাধিক আঘাতের চিহ্ন
আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বিআরডিবি কর্মচারীর মোটরসাইকেল চুরি
কুমিল্লায় দলে ফিরলেন বিএনপি নেতা বিল্লাল ও কাকলি
চান্দিনায় মাদক ও ড্রেজার ব্যবসায় জড়িতের অভিযোগে দুই নেতাকে বহিষ্কার
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ি থেকে ধরে এনে যুবককে গণপিটুনিতে হত্যা
কুমিল্লায় হাজী ইয়াছিনের পক্ষে গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ
কুমিল্লা -৫ আসনের বিএনপির মনোনীত এমপি প্রার্থীর গণ মিছিল
কুমিল্লায় মনিরচৌধুরীর সমর্থনে লিফলেট বিতরণ, গণসংযোগ
সাংবাদিকরা রাজনৈতিক দলের পকেটে ঢুকে পড়লে তো সমস্যা : মির্জা ফখরুল
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২