ভারতীয়
ঢল এবং টানা ভারি বর্ষণে কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি বাড়তে থাকায় বাঁধ
ভেঙ্গে পানি ছড়িয়ে পড়ার আতংক তৈরি হয় গোমতীর চর ও পাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে।
চর প্লাবিত হওয়ায় অনেক বাসিন্দা ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন পাড়ে। তবে গত
দুইদিন থেকে নদীর পানি কমতে শুরু করায় সেই আতঙ্ক কাঁটতে শুরু করেছে
বাসিন্দাদের মধ্যে। ফিরতে শুরু করেছেন ছেড়ে আসা ঘরবাড়িতে। গেল সপ্তাহের
বুধবার থেকে টানা বৃষ্টি আর ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হুঁ হুঁ করে
বাড়তে থাকে গোমতীর পানি। এতে বেড়িবাঁধে বসবাসকারীদের মাঝে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা
দেখা দেয়। বন্যার আশঙ্কায় চরের ঘরবাড়ি ছেড়ে বাঁধের ওপর বাঁশ-পলিথিন দিয়ে
ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার সংরাইশ
এলাকায় গোমতী নদীর বেড়িবাঁধ সড়কে গত বৃহস্পতিবারের চিত্র ছিল একেবারেই
ভিন্ন। নদীপাড়ের মানুষের চোখেমুখে ছিল উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। আতঙ্কগ্রস্ত চরের
বাসিন্দারা নিজেদের সর্বস্ব রক্ষায় নদীর বেড়িবাঁধ সড়কের পাশে বাঁশ গেড়ে
পলিথিন বা ত্রিপল দিয়ে বানাতে থাকেন খুপরি ঘর। তবে শনিবার বিকেলে একই
এলাকায় গিয়ে দেখা গেল অন্য রকম চিত্র।
ওই স্থানে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে
নদীপাড়ের মানুষের বানানো পাঁচটি খুপরি দেখা যায়নি। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার
সকাল নয়টার পর থেকে নদীর পানি আর বাড়েনি। টানা তিন দিন অব্যাহতভাবে কমছে
নদীর পানি। বলা চলে, গোমতীর পানি অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে।
সংরাইশ
এলাকায় পাড়ে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে চরে ফিরে যাওয়া খালেদা আক্তারের সাথে। তিনি
বলেন, স্বস্তি ফিরেছে তাদের মধ্যে, কারণ নদীতে পানি কমেছে। বুধবার রাইতে
ঘুমাইতাম পারছি না। তয় বৃহস্পতিবার থাইক্যা পানি কমনে এহন একটু শান্তিতে
আছি। বাঁশ আর পলিথিন দিয়ে গাঙ্গের পারো যেই ঘরডা বানাইছিলাম হেইডা শুক্রবার
বিকেলে খুইল্যা লইয়া আইছি। আল্লাহয় আমরারে রক্ষা করছে। ভাবছিলাম, গত বছরের
মতো এইবারও আমরার সব শেষ হইয়া যাইব। আল্লাহয় রক্ষা করনে এহন আর কোনো ডর
নাই। পানি এহন আগের মতোই। যেইডা বাড়ছিল, হেইডা নাইম্যা গেছে।’
সংরাইশ
এলাকার আবুল কামাল নামে আরেক বাসিন্দা জানান, নিরুপায় হয়ে গোমতীর চরে বসবাস
করছি। নদীর পানি বাড়লে আমাদের হার্টবিটও বাড়তে থাকে। গত তিন দিনে মনে
হয়েছে ৩ বছর পার করেছি। ঘরের কাছাকাছি পানি চলে এসেছে। ছেলে সন্তান নিয়ে
বাঁশ-পলিথিন দিয়ে ঝুপড়ি বানিয়ে সড়কের পাশে রাত্রি যাপন করেছি। সকাল থেকে
আকাশে রোদ দেখে এবং নদীর পানি কমায় এখন বাড়িতে চলে যাচ্ছি।
কুমিল্লা
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান বলেন,
টানা ভারি বর্ষণ আর উজানের ঢলে গোমতী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছিল। বৃষ্টি
থামার পর এবং উজানের ঢল কিছুটা কমায় বিপদ মুক্ত বলা যেতে পারে। সর্বশেষ
শুক্রবার বিকেল ৩টার দিকে গোমতী নদীর পানি ৮ দশমিক ৫৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে
প্রবাহিত হতে দেখা গেছে। এর আগে বৃহস্পতিবার পানির উচ্চতা ছিল ৯ দশমিক ৬৮
মিটার। গোমতী নদীর বিপৎসীমা ১১ দশমিক ৩ সেন্টিমিটার। আশা করছি বৃষ্টি না
হলে রাতে পানি আরো কমে যাবে।
বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)
মো. তানভীর হোসেন বলেন, ইতিমধ্যে পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। তবু
সবাইকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। এ ছাড়া দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের
পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবেদ আলী
বলেন, এখন পর্যন্ত জেলার কোথাও বন্যার সৃষ্টি হয়নি। একাধিক স্থানে
জলাবদ্ধতার সৃষ্টি খবর পেয়েছি। আশার কথা হলো গোমতী নদীর পানি ধীরগতিতে হলেও
কমে আসছে। আগামী দু-এক দিনের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। মানুষকে
আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান এই কর্মকর্তা। তিনি আরো বলেন,
দুর্যোগ মোকাবিলায় ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫৮৬টি আশ্রয়কেন্দ্র
প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক
আইউব মাহমুদ বলেন, চলতি মৌসুমে গোমতী নদীর চরসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় সবজি,
আউশ ও রোপা আমন বীজ তলাসহ প্রায় ১৩ হাজার ৬৪০ হেক্টর ফসলি জমির ক্ষয়ক্ষতি
হয়েছে। এতে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে প্রায় ১০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি
হয়েছে কৃষকদের। পুরোপুরি পানি নেমে গেলে আমরা এর সঠিক পরিসংখ্যান বের করতে
পারব। বর্তমানে সব উপজেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করছেন কৃষি বিভাগের কর্মকতারা।
উল্লেখ্য,
গত বছরের ২২ আগস্ট রাতে জেলার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া এলাকায় গোমতী নদীর
প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছিল বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়াসহ কয়েকটি
উপজেলা। স্মরণকালের সেই বন্যার ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন কুমিল্লার মানুষ।
যার কারণে গোমতীতে পানি বাড়লে কুমিল্লা বাসীর মনে আতঙ্ক বাড়ে।