বাংলাদেশের অর্থনীতির অচলাবস্থা যেন কাটছেই না। আশা ছিল জুলাই-গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্র্বতী সরকারের হাত ধরে অর্থনীতির চাকা সচল হবে। বিনিয়োগ কমে যাওয়া, বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি, আর্থিক খাতে দুর্বলতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে সেই আশাবাদও ক্ষীণ হয়ে গেছে। শনিবার পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তিনটি প্রতিবেদনে বাজেট সামনে রেখে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি তুলে ধরা হয়েছে, যা আমাদের শঙ্কিত করে।
সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনসিটিএডি বা আংকটাড), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিবেদনগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির এক কঠিন চিত্র তুলে ধরেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে স্থবিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং আর্থিক খাতে দুর্বলতা—এসবই অর্থনীতির গতিকে শ্লথ করে দিয়েছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর রপ্তানিপ্রবাহে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে, বিশেষ করে পোশাক ও কৃষি খাতে। এর ফলে মার্কিন বাজারে প্রবেশ আরো কঠিন হয়ে পড়বে।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির পূর্বাভাস বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গত ৩৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা বিনিয়োগ কমে যাওয়া ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ফল। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, নানা কারণে নতুন বিনিয়োগেও স্থবিরতা বিরাজ করছে। জ্বালানি-বিদ্যুতের ঘাটতির পাশাপাশি যোগ হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মব-সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বৈশ্বিক বাণিজ্যনীতির অনিশ্চয়তা বিনিয়োগ, রপ্তানি ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আরো দুর্বল করে দিতে পারে।
এডিবির বিশ্লেষণ অনুসারে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শ্রমিক বিক্ষোভ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের অর্থনীতির সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির ওপর প্রভাব ফেলেছে। আইএমএফও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হওয়া এবং ভোগের প্রবণতা কমে যাওয়ার কথা বলছে।
এই পরিস্থিতিতে আসন্ন বাজেটও ধারকর্জ নির্ভর এবং সীমিত আকারের হতে যাচ্ছে। অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিবর্তে বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো হবে, যার একটি বড় অংশ আবার সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে। উন্নয়ন প্রকল্পেও বরাদ্দ কাটছাঁট করা হয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ স্বীকার করেছেন যে সরকার নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন এবং আইএমএফের শর্তগুলো মেনে চলতে হচ্ছে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির ধীরগতির কারণে আগামী অর্থবছরেও সরকার সন্তোষজনক আয় বাড়ানোর পথ সুগম করতে পারেনি। রাজস্ব আয়ে বড় ঘাটতি। তহবিল সংকটে উন্নয়ন প্রকল্পেও গতি নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগে চলছে এক ধরনের স্থবিরতা।
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার উৎস শক্তিশালী করা (রপ্তানি ও রেমিট্যান্স) এবং বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে বিনিয়োগের পরিবেশ স্থিতিশীল করা এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা না গেলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে।