আমাদের
জীবন গল্পের মতো নয়। জীবন কাহিনী দিয়ে গল্প বানানো হয়, আসলে বাস্তবতা অনেক
কঠিন। জীবনের মোড় কখন যে কোন দিকে যাবে তা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ
জানে না। তবু তো জীবন। কখনো সুখের কখনো দুঃখের। তাই বলে কেউ কি জীবন থেমে
থাকে? জীবন আপন গতিতে এগিয়ে চলে।
মাঝে মধ্যেই মনে হয়- জীবন যেন ভুলে
ভরা এক মস্ত বই। পাতায় পাতায় রাশি রাশি, ভুল পেছনে ফেরা যাবে না। শোধরানোরও
কোনো উপায় নেই। তারপরও মনে হয়, আবার যদি জীবনটা প্রথম থেকে শুরু করা যেত,
তাহলে কী দারণই না হতো! সব ভুল শুধরে নিতে পারতাম। কিন্তু তাতো আর সম্ভব
নয়। তবে সবসময় আগের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করি। কখনো ভাবি না
জীবনে কী হারিয়েছি। বরং ভাবি জীবনে কী পেয়েছি। তখন মহান আল্লাহ পাকের প্রতি
শুকরিয়ায় মনটা ভরে ওঠে।
স্কুল জীবনে একটি ইংরেজি প্রবাদ বাক্য
শিখেছিলাম। ঞড় বৎৎ রং যঁসধহ অর্থাৎ মানুষ মাত্রই ভুল হয়। কাজ করতে গেলে ভুল
হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে ভুল করে অনেকে পার পেয়ে যান, আবার অনেককে ভুলের
মাশুল গুণতে হয়। ছোট বেলায় স্কুলে ভুল বানান লিখতে গিয়ে একটা ভুল করেছিলাম
এবং তার জন্য শাস্তিও পেয়েছিলাম। শ্রদ্ধেয় হুমায়ন কবির স্যারের ক্লাসে ভুল
বানান লিখেছিলাম ভুল। স্যার বোর্ডে একটা বাক্য লিখে দিলেন এবং নির্দেশ
দিলেন ওই বাক্যটা লিখে দশবার স্যারকে দেখাতে হবে। বাক্যটা ছিল,বানান লিখিতে
জীবনে আর কোন দিন ভুল করিয়াও ভুল করিব না। আমার আর কোন দিন ভুল বানান ভুল
হয়নি।
জীবনে চলার পথে অনেক বার ভুল করেছি। তবে তা নিয়ে কখনই বেশি
চিন্তিত হইনি বরং গর্বিত হয়েছি নতুন পথে হেঁটে। কিছু ভুল আমাকে আরও পরিণত
করেছে, নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে, নতুন কিছু করতে শিখিয়েছে। ভুল থেকে
শিক্ষা নিয়েছি। সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ আরো মসৃণ হয়েছে। কিন্তু জীবন নামের
নৌকা কী সবসময়ই ঠিকমতো চলে? কখনো কখনো পাল্টে যায়।
নতুন নতুন শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান তৈরি করাই যেন হয়ে উঠেছে আমার নিত্যসঙ্গী। পড়ালেখার কার্যক্রমই
আমাকে প্রশান্তি দেয়, যতই পড়ি ও পড়াই ততই মনে হয় আরো জানার আছে, শেখার আছে,
দেওয়ার আছে।
আসলে শিক্ষকতার জীবনের প্রতিটি ধাপে ধাপে রয়েছে আলাদা
আলাদা সৌন্দর্য ও আনন্দ। সব মুহূর্তই ভাল ও আনন্দে থাকার চেষ্টা করি। কবি
শেখ সাদী বলেছেন, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই উপভোগ করা উচিত, কারণ কাল কী হবে
কেউ জানে না।
শখের বসে মাঝে মাঝে লেখালেখি করার চেষ্টা করি। তবে এটাও
বুঝি যে, সত্যিকারের লেখক হওয়া অনেক কঠিন ব্যাপার, তারপর ও সময় পেলে চেষ্টা
করি। কোনো বিষয়ে বেশিক্ষণ লেগে থাকতে পারি না- এটাই আমার বড় সমস্যা। তা
ছাড়াও নিজের অজান্তেই অনেক ভুল হয়ে যায়। তবে ভুল থেকে জীবনে শিখেছি ও
অনেকে। আসলে কাজের যেমন শেষ নেই ভুলেরও তেমন শেষ নেই। ভুল জীবনেরই একটি
অংশ। ভুল করার কিছু প্রয়োজন আছে। কেননা ভুল না করলে আমরা সঠিকটা জানতে পারি
না।
বারবার ব্যর্থ হলেও চেষ্টা না ছাড়লেই বড় সফলতা আসে এর প্রমাণ হলো
থমাস আলভা এডিসন ছোটবেলায় স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল, কারণ শিক্ষক
বলেছিলেন, এই ছেলে কিছুই শিখতে পারবে না। বৈদ্যুতিক বাল্ব আবিষ্কারের জন্য
তিনি প্রায় হাজারবার ব্যর্থ হয়েছিলেন। এডিসনকে একদিন এক সাংবাদিক প্রশ্ন
করেছিল এতবার ব্যর্থ হয়ে কেমন লাগছে? এডিসন উত্তর দিয়েছিলেন, আমি ব্যর্থ
হইনি বরং হাজার উপায় শিখেছি যেভাবে বাল্ব তৈরি হয় না। অবশেষে এডিসনই
বৈদ্যুতিক বাল্ব আবিষ্কার করে সারা পৃথিবী আলোকিত করলেন।
আলবার্ট
আইনস্টাইন বিখ্যাত বিজ্ঞানী, আইনস্টাইন ছোটবেলায় পড়াশোনায় খুব ধীর ছিলেন।
স্কুলে শিক্ষকরা বলতেন, এ ছেলে কোনো দিন কিছু করতে পারবে না। কিন্তু সে হাল
ছাড়েনি। নিজের ভুল থেকে শিখে কঠিন পরিশ্রম করতে থাকে। পরে তিনি
পদার্থবিজ্ঞানের আপেক্ষিকতাবাদ আবিষ্কার করে আধুনিক বিজ্ঞানের ইতিহাস
পাল্টে দেন।
কানাডিয়ান বিখ্যাত লেখক রবিন শর্মা বলেছেন, ভুল বলে কিছু
নেই, সবই নতুন শিক্ষা। তিনি আরো বলেছেন, যে কখনো ভুল করেনি তার মানে সে
চেষ্টাই করেনি। তবে সব কথা ছাপিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলার উক্তিটিই আমাকে বেশি
উদ্বুদ্ধ করে, তা হলো- দক্ষতা তৈরি হয় অভিজ্ঞতা থেকে। আর অভিজ্ঞতা আসে
ভুলভ্রান্তি থেকে। তাই ভুল করা কোনো খারাপ জিনিস নয় বরং সাফল্যের প্রথম
চাবিকাঠি।
স্কাউটিং এর ট্রেনিং এক স্যার বলেছিলেন যদি কখনো ভুল ট্রেনে
উঠে পড়ো তাহলে পরবর্তী স্টেশনে নেমে যাও। কেননা ট্রেন যত দূরে যাবে ততই
ফেরার কষ্ট বাড়বে। কথাটা আসলে আমাদের জীবনে অনেকটাই বাস্তব প্রতিফলন। ভুল
করে ভুল ট্রেনে উঠে পড়াটা আমাদের জীবনের জন্য একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এই ছোট্ট
জীবনে চলার পথে অনেক সময় অনেক সিদ্ধান্তই আমাদের গ্রহণ করতে হয়। প্রতিটি
সিদ্ধান্তই যে সঠিক হবে তা আমরা হলফ করে বলতে পারি না। ভুল ট্রেনে উঠে ভুল
স্টেশন নেমে যাওয়ার মাঝেও এক ধরনের আনন্দ আছে। এক হলো সঠিক পথে আসার
আনন্দ।
দুই, ভুল বুঝতে পারার আনন্দ। আর তিন হলো, ভুল সময়ে আপন মানুষদের
চিনতে পারার আনন্দ। কেউ যদি সবসময় কোনো ভুল না করে সঠিক কাজই করতে থাকে,
তাহলে সে এ আনন্দগুলো থেকে বঞ্চিত হয়। তবে আশার কথা এই যে, সৃষ্টিকর্তা
আমাদের কোনো আনন্দ থেকেই বঞ্চিত করে না
পড়ালেখা বা ব্যক্তি জীবনের
সম্পর্কগুলো হোক, অফিসের কাজ হোক বা ব্যবসায়িক কোনো কাজ এই সব বিষয়েই ভুল
থেকে শিক্ষা নেওয়ার চর্চা করা আমাদের উচিত। কারণ একবার ভুল করলেই আমরা
জানতে পারি, কোন উপায়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
আমাদের ভুলগুলোও আমাদেরই
অংশ। এজন্য সেগুলোকে নিজের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন না করে দিয়ে কীভাবে জীবনে
চলার পথে তা কাজে লাগিয়ে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওঠা যায়, সে বিষয়ে সচেতন করতে
হবে। তাহলে ভুলের পর থাকবে না কোনো আফসোস, থাকবে না নিজেকে দোষারোপের
গ্লানি।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।