রোববার ২২ জুন ২০২৫
৮ আষাঢ় ১৪৩২
ট্রেনের জানালায় যখন ‘শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে’
দেলোয়ার হোসেন
প্রকাশ: রোববার, ২২ জুন, ২০২৫, ১:১৪ এএম আপডেট: ২২.০৬.২০২৫ ১:৫৯ এএম |


 ট্রেনের জানালায় যখন ‘শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে’
আমি অনেকদিন পত্রিকায় লিখি না। আগ্রহ থাকলেও লিখতে ইচ্ছে হয় না। আগ্রহ আর ইচ্ছার মাঝে নিশ্চয় তফাৎ আছে। যাইহোক, শ্রাবণ মাসের তৃতীয় দিন। শ্রাবণের কথা শুনেই বুঝতে পারছেন বর্ষা তার পূর্ণ যৌবণ নিয়ে মাঠে নেমেছে। দিনটা শুরু হয়েছিল একধরনের নরম বিষণ্নতায়, যেন আকাশেরও কোনো কথা ছিল না। সকাল নয়, যেন এক দীর্ঘশ্বাস। ঢেউয়ের গর্জনের উত্তাল সমুদ্র দেখবো বলে বৈরী আবহাওয়ায় মায়ের হাতের নাস্তা খেয়ে ছাতা হাতে বের হলাম। প্রাথমিক গন্তব্য বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রাম। এরপর সেখান থেকে পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেন ধরে সমুদ্রতমা কক্সবাজার। কোলাহল তখনও ক্লান্ত হয়নি, কিন্তু আকাশ কেমন নিঃশব্দ, ধূসর আর গাঢ় মেঘে মোড়া। চট্টগ্রামের রেলস্টেশনে এসে দাঁড়াতেই মনে হলো—সময়ের শরীরেও যেন জ্বর, কোথাও কিছুই নির্ভরযোগ্য নয়।
পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেন চট্টগ্রাম হতে কক্সবাজার অভিমুখী হয়ে ছাড়ার কথা ছিল বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে। কিন্তু ইঞ্জিনের যান্ত্রিক ত্রুটি যেন সময়কে থমকে দিল। দীর্ঘ বিলম্বে ট্রেন পথে আটকা পড়ে আছে। স্টেশনের ঘড়ির কাঁটাগুলো এগোচ্ছে, কিন্তু প্ল্যাটফর্মে কেবল যাত্রীদের অপেক্ষার কোলাহল।
আমি অপেক্ষার দীর্ঘশ্বাসে নিজেকে আটকে রাখিনি। যেহেতু ট্রেন বিলম্ব করবে তাই এই ফাঁকে ছোট কাকার বাসায় চলে যাই। হাতে মৌসুমি ফলের প্যাকেট, মনে এক ধরনের চুপচাপ আনন্দ। চাচীর রান্নাঘরে তখন ভাতের গন্ধে ভেসে বেড়াচ্ছে দুপুরের রোদহীন তাপ। জানালার পাশে বসে চায়ের কাপ হাতে একটা মুহূর্ত দাঁড়িয়ে যায়—যেন সময় তার নিজের ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সংসার-ছায়ার নিচে।
তখন অল্প বৃষ্টি চুল ভিজিয়ে দিচ্ছে। সেখানে থেকে বেরিয়ে একটি উবারে আবার ফিরে আসি রেলস্টেশনে। ট্রেন ছাড়ে ঠিক সোয়া তিনটায়। বাইরে তখন মেঘলা দুপুর। বৃষ্টির ফোঁটা ট্রেনের জানালায় থেমে থেমে পড়ছে—একটা অলিখিত কাব্যের মতো। হেডফোনটায় বাজতে থাকে ছোটবেলার ছড়া, “রেলগাড়ি ঝমাঝম-পা পিছলে আলুর দম, মাস্টার বাবু বলে গেছেন ইস্টিশনের মিষ্টি গুড -শখের বাগান গোলাপ ফুল...."
হাতে গরম কফি আর কোলের ওপর মীর্জা গালিবের কবিতার বই। জানালার কাঁচে মাথা হেলিয়ে বসে আছি—একটা ভ্রমণ শুরু হলো শুধু গন্তব্যের দিকে নয়, বরং নিজের ভেতরের একাকিত্বে। আমি চোখ বুলিয়ে পড়ছি গালিব লিখেছেন, 
“হাজারো খ্বাহিশে অ্যায়সি, কি হার খ্বাহিশ পে দম নিকলে- 
হাজারো ইচ্ছা থাকে মানুষের, প্রতিটি ইচ্ছার পেছনেই যেন প্রাণ ঝরে যায়।”
সেই মুহূর্তে যেন আমিও একজন ইচ্ছাহীন যাত্রী। ট্রেনের প্রতিটি ঝাঁকুনিতে কোনো না কোনো স্মৃতি হঠাৎ জেগে ওঠে। সবুজ মাঠ পেরিয়ে যায় ট্রেন, ছুটে চলে পাথুরে পাহাড়ের গায়ে আঁকা কাঁচা রাস্তাগুলো, গ্রামের টিনের ঘর, শিশুরা খেলছে কাদার মধ্যে, দূরে কোথাও ধোঁয়া উঠছে রান্নাঘর থেকে। আমার বুকের গভীরে তখন বাজে আরেকটি পংক্তি—“হৃদয় তো পাথর নয়, দুঃখে তা ভরে উঠবে না কেন?”
এই ভ্রমণ এক ধরনের নিরব অনুশোচনার মতো। সদ্য নির্মিত রেলপথ, কাটাছেঁড়া পাহাড়, আধা-পাকা রাস্তা আর প্রকৃতির সবুজ স্তব্ধতা যেন বলে ওঠে— সময় বদলাচ্ছে, কিন্তু অনুভূতি? সেগুলো কি কোনোদিন বদলায়? গালিব বলেছেন,
“জানি আমি জান্নাতের আসল রূপ কী,
তবু মনের খুশির জন্য এমন কল্পনাও ভালো।”
আমার ট্রেন তখন ঢুকে পড়ছে পাহাড়ি পথে, এক মুহূর্তের জন্য বাইরের দৃশ্য নিঃশেষ। কেবল কফির উষ্ণতা আর কবিতার পংক্তি রয়ে যায় সঙ্গে। আরও একটি লাইন—যেটি যেন এই ট্রেনযাত্রার প্রতিধ্বনি হয়ে রয়ে যায় দীর্ঘক্ষণ,
“যেখানে দেহ পুড়েছে, সেখানে হৃদয়ও নিশ্চয় পুড়েছে। তুমি যে ছাই খুঁড়ছো, ছাই থেকে আগুনের ঝিলিক কি সত্যিই পাবে?”
কখনো গাছের ছায়া পড়ে ট্রেনের জানালায়, কখনো বৃষ্টির রেখা কাঁচে আঙ্গুল চালিয়ে এক একটি অক্ষর তৈরি করে। আমার বুকের মধ্যে যেন একটা শব্দহীন কবিতা জন্ম নিচ্ছে। ট্রেন ছুটে চলে, গন্তব্যের দিকে নয়—অতীতের দিকে, চেনা অভিমানের দিকে, কোথাও গভীর ভালোবাসার ছায়ায়। এই যাত্রা ছিল কেবল কক্সবাজার যাওয়ার নয়, এ ছিল নিজের ভেতরের ক্লান্ত গলিঘুঁজি দিয়ে হেঁটে যাওয়ার এক উপলক্ষ। একটানা ছুটে চলা সময়ের পাশে কখনো নিজেকে থামিয়ে দাঁড়ানোর নাম—এই ট্রেনের জানালায় বসে থাকা।
যাত্রা শেষে মনে হলো, ঠিক এমন একটি মেঘলা দিনের গল্পই হয়তো গালিব নিজেও লিখতেন,
“যেখানে প্রকৃতি, বিলম্ব, কাব্য আর এক চিলতে একাকিত্ব এক হয়ে বয়ে যায় সময়ের রেলপথ ধরে। হয়তো শেষ স্টেশন আসবে, নেমে যেতে হবে।”
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় ট্রেন কক্সবাজার এসে পৌঁছালো। ট্রেন থেকে নামার পর ভাবছি, আমরাও এর বাহিরে? মনের ভিতর যে ট্রেনটা আজ চলেছে-তা কোথায় থামবে, কেউ জানে না, হয়তো আকাশ জানে কিংবা নীহারিকা জানে।  সব শেষে ঘরে ফিরলে মনে হয়, জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে।
লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ












সর্বশেষ সংবাদ
৫৮ লাখ টাকার অপচয়ে আকাশমুখী লিফট
লাকসামে বৃদ্ধাকে হত্যার অভিযোগে নারী গ্রেপ্তার চাঞ্চল্যকর তথ্য উদঘাটন
পুনাকের আয়োজনে ফল উৎসব পুলিশ পরিবারে সৌহার্দ্য-ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি করবে- পুলিশ সুপার
লালমাইয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা
লাকসামে কৃষককে কুপিয়ে জেলহাজতে প্রবাসী
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
ঢাকা মেডিকেল কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন: ৫৮ লাখ টাকা অপচয়ে আকাশমুখী লিফট
বান্ধবীকে শার্ট ও ক্যাপ পরিয়ে ছেলেদের হলে নিয়ে আসে নাজমুল, অতঃপর...
দলমত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে -মনিরুল হক চৌধুরী
দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় পুলিশের বিশেষ অভিযানে গ্রেফতার ১৫৫৬ জন
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২