শনিবার ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
১২ আশ্বিন ১৪৩২
উজাড় হচ্ছে বন, মরুকরণের পথে বাংলাদেশ
মেজবাহ উদ্দিন তুহিন
প্রকাশ: শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ১:৪৭ এএম |

 উজাড় হচ্ছে বন, মরুকরণের পথে বাংলাদেশ

শালবন থেকে সুন্দরবন সবখানেই মানুষের লোভ আর উদাসীনতার কারণে প্রকৃতি বিপর্যস্ত হচ্ছে। গাছ কেটে, পাহাড় উজাড় করে আর নদী শুকিয়ে দিয়ে আমরা নিজেরাই ডেকে আনছি খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও দুর্যোগের অভিশাপ। এখনই লোভ সংবরণ করতে না পারলে একসময়ের অরণ্যঘেরা বাংলাদেশ মরুভূমিতে পরিণত হতে হয়তো খুব বেশি দিন লাগবে না।
বাংলাদেশের বনভূমি আজ মানুষের লোভে ক্ষতবিক্ষত। একসময়ের সবুজের ঢেউ কেটে ফেলে আমরা নিজেদের বুকেই অস্থিরতার বিষ ঢালছি। প্রকৃতির বুক চিরে যখন গাছ পড়ে, তখন কেবল কাঠ হারায় না—হারিয়ে যায় পাখির ডানা, প্রাণীর আশ্রয়, মানুষের শ্বাস নেওয়ার শেষ ভরসা। প্রতিদিন নির্বিচারে বন উজাড়ের দৃশ্য যেন এক নিঃশব্দ হত্যাযজ্ঞ; বিলুপ্ত হচ্ছে উদ্ভিদ-প্রাণীর অস্তিত্ব, ভেঙে পড়ছে জীবনের ভারসাম্য।
বন কেবল গাছের সমষ্টি নয়, এটি জীবনের ছায়াঘন আশ্রয়। গাছ আমাদের নিঃশ্বাসে প্রাণ যোগায়, আকাশ থেকে নেমে আসা পানিকে ধরে রাখে, মাটিকে উর্বর করে তোলে। অথচ মানুষ নিজের হাতেই এই জীবনের সেতু ভেঙে দিচ্ছে। বনভূমি ধ্বংসের ফলেই দাবদাহ আজ দগ্ধ করছে জনজীবন, মাটি ভেঙে যাচ্ছে, ঝড়-বন্যা আরও দুর্বার হয়ে উঠছে। প্রকৃতি ছিল আমাদের সহযাত্রী, অথচ আমরা তাকেই প্রতিনিয়ত শত্রুর মতো আঘাত করছি—ফল যা ভুগতে হচ্ছে আজ প্রতিটি মানুষের।
বিশ্বজুড়ে বন উজাড়ের ফলে প্রতি বছর ২.৪ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাতাসে মিশে পরিবেশ দূষিত করছে, যা তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে করছে। বনভূমি হারালে শুধু গাছই নয়, হারায় জীববৈচিত্র্যের নির্দিষ্ট রং, হারায় প্রাণের সুর। প্রায় পঞ্চাশ প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্তির পথে, আর বাংলাদেশে এই বিপর্যয় আরও গভীর। আমাদের উত্তরবঙ্গের সবুজ প্রান্তরে যখন মরুভূমির আভাস দেখা দিচ্ছে। শীতকালে পানির উৎস শুকিয়ে যায়। এর ওপর, ফারাক্কার প্রভাবও এখানে পড়ে। শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে তীব্র খরা এবং বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানিপ্রবাহের ফলে মহাপ্লাবন সৃষ্টি হয়। এসব অঞ্চলে জলবায়ু ক্রমশ মরুময়তার দিকে যাচ্ছে।
একসময় সেচের জন্য প্রয়োজনীয় ২৫ শতাং পানি নদী-নালা, খাল-বিল থেকে পাওয়া গেলেও বর্তমানে তা পাওয়া যায় না। ফলে গভীর নলকূপের ওপর চাপ বাড়ছে, পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে এবং আর্সেনিক উপরে উঠে আসছে। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ৪০-৪২ ডিগ্রি সেলিয়াস এবং শীতে কখনও কখনও ৪-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তাপমাত্রার এই ভারসাম্যহীনতা ভবিষ্যতে এই অঞ্চলগুলোকে মরুময়তার দিকে ঠেলে দেবে। উপকূলীয় অঞ্চল প্রতি বছর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের শিকার হচ্ছে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশ আক্রান্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশে কী পরিমাণ বনভূমি রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। বন বিভাগের মতে, দেশে ১০.৩ শতাংশ বা ১.৫২ মিলিয়ন হেক্টর ভূমিতে বন রয়েছে। তবে ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের মাত্র পাঁচ শতাংশ বনভূমি আছে। অথচ বনজ সম্পদ আমাদের পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য। দেশের সব অঞ্চলের বনই এখন ধীরে ধীরে ধ্বংস হচ্ছে।
পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৯৫৫-৫৬ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর ময়মনসিংহ, ঢাকা, রংপুর ও দিনাজপুরে গভীর শালবন ছিল। হাজার বছরের প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এই বনভূমির গাছপালা রক্ষণাবেক্ষণে সাধারণ মানুষ সচেতন না হলেও ছোট ছোট ভূমি মালিকরা নিজেদের প্রয়োজনে এর যত্ন নিতেন। বনের বাঁকা গাছ কেটে শহর ও গ্রামের জ্বালানির চাহিদা মেটানো হতো। শালকাঠ দিয়ে ঢেঁকি, লাঙ্গল, খড়ম, চৌকি, পালকি, গরুর গাড়িসহ নানা শিল্পকর্ম তৈরি হতো, যা থেকে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। সে সময় নতুন করে গাছ লাগানোর প্রয়োজন পড়ত না, প্রাকৃতিকভাবেই চারা গজিয়ে উঠত। স্থানীয় লোকজন নিজেদের স্বার্থেই এই চারাগুলো যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতেন।
১৯৫৩ সালে এই ছোট ছোট শালবনগুলো সরকারি বন হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ফরেস্ট রেঞ্জের অধীনে চলে যায়। এর পর থেকেই কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় বন ধ্বংস হতে থাকে। তারা বন বিক্রি করে নিজেদের সহায়-সম্পদ গড়ে তোলে। শাস্তি না পাওয়ায় তারা আরও সাহসী হয়ে ওঠে। কিছু ব্যবসায়ী ও গ্রাম্য টাউটরা বন ধ্বংস করে ওই জমিতে আলু, আখ, ধান চাষ শুরু করে। এভাবে হাজারও প্রজাতির গাছপালা, পশুপাখি এবং শালবন উৎখাত হয়ে যায়।
টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ে একসময় বাঘ বাস করত, কিন্তু এখন সেখানে বানর ও পাখি ছাড়া অন্য কোনো বন্যপ্রাণী দেখা যায় না। ঔষধি গাছও হারিয়ে গেছে। ভাওয়ালের গড়ে তৈরি হয়েছে রিসোর্ট, বাড়িঘর, অফিস ও শিল্পকারখানা। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি পাহাড়ই এখন ফাঁকা। কোথাও কোথাও পাহাড় ন্যাড়া করে ঘরবাড়ি ও অফিস স্থাপন করা হয়েছে। অথচ একসময় এই বনভূমি নানা জীবজন্তুতে ভরপুর ছিল। এই বনের বাঁশের ওপর নির্ভর করে কর্ণফুলি পেপার মিল গড়ে উঠেছিল। পাহাড়িদের দৈনন্দিন জীবনের সব কিছুতেই কাঠ ও বাঁশের ছোঁয়া ছিল, যা আজ বিলুপ্তির পথে। শত শত প্রজাতির গাছপালা এখন হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে।
আমাদের রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। এর মোট আয়তন ৫৬৬৮.৪৫ বর্গকিলোমিটার, যার বেশির ভাগই খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় অবস্থিত। এই বনের মোট আয়তনের ৩৫ শতাংশ পানি এবং ৬৫ শতাংশ ভূমি। অসংখ্য ছোট-বড় নদী এই বনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, যা সাগরে পতিত হয়েছে। এখানকার পানিতে ১২০ ধরনের মাছ এবং বনে ৩২৫ প্রজাতির বৃক্ষলতা পাওয়া যায়। সুন্দরী, গেওয়া, ধুন্দুল, গোলপাতা, ওড়া, পশুর, বাইন, ফিসচুলা ইত্যাদি এখানকার প্রধান বৃক্ষ। জীববৈচিত্র্যে অনন্য এই বন ইউনেসকো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃত। ১৭৬৫ সাল থেকে এই বনের কাঠ কাটা শুরু হয়। তবে ১৮৮৫ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ১৮১৭ সালে সুন্দরবনকে সরকারি সম্পত্তি ঘোষণা করা হয় এবং তখন থেকেই বন ধ্বংস হতে থাকে। তবে এখনও সুন্দরবনে প্রচুর সম্পদ রয়েছে, এবং এর জীববৈচিত্র্য আমাদের পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
একসময় এই গভীর বন দুর্গম এবং ভীতিকর হলেও বর্তমানে মানুষের অবাধ বিচরণ এবং কিছু অসাধু বন কর্মকর্তা-কর্মচারীর অর্থলোভের কারণে এটিও ধ্বংসের মুখে। মৌয়ালী, বাওয়ালী ও পর্যটকরা এখানে প্রতিনিয়ত প্রবেশ করে শামুক, ঝিনুক, মধু ও বনজ ঔষধসহ নানা মূল্যবান সম্পদ সংগ্রহ করছে। এই বন জলদস্যু ও ডাকাতদেরও অবাধ বিচরণস্থল। প্রকৃতির অপরূপ দান এই সুন্দরবন নানাভাবেই ধ্বংস হতে চলেছে, যা এর ঐতিহ্যকে ম্লান করছে। মানুষের অযাচিত হস্তক্ষেপের ফলে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে।
আমাদের এই গহীন অরণ্য নিবিড়, কন্টকাকীর্ণ, হিংস্র, শ্বাপদসংকুল ও কর্দমাক্ত হওয়ায় একসময় জনসাধারণের জন্য ভীতিকর ছিল। কিন্তু মানুষের অবাধ বিচরণ এবং কিছু বন কর্মকর্তা-কর্মচারীর অর্থলিপ্সার কারণে এই বনও এখন ধ্বংসের মুখে। প্রতিদিন মৌয়ালী, বাওয়ালী ও পর্যটকদের বিচরণ ঘটে। তারা ঝিনুক, শামুক, মধু ও বনজ ঔষধ সংগ্রহ করে। অপরাধী, জলদস্যু, ডাকাত ও সন্ত্রাসীদের জন্যও সুন্দরবন অবাধ বিচরণস্থল। প্রকৃতির অপরূপ দান এই সুন্দরবন নানাভাবে ধ্বংস হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে এর স্বর্ণোজ্জ্বল ঐতিহ্য। মানুষের অযাচিত হস্তক্ষেপে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে।
যেভাবে বন কেটে আসবাবপত্র, জ্বালানি ও গৃহনির্মাণের উপকরণ তৈরি করা হচ্ছে, তাতে একদিন বন ধ্বংস হয়ে যাবে। সামাজিক বনায়নের নামে বৃক্ষরোপণ করা হলেও অসাধু ব্যক্তিদের কারণে সরকারের সদিচ্ছা ব্যাহত হচ্ছে। যেকোনো দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য ৩৩ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশের অবস্থা খুবই নাজুক। বন কমে যাওয়ায় আমরা বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছি। খরায় মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। তাই পরিবেশ ও অর্থনীতিকে রক্ষা করতে আমাদের সকলেরই এগিয়ে আসা উচিত।
লেখক: গবেষক এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক পরিচালক।












http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
কুমিল্লা মহানগরে ‘আপ বাংলাদেশ’-এর আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা
বহুল প্রতীক্ষিত সম্মেলন আজ
ফেব্রুয়ারিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের অঙ্গীকার তুলে ধরলেন প্রধান উপদেষ্টা
মুক্তি পাচ্ছে আলো সাহা আল্পনার মৌলিক গানের মিউজিক ভিডিও ‘মন তবু তোমাকে চায়’
৫ দফা দাবিতে কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে জামায়াতের বিক্ষোভ মিছিল
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা সদর আর্মি ক্যাম্পের উদ্যোগে যৌথ চেকপোস্ট অভিযান
কুমিল্লায় লাউ চাষে সফল দুই গ্রামের তিন কৃষক
এদেশের মানুষের ইজ্জত, সম্মান আমানত একমাত্র তারেক রহমানের কাছে নিরাপদ- ড. রশিদ আহমেদ হোসাইনী
ডোবার পানিতে ডুবে আপন দুই ভাই-বোনের মৃত্যু
পৃথিবীর ৮ম সর্বোচ্চ চূড়া ‘মানাসলু’ জয় করলেন কুমিল্লার তমাল
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২