রাত তখন নয়টা বাজে হয়তো।
বহুদিন আগের স্মৃতির ডায়েরিতে বিস্মৃতির প্রলেপ পড়েছে কিছু কিছু। আঙুল গুণে
সেদিনের সময় কিংবা দিনক্ষণ বলা আজকের বাউণ্ডুলের পক্ষে অসম্ভব। তবে বর্ষা
ছিল সেসময়। চারদিকে থৈ থৈ পানি। পড়ার টেবিলে বসে পড়ছি। ক্ষীণ শব্দ করে। ছোট
ভাই মামুন উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। একটা শিশু টিকটিকি থেমে থেমে অস্তিত্বের
জানান দিচ্ছে।
বাইরে জ্যোৎস্না। শুভ্র ফুলের মতো ফুটে আছে চাঁদ। খোলা
জানালার ফাঁক গলে জ্যোৎস্নার আলো পড়ার টেবিলে আছড়ে পড়ে মায়ার আলপনা আঁকছে।
হালকা নরম বাতাসের মৃদু ধাক্কায় গত বছরের ক্যালেন্ডারটা দোলছে। এ সময় হনহন
করে সালাম ও সুমন আমার ঘরে ঢুকল। তাদের সঙ্গে পথে নামতে বলল। যেতে হবে
স্যারের বাসায়। আমি তাদেরকে বললাম, ‘তোরা তো জানিস, রাতে আম্মা বের হতে
দেবে না।’ সালাম বলল, ‘মামানিকে বলেই তোর রুমে এসেছি। চল, চল।’
আম্মাকে
বলে বের হই। স্যারের সঙ্গে দেখা করে তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার আদেশ করতে
ভুললেন না আম্মা। বাড়ির সীমানা পেরিয়ে দেখি রাস্তায় রবি দাঁড়িয়ে আছে।
গ্রামের কাদা মাখানো রাস্তায় চারটা প্রাণ কথার পিঠে কথা বলতে বলতে পথ ধরল।
তিন রাস্তার মোড়ে এলে তারা নদীর পথে পা বাড়ায়। বললাম, ‘কিরে স্যারের বাড়ি?’
সবাই হেসে দিল। সুমন বলল, ‘দোস্ত , আজ আর স্যারের বাড়ি নয়। নদীতে যাব।
স্যারের কথা তো তোর আম্মাকে রাজি করাতে বললাম!’
আমাদের জীবনে এমন বহুদিন গেছে নানা অজুহাতে আমরা ঘর ছেড়েছি। পথে পথে যাযাবরের মতো দিন-রাত কাটিয়েছি।
করিম
দাদার ডিঙি নৌকা নিয়ে মেঘনার বুকে নামি। মাঝ বয়সী চাঁদটা একটানা খেলা করছে
সাদা-কালো মেঘের সঙ্গে। উঁকি দিচ্ছে মেঘের জানালা খুলে। বাতাসে ভাসছে
চাঁদের নির্ভেজাল সফেদ আলোর মিছিল। আমাদের নৌকা ডুবে যায় গহীন আলোর ভেতর।
শুভ্রতার পরশে শুভ্র হয়ে যায় মিথ্যে বাহানায় ঘর ছেড়ে আসা চারজন এবং কাল
নৌকা। এমন রাত আমার জীবনে এখন আর ফিরে আসে না। কেউ মিথ্যে নাটক সাজিয়ে ঘর
থেকে বের করতে আয়োজন করে না।
মনে পড়ে, এমন বর্ষার দিনে গ্রামের সামনে
নোঙর করা নৌকায় বসে আছি আমরা। তখন বিকেল। আরেকটা দিনের প্রতীক্ষায় দিনটা
ডুবে যাচ্ছে রাতের ভেতর। একটু পর হেমন্ত মুখার্জির সূর্য ডোবার পালা।
আমাদের আরেক বন্ধু আতাউর; সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে দেয়
হাঁটু পানিতে নেমে বর্ষি দিয়ে একদল তরুণীর মাছ ধরার চলচ্চিত্র। নৌকা থেকে
নেমে আমরা তাদের বরাবর একটু দূরে দাঁড়াই। একটা পুঁচকে ছেলেকে চিপ্স ধরিয়ে
তার ছিপ হাতে নিলাম। রবির ছাড়া আমাদের কারও ফাতানে টান পড়েনি। আমাদের মাছ
লাগেনি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, তারা আমার দুই বন্ধুর জীবনে জড়িয়ে
গিয়েছিল।
শ্রাবণের একদিনে ঝুম বৃষ্টিরা থেমে গেলে ভেজা পৃথিবীর রাস্তায়
নামি। গ্রামের স্কুলে এলে দেখা হয় সেই হাঁটু পানিতে ফাতানের দিকে চেয়ে থাকা
দুই তরুণীর সঙ্গে। অবশ্য আজ তারা নারী। ঘরও বেঁধে ফেলেছেন। কুশল বিনিময়
হলো। কত কথা মনে পড়ল আমাদের। স্মৃতিরা চোখেও বর্ষা নামাতে চায়। কে হায় হৃদয়
খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।
বর্ষায় জীবনের হরেক রকমের স্মৃতিরা জড়ো
হয়েছিল আমার জীবনে। আজ যখন বর্ষা আসে তখন মেঘ জমে আকাশে। কালো মেঘ। তখন
জীবনের সব খেলা সাঙ্গ হয়ে যায়। জীবন হয়ে যায় অর্ধেক জীবন। মন ভেঙে যায়
কাচের মতো।