আইনশৃঙ্খলা
পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক ও সহনীয় রাখা রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে রাষ্ট্র
সর্বশক্তি নিয়োগ করে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক ও সবার জন্য নিরাপদের নিমিত্তে।
এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ব্যর্থ হলে সাধারণ জনগণকে নিদারুণ কষ্টের মধ্যদিয়ে
যেতে হয়, পদে পদে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। বাংলাদেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা
পরিস্থিতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই উদ্বেগ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন। উদ্বেগ
দেখালেও যেভাবে শক্ত হাতে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভবপর হয়, সে
লক্ষ্যে উদ্যোগ কিংবা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এখনো আইন নিজের হাতে তুলে
নেওয়ার মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। পত্রিকার পাতা খুললেই দেশের বিভিন্ন জায়গায়
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির শোচনীয় অবস্থা নিয়ে সংবাদ পরিবেশিত হতে দেখা যাচ্ছে।
চলমান যে পরিস্থিতি তা বজায় থাকলে নিরাপত্তাহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হবে,
ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি হবে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দ্রুত কার্যকর
ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে
চলে যাবে।
রাজনৈতিক বিবেচনায় হত্যা, গুরুতর আঘাত, জখম, জমি বেদখল ও
আঘাতের ঘটনা ঘটছে মারাত্মকভাবে। সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা
যায়, চট্টগ্রামের রাউজান এলাকায় বিগত আট মাসে ১২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর
মধ্যে অধিকাংশ ঘটনাই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় ঘটেছে বলে সংবাদ থেকে জানা যায়।
প্রকাশ্যে খুন করে অপরাধীরা ঘটনাস্থল থেকে নিরাপদে সরে যাচ্ছে। উল্লিখিত
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে কয়েকবার বদলি করা হয়েছে। তবুও
পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটছে না।
মানুষের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক ব্যাপকভাবে
ভর করেছে। ভুক্তভোগী পরিবার বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছে, আবার অনেকেই থানায়
মামলা করতেও ভয় পাচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে ট্যাগ দিয়ে মামলা-হামলার ঘটনাও ঘটছে
অহরহ। একই দলের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে দুর্বল ও
কাবু করতে খুনের মতো ভয়াবহ ঘটনাও ঘটছে। দেশের অনেক জায়গায় ভয়ে-আতঙ্কে
পালিয়ে বেড়াচ্ছেন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা, মিথ্যা মামলায় অনেককে
গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি পর্যায়ক্রমে টালমাটাল হয়ে পড়ছে।
পরিবর্তিত
পরিস্থিতিতে দাগি আসামিরা জামিন নিয়ে বের হয়ে পূর্বশত্রুতাবশত অনেকের ওপর
আক্রমণ চালাচ্ছে। ব্যক্তিগত আক্রোশের বিষয়গুলোকে রাজনৈতিক মোড়কে আচ্ছাদন
করে হামলার বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। বাইরে থেকে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা দেশে
ফেরত এসে সংঘবদ্ধ হয়ে অপরাধকর্মে সম্পৃক্ত হওয়ার খবরও আসছে। নামে-বেনামে
চাঁদাবাজির খবর আসছে, জবরদখল, সরকারি সম্পত্তি দখল, অন্যের বাড়িঘর পুড়িয়ে
দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রবল আকার ধারণ করায় অপরাধীরা এ
সুযোগটি কাজে লাগিয়ে অপকর্ম করে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় এখনো মব
জাস্টিসের নামে আইন হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। সবকিছু মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা
পরিস্থিতি উত্তপ্ত, আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে তটস্থ অনেকেই। পুলিশের সঙ্গে জনগণের
দূরত্বের মাত্রা কমার উদ্যোগ তেমন একটা চোখে পড়ছে না। পুলিশ বাহিনী
স্বতঃস্ফূর্তভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। কেননা, পুলিশের মধ্যে নানা কারণে
অস্বস্তি ও ক্ষোভ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নিরীহ পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন মামলায়
আসামি করা হচ্ছে, পুলিশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ না করার পেছনে এটি একটি
গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
কিছু মানুষ কেন আইন হাতে তুলে নিচ্ছে? এর পেছনে
অন্যতম কারণ হচ্ছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যত মবের ঘটনা ঘটেছে, কোনো ঘটনার
সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে
মবের ঘটনা আগে থেকে জানলেও তা প্রতিহতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এসব
ঘটনার কারণেই মব জাস্টিসের সুযোগটি অপরাধীরা কাজে লাগাচ্ছে। ব্যক্তিগত
ক্রোধ, জিঘাংসা, পূর্বশত্রুতা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ইত্যাদি কারণে ষড়যন্ত্র
করে মবের ঘটনা ঘটিয়ে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার অংশ হিসেবে মব জাস্টিসের
ঘটনাগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ঘটাচ্ছে। মব জাস্টিসের লাগাম টেনে ধরতে হবে,
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহ করতে হবে।
কেউ অপরাধী
হয়ে থাকলে, কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট
ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আইনে ব্যবস্থা নেবে। কেউ এ
ক্ষেত্রে আইন হাতে তুলে নিতে পারে না। মব জাস্টিসের ঘটনাকে যারা উৎসাহ
দিচ্ছে কিংবা সরাসরি জড়িত তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের কঠোর ভূমিকা
পালন করতে হবে। তাহলেই মব জাস্টিসকে প্রতিহত করা সম্ভব।
গায়েবি মামলা,
অজ্ঞাত নামে মামলা, মিথ্যা মামলা- এগুলো রাজনৈতিক জটিলতা বাড়িয়ে তুলছে। এর
প্রভাব পড়ছে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর। সে ক্ষেত্রে প্রাথমিক
সত্যতা যাচাই করে মামলা রুজু করা উচিত। অন্যদিকে যারা মিথ্যা মামলা দিয়ে,
ভুল মামলা দিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি করে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায়
নিয়ে আসা উচিত। দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কয়েক শ মানুষকে আসামি করে
মামলা রুজু করা হচ্ছে। আইনজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এসব মামলার ক্ষেত্রে তেমন
শক্তিশালী প্রমাণাদি পাওয়া যাবে না। কেবলমাত্র প্রতিপক্ষকে হয়রানির
উদ্দেশ্যে যারা মামলা করছে তাদের বিরুদ্ধে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণই
পারে মিথ্যা মামলার সংখ্যা কমাতে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন
হয়ে পড়লে দেশের অন্যান্য সেক্টরে দুর্নীতি ও অনিয়ম ক্রমান্বয়ে বেড়ে যায়।
শেয়ারবাজারে লুটপাটের ঘটনা আড়ালে পড়ে যায়, টাকা পাচারের ঘটনা তেমন আলোচনায়
আসে না, মানব পাচার ও মাদক পাচার এবং বাজারজাতের সংবাদও সবার নজরের বাইরে
থেকে যায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হলে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণও কমে
যায়, উদ্যোক্তারা দুশ্চিন্তায় থাকেন। কর্মহীন হয়ে পড়েন কর্মজীবীরা,
পরিস্থিতি কেবলই ঘোলাটে হয়ে ওঠে।
মানুষের জীবনের নিরাপত্তা আগে,
নিরাপত্তা যেখানে বিঘ্নিত, সেখানে অপরাপর সব সূচকেই দেশের স্থিতি ভঙ্গুর
হয়ে যায়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিদ্যমান থাকলে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসী ও
অপরাধীরা প্রকাশ্যে বের হয়ে এসে সংঘবদ্ধভাবে অপকর্ম সম্পাদন করে থাকে। ফলে
বিপদের মধ্যে পড়ে সাধারণ জনতা, ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্রের অবকাঠামো ও
সম্পত্তি। দেশব্যাপী বর্তমানে যারা অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে কিংবা
গুরুতর অপরাধ করছে, এদের গ্রেপ্তার করলে দেখা যাবে আগেও প্রত্যেকের অপরাধ
করার উদাহরণ রয়েছে। সুতরাং যারা বারবার অপরাধ করছে, তাদের নিবৃত করতে হবে।
রাষ্ট্রীয় আইনে অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে অন্যদের কাছে উদাহরণ সৃষ্টি করতে
হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির ভয়াবহতা সম্পর্কে সবাই ওয়াকিবহাল। সে ক্ষেত্রে
অপরাধ করে যাতে কেউ রেহাই না পায় সে ব্যাপারে রাষ্ট্রকে কঠোর হতে হবে।
কাজেই
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক ও নিরাপদ রাখতে এলাকাভেদে, সময় নির্ধারণ
করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে- দেশের জনগণের নিরাপত্তা
সবার আগে। জনগণ যদি নিরাপদে ও স্বস্তিতে না থাকতে পারে তাহলে রাষ্ট্রের
প্রয়োজনীয়তা অর্থহীন হয়ে পড়ে। অতএব, চলমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে
রাষ্ট্রীয় পলিসি লেবেলে যথার্থ নীতি প্রণয়ন করে সেসবের বাস্তবায়ন নিশ্চিত
করতে হবে। অযথা কাউকে হয়রানি করা হবে না, কেবলমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায়
মামলা গ্রহণ করা যাবে না- এ ধরনের ঘোষণা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখতে হবে।
রাষ্ট্রের
নাগরিকদের আশ্বস্ত করতে হবে, আইন সবার জন্য সমান। অপরাধীদের শাস্তিদানে
রাষ্ট্র বদ্ধপরিকর, এ ধরনের বার্তার প্রয়োজনীয় বাস্তবায়নই পারে দেশের
অভ্যন্তরে স্থিতিশীল ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে। অন্যদিকে, জনগণের সঙ্গে
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীকে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের চাহিদানুযায়ী
পুলিশিং নিশ্চিত করতে পারলে অপরাধীদের আস্ফালন বহুলাংশে কমে আসবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়