
বাক্ এবং অর্থ যেমন
পরস্পর সম্পৃক্ত, প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধও তেমনি। এই সম্পর্কটাকে উপেক্ষা
করলে বাক্য তার অর্থ হারায়, প্রতিষ্ঠান তার মূল্য। আদর্শ সমাজ নিয়ে আলোচনায়
অনেক সময় বাইরের প্রতিষ্ঠানের দিকটাই লক্ষ করা হয় ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’,
‘সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা’, এইসব নিয়ে তর্ক চলে। মূল্যবোধের কথাটা উপেক্ষিত
থেকে যায়। এর অবশ্য কিছু কারণ আছে।
প্রতিষ্ঠান জিনিসটা বাইরের বলেই তার
চেহারা বর্ণনা করা অপেক্ষাকৃত সহজ। মূল্যবোধ যেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, তা
নিয়ে আলোচনা করতে অসুবিধা বোধ হতে পারে। আরও একটা ব্যাপার আছে।
প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কিছু ঐতিহাসিক স্তরভেদের সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানীরা
আমাদের পরিচিত করিয়েছেন। সবাই অবশ্য একমত নন ভুলেরও সম্ভাবনা খুবই। তবুও এ
বিষয়ে আলোচনার কিছু পরিচিত উল্লিখবিন্দু আছে। মূল্যবোধের ক্ষেত্রে সেই
পরিচয়টা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। এইরকমের কিছু কথা মনে হতে পারে। কিন্তু আসল বাধা
অন্যত্র। আমরা বাইরের সঙ্গে ভিতরের যোগ ঘটানোর অভ্যাস হারিয়ে ফেলেছি। ফলে
কিছুরই আর অর্থ থাকছে না। ভিতরের সঙ্গে বাইরেকে মিলিয়ে দেখা দরকার।
মূল্যবোধের
ক্ষেত্রে অন্বেষণটা বাইরে শুরু হলেও শেষ অবধি প্রত্যয়ের ভিত্তি খুঁজে
পাওয়া যায় চেতনার ভিতরে। আকাক্সক্ষার নানা স্তর আছে। এ আমরা সবাই জানি। তবু
বিষয়টা ভেবে দেখার যোগ্য। এ ব্যাপারে চিন্তার পরিচ্ছন্নতা এলে আরও নানা
বিষয় পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
সামান্য একটা উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। যেমন,
খাদ্য ও পানীয়। নিতান্ত জৈব স্তরে এর প্রয়োজন। ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটানোর জন্য
খাদ্য ও পানীয় চাই। দেহধারণের জন্য এটা দরকার। কিন্তু খাদ্যে শুধু খিদে
মেটে, পেটের জ্বালা দূর হয়, তা তো নয়। তার অতিরিক্ত একটা সুখ, রসনার সুখ,
সেইসঙ্গে পাওয়া যায়। রসনার সুখের সন্ধানে রান্না নিয়ে হরেক রকম পরীক্ষা
চলে। উদ্ভাবিত হয় নানা রকমের রসুই। এটাই হয়ে ওঠে সংস্কৃতির একটা শাখা।
ফরাসি রসুই, চীনে রান্না, মোগলাই, আরও কত রকম। পানীয়েরও আছে কত বিচিত্র
রূপ। জৈব স্তর ছাড়িয়ে খাদ্য ও পানীয় পৌঁছে যায় আভিজাত্যের অন্য এক স্তরে।
এর
বিরুদ্ধেও আবার প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। অতি ভোজনে অসুখ বাড়ে। পৃথিবীর
ধনী দেশে, ধনবানদের ভিতর, ভোজনের অতিশয্যই দৈহিক পীড়া এবং মৃত্যুর অন্যতম
প্রধান করণ হিসেবে চিকিৎসকদের কাছে স্বীকৃত। পানীয়ঘটিত দুর্ঘটনার কথা সবাই
জানেন। এসবের দুষ্ট ক্রিয়া শুধু দেহের ওপরই নয়, আক্রান্ত হয় মনও। খাদ্যে ও
পানীয়ে যখন মানুষ আসক্ত হয়ে পড়ে তখন মনের পক্ষে সেটা একটা বন্ধনদশা। সুখের
সন্ধানে যার শুরু তার পরিণতি এক বিশেষ ধরনের অসুখে।
অর্থব্যয় করে মানুষ
নিজের মনকে শৃঙ্খলিত করে। সেই শৃঙ্খলকেই আবার কেউ অলংকার জ্ঞান করে। দামি
গয়না নিয়ে যেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে দামি খাদ্য, ধূম্র ও পানীয় নিয়েও
সেইরকম। এইসব হয়ে ওঠে আভিজাত্যের মাপকাঠি। দরিদ্র মানুষ শাকান্ন থেকে যে
তৃপ্তিলাভ করে ধনী সেটা পায় না বিলাসী আহার্য অথবা পানীয় থেকে, কিন্তু এই
সবের অভাবটা ধনীর কাছে বড়োই দুঃখজন মনে হয়।
মনের এই শৃঙ্খলিত অবস্থার
বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। সরল আহারেই খুঁজে পাওয়া যায় দেহের
স্বাস্থ্য, রসনার স্বাদ, মনের মুক্তি। খাদ্য ও পানীয়ের বিবর্তনে এটা তৃতীয়
স্তর। দারিদ্র্যের অতি দীন আহার্য বাধ্যতামূলক, কুখাদ্যেও কেউ অভ্যস্ত হয়।
আতিশয্য ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় সারল্যে প্রত্যাগমন রুচি ও মননের অন্য এক
অবস্থা। খাদ্য ও পানীয় উদাহরণ মাত্র। উদ্দেশ্য ছিল, পরিচিত জীবনের মাঝখানে
এনে চেতনা ও আকঙ্খার স্তরভেদ দেখানো। যে তিনটি স্তরের কথা বলা হলো, এদেশের
ঐতিহ্যাশ্রয়ী ভাষায় তাদের তামসিক, রাজসিক ও সাত্ত্বিক বলে চিহ্নিত করা সহজ।
কেবল বাইরের লক্ষণ দিয়ে চেতনার স্তরনির্ধারণ করতে পাছে অবশ্য ভুলের
সম্ভাবনা থেকেই যায়।
এই সঙ্গে বুঝে নিতে হবে আরও একটা কথা। প্রতিটি
স্তরের ভিতরই প্রচ্ছন্ন আছে সেই শক্তি যার সাহায্যে আরোহণ করা যায় পরবর্তী
স্তরে। তামসিক অবস্থাতেও থাকে সেই প্রাণশক্তির বীজ ও সুখের আকক্সক্ষা যাতে
মানুষকে ঠেলে দেয় রাজসিকতার দিকে। রাজসিকতাও একটি স্থির অবিকল ভাব নয়। তাকে
আছে নানা রঙের খেলা। কখনো জয়ের আকাক্সক্ষা প্রবল, কখনো ভোগের। আবার
রাজসিকতার ভিতর থেকেই দেখা দেয় বন্ধন বিষয়ে সেই সচেতনতা যাতে ক্রমে
উদ্ঘাটিত হয় মুক্তির নতুন দিগন্ত।
যে গুণত্রয়ের বিষয়ে বলা হলো তাদের
কোনো একটিকে শুদ্ধরূপে স্বতন্ত্রভাবে পাওয়া কঠিন। বরং মিশ্ররূপেই এদের আমরা
পেয়ে থাকি। তবে কোথাও একটির অথবা অন্যটির প্রাধান্য। প্রাধান্যভেদেই
গুণভেদ; যেমন শৃগালের তুলনায় সিংহের ভিতর রাজসিকতার প্রাধান্য। আরও একটি
কথা যোগ করা দরকার। প্রতিটি গুণের ভিতরই এমন কিছু আছে যেটিকে প্রাণীর
প্রয়োজন, অতএব যার মূল্য স্বীকার্য। তামসিকতার ভিতরও বোধ করি এমন একটি অন্ধ
প্রাকৃত প্রেম আছে যার মূলোচ্ছেদ হলে প্রাণীর চলে না। এক স্তর থেকে অন্য
স্তরে আরোহণ যে অনিবার্য এমন কোনা কথা নেই। অনেকেই আটকে থাকে এক স্তরে। তবে
মানুষকে এবং তার ইতিহাসকে যখন আমরা সমগ্রভাবে দেখি তখন একটা চলমানতাই চোখে
পড়ে। বাবুই পাখির যুগের পর যুগ একই গতিশলীতা আছে। এক স্তর থেকে অন্য স্তরে
যাত্রার সব চেষ্টা সফল হয় না। তবু সেই চেষ্টার একটা বিশেষ মূল্য স্বীকার
করি, এমনকি ব্যর্থ চেষ্টাও মূল্যহীন নয়।
রবীন্দ্রনাথের একাধিক উপন্যাসে
পাওয়া যাবে তামসিক অথবা রাজসিক চরিত্রের পশে একাটি সাত্ত্বিক মানুষ।
টলস্তয়ের উপন্যাসেও এইরকম দেখা যায়। এইসব চরিত্রের জৈপরীত্যে ও
ঘাতপ্রতিঘাতে কাহিনির ভিতরকার গতি স্মরণীয় হয়ে ওঠে। যেমন ব্যক্তির জীবনে
তেমনি পরিবারের ইতিহাসেও গতি ও বৈপরীত্য চোখে পড়ে। দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন
রাজসিক প্রকৃতির মানুষ। দেবেন্দ্রনাথ ঝুঁকেছিলেন সাত্ত্বিকতার দিকে। দুজনেই
শ্রদ্ধার যোগ্য, তবে দুইভাবে। পিতা ও পিতামহের এই বৈপরীত্য কি ঐতিহাসিক
সমন্বয় খুঁজেছিল রবীন্দ্রনাথে?
ভোগবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার কিছু
বিপদ আছে। প্রতিক্রিয়ার শক্তিটা কখনো কখনো আত্মপীড়ন ও পরপীড়নের রূপ নিয়ে
ফিরে আসে। শাহজাহান ছিলেন রাজসিক ও ভোগবাদী। ঔরঙ্গজেবের ভিতর দেখা দিল
প্রতিক্রিয়া। তাঁর জীবনযাত্রা ছিল সরল, তাঁর বিশ্বাস ছিল ধর্মে। কিন্তু
তাঁর ভিতর ঔদার্যের অভাব ছিল, অন্তত অনেক ঐতিহাসিকেরই এই রায়। নানা গুণ
সত্ত্বেও তাঁকে সাত্ত্বিক বলা যাবে না। ঔরঙ্গজেবের পর অবশিষ্ট রইল এক
ক্ষয়িষ্ণু আভিজাত। অনেক রাজবংশেরই ইতিহাস এইরকম। আরম্ভে শৌর্যবীর্য।
স্বর্ণযুগে দেখা যায় শিল্পসংগীতের বর্ণাঢ্য বিকাশ। তারপর নেমে আসে
অমিতব্যয়িতা, উচ্ছৃঙ্খলতা ও অবক্ষয়ের ভিতর দিয়ে বংশের অবসান। রাজসিকতার
ভিতর যে দ্বন্দ্ব তাকে একটা সার্থক সমন্বয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া কোনো কালেই
সহজ হয়নি। ইতিহাসের পথের ধারে একের পর এক পড়ে আছে কত বিদতমহিমা রাজবংশের
ধ্বংস্তূপ।
ব্যক্তি পরিবার রাজবংশ এইসব ছাড়িয়ে মানুষের সমাজের বৃহত্তর
ইতিহাসের দিকে যখন তাকাই তখন কি সেখানে স্তর থেকে স্তরান্তরে উন্নতির কোনো
ছবি চোখে পড়ে? সমাজের সংগঠন যে বদলে চলেছে তাতে তো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা
বলছি না শুধু বাইরের পরিবর্তনের কথা। এইসবের ভিতর দিয়ে মানুষের চেতনার
পরিবর্তনের কোনো দিকনির্দেশ কি পাওয়া যায়?
২
কোনো এক যুগে মানুষ ছিল
প্রকৃতির বন্য সন্তান, ভীত মূঢ় অসহায়। ক্রমে বৃদ্ধি পেল প্রকৃতির ওপর
মানুষের নিয়ন্ত্রণের শক্তি। এই শক্তি সমাজের সর্বস্তরে সমাজভাবে কাজে
লাগেনি। তবু শুরু হয়ে গেল ইতিহাসের অন্য এক পর্ব। সমাজের ভিতর যে বিচিত্র ও
বহুমুখী দ্বন্দ্ব তাকে বাদ দিয়ে এই পর্বের ইতিহাস বোঝা যায় না। আবার
মানুষের ভিতর মুক্তি ও আত্মপ্রত্যয়ের যে বহুবিঘ্নিত প্রকাশ, শিল্প ও
বিশ্বজনীনতার যে অস্ফুট উচ্চারণ, তাকে অগ্রাহ্য করলেও ইতিহাস মানবিক হয়ে
ওঠে না। যেমন ব্যক্তি এই মুহূর্তের কোনো চিন্তা কিংবা কর্মেই তার সমগ্র
চেতনা অথাব সম্ভাবনা রূপলাভ করে না, তেমনি কোনো বিশেষ সমাজবিন্যাস অথাব
কর্মকাণ্ডেও মনুষ্যজাতির চেতনার সম্পূর্ণ পরিচয় ও সম্ভাবনা জানা যায় না।
দ্বন্দ্বের
প্রকারভেদ আছে। একদিকে দেখি বিভিন্ন বর্গ ও সম্প্রদায়ের ভিতর বিরোধ ও
সমবায়। ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা ছেড়ে দিয়ে যদি সমষ্টিগত বিরোধের
বিচার করা যায় তবু তার কত নাম, কত রূপ– বর্ণবিদ্বেষ, ধর্মযুদ্ধ,
শ্রেণিসংগ্রাম, জাতিতে জাতিতে সংঘাত। অন্য দিকে পাই ভিন্ন এক দ্বন্দ্ব,
পরিস্থিতির দাবির সঙ্গে মানুষের তৎকালীন চেতনার স্তরের বিরোধ। এইসব নিয়ে
আরও কিছু আলোচনা পরে করা যাবে। তার আগে সংক্ষেপে যোগ করব একটি কথা। সমস্ত
দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করে যে আদর্শ উঁকিঝুঁকি মারে তাকে শুধু ঘটনা থেকে পাওয়া
যায় না। পরিস্থিতি সংকট সৃষ্টি করে বটে, কিন্তু সংকট থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার
বুদ্ধি বাইরের পরিস্থিতি থেকে এককভাবে আসে না। অন্য এক তেজ বিশ্ব থেকেই
মানুষ এসে পৌঁছেছে, আবার মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে বিশ্বের সঙ্গে মিলিত হওয়ার
দিকে।
প্রগতির সংজ্ঞা নিয়ে সাধারণ স্তরে একটা তর্ক আছে। সেখানেও জটিলতা
সহজেই চোখে পড়ে, সেজন্য বেশি গভীরেও যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। প্রগতি কাকে
বলে, এই প্রশ্নের উত্তর শুধু ঘটনার বিশ্লেষণ থেকে উদ্ধার করা সহজ নয়। আজকের
জগতের উন্নত দেশগুলো বিজ্ঞান তথা প্রযুক্তির শক্তিতে অন্যান্য দেশ থেকে
এগিয়ে আছে। তবু প্রযুক্তির অগ্রগতিকেই মানুষের প্রগতির সঙ্গে সমার্থক বলে
অনেকেই মেনে নিতে চাইবেন না। সাম্যের একটা বিশেষ মূল্য অনেকের কাছেই
স্বীকার্য। অথচ যদি দেখি যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রসর সমাজের তুলনায়
সরল আদিবাসী সমাজে অসাম্য কম, তবু তো আদিবাসী সমাজকে আমরা তুলনায় বেশি
প্রগতিশীল বলি না। আবার এরকম একটি শ্রমশিবিরের কথা সহজেই ভাবা যায়, যেখানে
উৎপাদনের বণ্টনে অনেকটা সাম্য আছে, প্রযুক্তির মানও কিছুটা উঁচু, কিন্তু
যেখানে শৃঙ্খলারই জয়জয়কার, ব্যক্তিস্বাধীনতার পরাজয়। প্রগতির বিচারে ঐ
ব্যবস্থাকে আমরা কোথায় স্থান দেব? ঘটনার পর্যবেক্ষণ থেকে প্রগতির সংজ্ঞা
সম্বন্ধে যদি কেউ বিভ্রান্ত বোধ করে তবে তাকে দোষ দেওয়া যায় না।
আমরা
যখন রাজসিকতা অথবা সাত্ত্বিকতাকে তামসিকতার ঊর্ধ্বে স্থান দিই তখনও সেই
প্রত্যয় কেবলমাত্র ঘটনা অথবা বহির্মুখী দৃষ্টি থেকে আসে না। বহির্দৃষ্টির
সঙ্গে যুক্ত হয় জীবনের চিচিত্র অভিজ্ঞতার রসাস্বাদন থেকে উদ্ভূত অন্য এক
রসবোধ ও অন্তর্দৃষ্টি। আর তখনই শ্রেয় সম্বন্ধে আমাদের ধারণা যেন অন্য এক
নিশ্চিতি লাভ করে। মানুষের যে বাইরের ইতিহাস সর্বজনের দৃষ্টিগ্রাহ্য,
অতীতের কিছু কৃতি ও বহু ব্যর্থ সাধনার সেই চিত্রশালার সঙ্গে পরিচয় রক্ষা
করা নিশ্চয়ই মূল্যবান। আরও আছে কিন্তু অন্য এক ইতিহাস, মানুষের চেতনার
অন্তঃস্তল যা প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এদের যদি আমরা যুক্ত করে না দেখি তবে
সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে মিলিতভাবে দেখা হয় না। মানুষের এই সভ্যতা তার নিজের অথচ
নিজের নয়। মানুষ যখন জানবে যে একে সে নিজে সৃষ্টি করেছে, তখন সর্বশক্তি
দিয়ে একে রক্ষা করতে চাইবে। মানুষের গভীরতম উচ্চকাক্সক্ষা এই যে, ইতিহাসের
পথ ধরে এমন এক পৃথিবীর দিকে সে অগ্রসর হবে যাকে তার নিজেরই সৃষ্টি বলে সে
মেনে নিতে পারবে।
আশাবাদীরা বলেন, তারায় তারায় ঘোষিত হচ্ছে মানুষের
জয়ের বার্তা। এমন ভবিষ্যদ্বাণীর সপক্ষে যুক্তি নেই। নৈরাশ্যবাদীরা বলেন,
মানুষের সভ্যতার ধ্বংশ অনিবার্য। এমন সার্বিক নৈরাশ্যেরও সদর্থ হয় না।
ঐতিহাসিক জানাতে পারেন অতীতের কিছু তথ্য ও বিশ্লেষণ। সমাজবিজ্ঞানী তাঁর
বক্তব্যের পরিধির ভিতর তুলে ধরতে পারেন অন্য এক প্রশ্ন, কী সেই সমাজের
বিন্যাস যাকে লক্ষ করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে? পূর্ব নির্ধারিত বলে কিছুই
স্বীকার করে নেওয়া যায় না। শুধু বিবেচনা করা যায় কিছু বিকল্প, কিছু
সম্ভাবনা। আমরা বুঝতে চেষ্টা করতে পারি, দ্বন্দ্বের জটিল বুনট, যার প্রতিটি
সকল ভাষ্যেই আছে একদেশদর্শিতা। আমরা দাঁড়াতে পারি সেই কঠিন প্রশ্নের
মুখোমুখি, সংকটের স্বরূপ কী? একটি ভবিষ্যদ্বাণীই সম্ভব কারণ সেটা আসলে
বিকল্পেরই পুনরুচ্চারণ। মানুষের ইতিহাসে বহু সভ্যতা লুপ্ত হয়ে গেছে, তারই
পাশে গড়ে উঠেছে নতুন সভ্যতা। সেই অতীতে পৃথিবীতে ছিল প্রশস্ত। আজ এক ছোটো
পৃথিবীতে আমরা বাস করি যেখানে সকলের সঙ্গে ভাগ্য একই সূত্রে গাঁথা। যদি
ধ্বংস আসে তবে সেটা হবে মানুষের সভ্যতার সামগ্রিক ধ্বংস। যদি উত্তরণ ঘটে
তবে মানবজাতির সেটা সার্বিক উত্তরণ।
মানুষজাতিকে আজ সমগ্রভাবে দেখা
ছাড়া উপায় নেই। মানুষের এই সভ্যতা উচ্চতর স্তরে উন্নত হবে কি না আমরা জানি
না। আমরা শুধু বুঝার চেষ্টা করতে পারি, আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে? কী আমাদের চাই?
আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে তাতে সভ্যতার এক নতুন স্তরে উত্তরণ ছাড়া মানুষের
বাঁচার কোনো উপায় আছে কি না?
ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজে প্রাধান্য
লাভ করেছে বিভিন্ন শ্রেণি। এই শ্রেণিসংগঠনের সঙ্গে মানুষের চেতনার
বিবর্তনের কিছুটা সম্পর্ক প্রথম থেকেই লক্ষণীয়। মার্ক্সবাদীরা ‘শ্রেণি’
শব্দটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করে থাকে। আমরা ঠিক সেইভাবে ব্যবহার করছি না।
বিবাহাদি সামাজিক বন্ধনের দ্বারা এক মনুষ্যগোষ্ঠী অন্যান্য গোষ্ঠী েেক
আলাদা বলে চিহ্নিত হয়ে যায়। এইরকম কোনো গোষ্ঠী যদি সমাজের উচ্চ-নীচ
বিন্যাসের অন্তর্ভুক্ত হয় তবে তাকে উচ্চ অথবা নীচ শ্রেণি বলে ধরা যেতে
পারে।
আধুনিক যুগে যুক্তিবাদী দৃষ্টি বলতে আমরা যা বুঝি তার গঠনে
বাণিজ্যের বিস্তারের দান অনেকখানি। কোনো এককালে স্থানীয় আচারের প্রাব্যল
সমাজ-জীবনে ছিল অপ্রতিহত। বণিক ছড়িয়ে পড়ল দেশ-দেশান্তরে। জানা গেল যে,
বিভিন্ন দেশাচারের ভিতর ঐক্য নেই। বাণিজ্যিক কারণে প্রয়োজন হলো এমন কিছু
নিয়মকানুন যেটা দেশাচারের দ্বারা খণ্ডিত নয়, বরং বিভিন্ন দেশের কাছেই
গ্রাহ্য। বাণিজ্যিক বিচারে এমন কিছু উপাদান আছে যা মানুষকে উপজাতীয় বন্ধতার
বাইরে নিয়ে যায়। মানুষের শেষ্ঠ আদর্শ বণিকের নয়, কিন্তু বাণিজ্যের অবদান
উপেক্ষা করাটাও ভুল।
সংশয়বাদের সঙ্গে যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির যে যোগ
দেখা যায় সেটা আকস্মিক বা আপতিক নয়। তামসিকতা যখন সাত্ত্বিকতার মুশোখ পরে
উপস্থিত হয় তখন সেই মুখোশ খুলে দেওয়া যুক্তিবাদের একটা প্রধান কাজ। এই কাজে
কোনো শ্রেণির একক ভূমিকা নেই। বরং এক মিশ্র মধ্যশ্রেণির অন্তর্বিরোধ ও
বিতর্কের ভিতর একে বিশেষভাবে পাওয়া যায়। চিন্তার ইতিহাস ও সমাজের ইতিহাস
এখানে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এরই ভিতর প্রচ্ছন্ন আছে ভবিষ্যতের ছবি।
সাম্প্রতিককালে যে মধ্যশ্রেণি প্রধান হয়ে উঠেছে তার গঠন পুরানো যুগের সঙ্গে
মেলে না। উদ্ভব হয়েছে নতুন ‘বুদ্ধিজীবী’ শ্রেণির। কোনো কোনো দেশে যদিও
সামরিক গোষ্ঠীর প্রাধান্য ও সুস্পষ্ট তবু আমলাতন্ত্রের শক্তিবৃদ্ধিই এ
যুগের বৈশিষ্ট্য। সেই সঙ্গে আছে রাজনীতিবিদরা। পুরানো বণিক শ্রেণির স্থানে
চোখে পড়ে শিল্প ও ব্যবসায়িক সংস্থার ডিরেক্টর ও পরিচালকগোষ্ঠী। যন্ত্রবিদ্
এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরাও নতুন মধ্য শ্রেণিতে উল্লেখযোগ্য স্থান নিয়ে আছে।
সাবেকি উচ্চ শ্রেণির পরিবর্তিত রূপ এই নতুন মিশ্র শ্রেণি। মধ্যমিত্ত
নামটারও বৈশিষ্ট্য আছে। আজকাল কেউ নিজেকে উচ্চ শ্রেণি বলে না। সবাই মধ্যম :
কেউ উচ্চমধ্য, কেউ-বা নিম্নমধ্য। মার্ক্স বলেছিলেন যে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির
একটা বড়ো অংশ ভেঙে শ্রমিকশ্রেণির সঙ্গে এক হয়ে যাবে। কথাটা ক্রমে ক্রমে
গ্রাহ্য হতে চলেছে উলটোভাবে। শ্রমিকশ্রেণির একটা অতুচ্ছ অংশ মধ্যবিত্ত
শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাচ্ছে।
সমাজের ভিতর যে বিরোধ বারবার দেখা দেয়
সেটা সর্বক্ষেত্রে উচ্চ শ্রেণি ও নিম শ্রেণির সংঘাত নয়। বরং বহুক্ষেত্রেই
সেটা এক উচ্চবর্গের সঙ্গে অন্য উচ্চবর্গের দ্বন্দ্ব। অথবা, আজরেক
পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, মধ্যবিত্তেরই একাংশের সঙ্গে অন্য অংশের বিরোধ।
উচ্চ-নীচের দ্বন্দ্বও এরই সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এর বহু উদাহরণ দেওয়া যায়,
কিন্তু সেটা নিষ্প্রয়োজন। যে বর্গ অথবা বংশ যখন আধিপত্য স্থাপন করে তারই
একটা স্বাভাবিক চেষ্টা দেখা যায় সেই আধিপত্যের সমর্থনে কিছু বক্তব্য তুলে
ধরার। এটাকে বলা যেতে পারে প্রতিষ্ঠিত প্রাধান্যের পক্ষে যৌক্তিকতার ও
নায্যতার সন্ধান। বিভিন্ন যুগে এই চেষ্টা হয়েছে বিভিন্ন রূপে। যুগের চেতনার
স্তরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করেই যৌক্তিকতার আকার-প্রকার নির্ধারিত হয়।
কোনো এক যুগে জোর পড়েছিল বংশগৌরবের ওপর। রাজা যদি বন্দ্রবংশ অথবা
সূর্যবংশের হন তবেই তাঁর সিংহাসনে অধিকার দৈবসিদ্ধ। পুরণে তাই বংশতালিকার
গুরুত্ব বিরাট। পরবর্তী যুগে বংশতালিকার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেল ধর্ম। কোনো
রাজা হয়তো গ্রহণ করলেন বৌদ্ধধর্ম বা মুসলিম ধর্ম রাজকীয় অধিকারের ধর্মীয়
ভিত্তি।
