দেশে মব ভায়োলেন্স প্রতিনিয়তই ঘটছে। সরকার, সেনাবাহিনী ও পুলিশের পক্ষ থেকে বারবার কঠোর পদক্ষেপের কথা বলা হলেও থামানো যাচ্ছে না এ অপরাধ। এখন প্রশ্ন উঠেছে, মব ভায়োলেন্স থামানোর ব্যাপারে পুলিশ আসলে কতটা সক্রিয়। পাশাপাশি এ বাহিনীর সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অনেকের মতে, পুলিশ এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। নিরপেক্ষভাবে পুলিশের দায়িত্ব পালনের মতো রাজনৈতিক পরিস্থিতি আছে কি না, তা নিয়ে বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছেন। তাদের মতে, প্রতিদিন যেসব মব ভায়োলেন্সের খবর আসছে, এতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠছে। কুমিল্লার মুরাদনগরে একই পরিবারে তিনজনকে হত্যা, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থানায় হামলা চালিয়ে আসামি ছিনতাই, পটিয়া থানায় হামলাসহ সম্প্রতি বেশ কিছু মব সন্ত্রাসের ঘটনায় চরম উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে সচেতন মহলে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মব ভায়োলেন্স বা ‘গণপিটুনির’ ঘটনায় কমপক্ষে ৯৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। অপরাধ বিশ্লেষকরা এসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বল ভূমিকা বা তৎপরতার অভাবকে দায়ী করছেন। তাদের মতে, মব ভায়োলেন্স ঠেকাতে গিয়ে পুলিশ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করছে। বেশির ভাগ মব ভায়োলেন্সের ঘটনা ঘটছে রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যে। ফলে নির্বাচনে কোন দল ক্ষমতায় যাবে, কারা এখন মাঠে শক্তিশালী, সেসব হিসাব কষছেন পুলিশের অনেকেই। অনেক ক্ষেত্রে আবার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে গিয়ে পুলিশ নিজেরাও মব ভায়োলেন্সের শিকার হচ্ছে। নানা ‘ট্যাগ’ দিয়ে অপসারণ ও শাস্তির দাবিতে তুলকালাম কাণ্ড ঘটানো হচ্ছে। এসব পরিস্থিতির কারণে পুলিশ অনেক সময় দ্বিধাগ্রস্ত বা ধূম্রজালের মধ্যে পড়ছে। ঘটনার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে তাদের কী করা উচিত বা কোনটি সঠিক, অনেক ক্ষেত্রে তারা তা বুঝতে পারছে না।
মব ভায়োলেন্সের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পৃক্ততা বা যোগসূত্র টানছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এ ধরনের পথ বেছে নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি এসব বিষয়ে সরকারের দায়িত্বশীল ভূমিকা দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান কাঠামো বাংলাদেশ পুলিশ এখনো সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বলে মনে করেন তারা। কারণ হিসেবে বলছেন, পুলিশও হরহামেশা মব ভায়োলেন্সের শিকার হচ্ছে। তারাও মব সন্ত্রাস থেকে রেহাই পাচ্ছে না। গত ছয় মাসে পুলিশের ওপর দুই শতাধিক হামলা বা মব ভায়োলেন্সের ঘটনা ঘটেছে।
সামাজিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ৫ আগস্ট-পরবর্তী যেসব মব ভায়োলেন্সের ঘটনা ঘটেছে, তার বেশির ভাগই রাজনৈতিক যোগসাজশে বা পূর্ববিরোধের সূত্র ধরে। মব ভায়োলেন্সের মাধ্যমে সামাজিক অস্থিরতা যেমন বাড়ে, তেমনি মানুষের মৌলিক অধিকার, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়ে। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এ জাতীয় পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারছে না। কী করবে তা নিয়েও দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছে। পুলিশ শক্তভাবে ঘুরে না দাঁড়ালে সাধারণ মানুষের আস্থা আরও নষ্ট হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা রাষ্ট্রকেই মানুষের মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
সরকারকে মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মব ভায়োলেন্স বা এ জাতীয় বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। তারা শক্তভাবে ঘুরে না দাঁড়ালে আস্থার সংকটে পড়বে।