বিশ্বব্যাপী
দারিদ্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলির মধ্যে একটি। বিশ্বের সাধারণ
শত্রু হল দারিদ্র্য। সভ্যতার শুরু থেকেই দারিদ্র্য একটি সমস্যা হিসেবে রয়ে
গেছে। কবিতা ও গানে অনেক সময়ই দারিদ্র্য কে মহান করে দেখানো হয়, কিন্তু
আদতে দারিদ্র্য হচ্ছে একটি নিষ্ঠুরতম বাস্তবতা। দারিদ্র্য মানুষের চরম
শত্রু, যা তার মর্যাদা ও স্বপ্ন দুই-ই কেড়ে নেয়। বইয়ের ভাষায় দারিদ্র্য হলো
মৌলিক চাহিদা তথা খাদ্য, বাসস্থান, পোশাক, নিরাপদ পানি, শিক্ষা এবং
স্বাস্থ্যসেবার মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য পর্যাপ্ত অর্থের অভাব।
বিশ্বব্যাংকের অনুমান মতে বিশ্বের প্রায় ৭০ কোটির মতো মানুষ (পৃথিবীর মোট
জনসংখ্যার ৮.৫%) অতি বা চরম দারিদ্র্য। দক্ষিণ সুদানের ৭৬% এরও বেশি
জনসংখ্যা জাতীয় দারিদ্র্য রেখার নীচে বাস করে। দক্ষিণ এশিয়ায়, দারিদ্র্যের
হার বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ, যেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষ বহুমাত্রিক
দারিদ্র্যের সম্মুখীন। বিশ্বব্যাংকের মতে, এশিয়ার ৩২ কোটিরও বেশি মানুষ চরম
দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে।
দারিদ্র্য একটি বহুমাত্রিক বিষয় । কোন একটি
নির্দিষ্ট কারণ দিয়ে দারিদ্রকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এটি মূলত: বিভিন্ন
কারণের সংমিশ্রণের ফলাফল। দারিদ্র্যকে প্রায়শই মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য
পর্যাপ্ত অর্থের অভাব হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। তবে এটি পূর্ণাঙ্গ সত্যকে
প্রকাশ করে না, এর সাথে দুর্বল স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগের
অভাব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বৈষম্যের মতো কারণগুলিও দারিদ্র্যের
অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ফলস্বরূপ, দারিদ্র্য একজন ব্যক্তির জীবনে স্থায়ী প্রভাব
ফেলতে পারে, যা তাকে কষ্টের চক্রে আটকে রাখে। দারিদ্র্য দীর্ঘ মেয়াদে
শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায় এবং একজন ব্যক্তির
পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জনে বাঁধা দেয় - মানুষকে তার ভবিষ্যতের আশা সম্পর্কে
নৈরাশ্যবাদি করে তোলে। সব বিবেচনাতে বলা যায় দারিদ্র্য একটি গুরুতর সমস্যা
যা প্রতিদিন বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রভাবিত করে।
দারিদ্র্যকে
বিভিন্নভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে। তবে সাধারণভাবে দারিদ্র্যকে ১)
আপেক্ষিক দারিদ্র্য ও ২) পরম দারিদ্র্য এ দু'ভাগে ভাগ করা হয়। আপেক্ষিক
দারিদ্র্য বলতে সমাজের গড় আয়ের তুলনায় কম আয় করা মানুষদের বোঝায়, আর পরম
দারিদ্র্য হল এমন একটি অবস্থা যেখানে মানুষ মৌলিক চাহিদা পূরণেও অক্ষম হয়।
এই মৌলিক পার্থক্যের বাইরে, দারিদ্র্যকে অবস্থান (শহুরে বনাম গ্রামীণ),
কারণ (পরিস্থিতিগত বনাম প্রজন্মগত), অথবা বিভিন্ন জনসংখ্যার উপর প্রভাবের
ভিত্তিতেও শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে দারিদ্রের
মাত্রা পরিমাপ করা হয় । প্রতিটি দেশ সাধারণত তার নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক
অবস্থা এবং সামাজিক রীতিনীতির উপর ভিত্তি করে নিজস্ব দারিদ্র্যসীমা
নির্ধারণ করে। বিশেষ কর, যা তাদের নাগরিকদের আয়ের স্তরের সাথে তথ্যবহুল এবং
প্রাসঙ্গিক। দারিদ্র্য পরিমাপের জন্য বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে ‘মৌলিক
চাহিদার মূল্য পদ্ধতি’ ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিতে মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য
প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের একটি বান্ডিলের দাম নির্ধারণ
করা হয়। এই বান্ডিলটি বহন করতে অক্ষম ব্যক্তিদের দরিদ্র হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ
করা হয়। বিশ্বব্যাংকের মতে, মৌলিক চাহিদার মূল্য পদ্ধতিতে উচ্চ এবং নিম্ন
দারিদ্র্য রেখা উভয়ই অন্তর্ভুক্ত থাকে । উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ জাতীয় উচ্চ
এবং নিম্ন দারিদ্র্যরেখা নির্ধারণ করে প্রতিদিন প্রতি ব্যক্তির ২,১২২
ক্যালোরি খরচ এবং খাদ্য বহির্ভূত ব্যয়ের উপর ভিত্তি করে।
বিশ্বকে
দারিদ্র্যমুক্ত করার জন্য জাতিসংঘ কঠোর পরিশ্রম করছে। টেকসই উন্নয়ন
লক্ষমাত্রা দারিদ্র্যকে সবচেয়ে তীব্র উদ্বেগের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে
এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য দূর করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশ
দারিদ্র্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, যার ফলে দারিদ্র্য
১৮.৭% এ নেমে এসেছে। ঐতিহ্যগতভাবে, বাংলাদেশে দারিদ্র্য তথ্যের প্রাথমিক
উৎস হল গৃহস্থালি আয় ও ব্যয় জরিপ, যা জাতীয় ও বিভাগীয় পর্যায়ে নির্ভরযোগ্য
অনুমান প্রদান করে। বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি এর সহযোগিতায়
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক গৃহস্থালি আয় ও ব্যয় জরিপ এবং
জনসংখ্যা ও গৃহগণনা শুমারির ২০২২ সালের ডাটার উপর ভিত্তি করে ২০২৪ সালে
"বাংলাদেশের দারিদ্র্য মানচিত্র ২০২২" প্রনয়ণ করেছে । বিবিএস মানচিত্রটি
‘মৌলিক চাহিদার মূল্য পদ্ধতি’ ব্যবহার করে প্রনয়ণ করেছে, যা ‘ক্ষুদ্র এলাকা
অনুমান’ কৌশলের মাধ্যমে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের দারিদ্র্য অনুমান প্রদান
করে।
বাংলাদেশের দারিদ্র্য মানচিত্র - ২০২২ কেবল একটি পরিসংখ্যানগত
প্রতিবেদন নয়, দারিদ্র্য মানচিত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যানগত কৌশলগত
হাতিয়ার যা বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে কত শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বাস
করে সে অনুমান প্রদান করে। ‘ক্ষুদ্র এলাকা অনুমান’ কৌশল ভিত্তিক এ উদ্ভাবনী
ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের অগ্রগতি
প্রমাণ-ভিত্তিক নীতি নির্ধারণের পথ প্রশস্ত করেছে। বাংলাদেশের দারিদ্র্য
মানচিত্র - ২০২২ নীতিনির্ধারক, উন্নয়ন অংশীদার এবং গবেষকদের জন্য একটি
অমূল্য হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে । এটি দারিদ্র্যের হটস্পটগুলি সনাক্ত
করতে সহায়তা করে, সরকার এবং উন্নয়ন অংশীদারদের প্রদত্ত সম্পদকে অগ্রাধিকার
ভিত্তিতে বরাদ্দ দিতে এবং যাদের জন্য বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাদের
চিহ্নিত করে কার্যক্রম পরিচালনা করতে সহায়তা করছে। এতে করে সম্পদের
কার্যকরী বন্টন ও প্রকল্পগুলোর উন্নত পরিচালনা সম্ভবপর হচ্ছে, যা ২০৩০
সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনের দিকে বাংলাদেশের গতিপথকে
ত্বরান্বিত করে লক্ষমাত্রা অর্জনের সহজতর হবে ।
দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে
বাংলাদেশের লড়াই এখনও শেষ হয়নি । বাংলাদেশের দারিদ্র্য মানচিত্র - ২০২২
প্রতিবেদনে ২০১০ সালের দারিদ্র্যের হারকে ২০২২ সালের প্রবণতার সাথে তুলনা
করে, দারিদ্র্যপ্রবণ জেলাগুলির পরিবর্তন প্রকাশ করা হয়েছে । বিবিএস জরিপে
২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দারিদ্র্যপীড়িত জেলাগুলিতে পরিবর্তনের তথ্য উঠে
এসেছে। ২০১০ সালে, সবচেয়ে দারিদ্র্য-পীড়িত জেলা ছিল শরীয়তপুর, তারপরে
ময়মনসিংহ, শেরপুর, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ী, কুড়িগ্রাম, নেত্রকোনা, বরিশাল,
ফরিদপুর, মাদারীপুর এবং সিরাজগঞ্জ। ২০২২ সালের মধ্যে নরসিংদী, পিরোজপুর,
কিশোরগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঝালকাঠি এবং পঞ্চগড় নতুন দারিদ্রপ্রবণ জেলা
হিসেবে আবির্ভূত হয়। এদিকে, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও
সিরাজগঞ্জ, যেগুলো ২০১০ সালে সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যপীড়িত ছিল, সেগুলো আর এই
তালিকায় নেই। তবে, মাদারীপুর, নেত্রকোনা এবং কুড়িগ্রাম ২০১০ এবং ২০২২
সালেও সবচেয়ে দারিদ্র্যপ্রবণ জেলাগুলির মধ্যে রয়ে গেছে।
বিবিএসের নতুন
মানচিত্র তথ্য অনুসারে, ৬৪ জেলার মধ্যে মোট ১৯টি জেলা উচ্চ দারিদ্র্য
হারের ক্যাটাগরিতে রয়েছে। তবে উচ্চ দারিদ্র্য ক্যাটাগরির সংখ্যার ভিত্তিতে
তালিকায় শীর্ষ পাঁচটি জেলা হল মাদারীপুর, নরসিংদী, পিরোজপুর, কিশোরগঞ্জ
এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ। বিবিএসের তথ্য অনুসারে, মাদারীপুরের সবগুলো উপজেলাই
সর্বোচ্চ দারিদ্র্যপ্রবণ হিসেবে বিবেচিত। আলোচ্য মানচিত্র অনুযায়ী
মাদারীপুর জেলার দারিদ্র্যের হার ৫৪.৪ শতাংশ। উপজেলা পর্যায়ে, মাদারীপুরের
ডাসারে সর্বোচ্চ দারিদ্র্যের হার ছিল ৬৩.২ শতাংশ এর পরেই, ময়মনসিংহের
হালুয়াঘাট উপজেলায় দারিদ্র্যের হার ৫৯.৬ শতাংশ । ঢাকার পল্টনে দারিদ্র্যের
হারের সর্বনিম্ন ১ শতাংশ। বিবিএসের হালনাগাদ মানচিত্র প্রতিবেদনে
নোয়াখালীকে ২০২২ সালে সর্বনিম্ন দারিদ্র্যের হারের জেলা হিসেবে চিহ্নিত করা
হয়েছে, যা ৬.১%। এর পরেই রয়েছে ঢাকা (৮.৬%) এবং মেহেরপুর (৯.৮%), খুলনা
(১০.২%), ফেনী (১০.৫%), সিরাজগঞ্জ (১০.৯%), হবিগঞ্জ (১০.৯%), মুন্সিগঞ্জ
(১১.৩%), চট্টগ্রাম (১২%) এবং বগুড়া (১২%)।
বাংলাদেশের দারিদ্র্য
মানচিত্র ২০২২ তথ্য অনুসারে কুমিল্লা জেলার মোট ১৭ টি উপজেলার মধ্যে বরুরা
উপজেলা উচ্চ দারিদ্র্য হারের ক্যাটাগরিতে রয়েছে (দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে
বেশি ) । সদর দক্ষিণ উপজেলা সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে (দারিদ্র্যের হার
সবচেয়ে কম) । কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার, লালমাই, মুরাদনগর, নাংগলকোট, আদর্শ
সদর উপজেলা নিম্ন দারিদ্র্য হারের ক্যাটাগরিতে রয়েছে (ভালো অবস্থায় আছে) ।
কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া, বুড়িচং, চান্দিনা, চৌদ্দগ্রাম, দাউদকান্দি,
তিতাশ, লাকসাম, মনোহরগন্জ্ঞ, মেঘনা, হোমনা উপজেলার মধ্যম দারিদ্র্য হারের
ক্যাটাগরিতে রয়েছে।
দারিদ্রতা মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের শামিল।
দারিদ্র্য নিজে নিজে তৈরি হয় না, বরং আমরা একে অন্যকে সহযোগিতা করি না বা
সবার জন্য উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চাই না বলেই দারিদ্র্যতার বিষবাষ্প সমাজে
ছড়িয়ে পড়ে। দারিদ্রতা দূরীকরণে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। দারিদ্র দূরীকরণের জন্য শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের জ্ঞান ও
দক্ষতা বৃদ্ধি করে বিশ্বমানের মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা; সবার জন্য
স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা; আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং
অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা; দরিদ্র ও অসহায়
মানুষের জন্য বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বরাদ্দ বৃদ্ধি করা;
নারীদের প্রকৃত ও কার্যকরি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা;
পরিবেশের সুরক্ষার সাথে সাথে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা অতি জরুরি
। আসুন সবাইকে নিয়ে সুখে থাকার মন্ত্র হৃদয়ে ধারনা করে একটি
দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ ও দেশ গঠনে কাজ করি। ভালো থাকুক প্রিয় স্বজন, প্রিয়
মাতৃভূমি, আমাদের আগামীর পৃথিবী ।
লেখকঃ পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।