উন্নত-অনুন্নত প্রায় সব দেশই নিজেদের শিল্পভিত্তিকে শক্ত করার চেষ্টা করে। নিজস্ব অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করা এবং নিজস্ব জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করায় নিজস্ব শিল্প বিকাশের কোনো বিকল্প নেই। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশও তা-ই চায়, কিন্তু কখনো কখনো সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত ও তার অপপ্রয়োগ সেই ধারাবাহিকতাকে ক্ষুণ্ন করে। তেমনি একটি সিদ্ধান্ত হচ্ছে শুল্কমুক্ত বন্ড সুবিধার আওতায় পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য কাগজ আমদানি করতে দেওয়া।
যথাযথ দেখভালের অভাবে একটি অসাধু চক্র বিপুল পরিমাণ কাগজ আমদানি করছে এবং শর্ত ভেঙে সেগুলো খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। এর ফলে দেশীয় কাগজশিল্পের অস্তিত্ব হুমকির মুখে এসে পড়ছে।
দেশে নিবন্ধিত পেপার মিলের সংখ্যা ১২৮। এর মধ্যে ১০৬টি মিলের কাগজ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে বছরে ১৬ লাখ মেট্রিক টন।
কাগজের অভ্যন্তরীণ চাহিদা রয়েছে ৯ লাখ মেট্রিক টন। মিলগুলো অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত কাগজ ৪০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করছে। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। এই খাতে প্রত্যক্ষভাবে ২৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে এবং পরোক্ষভাবে এক কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল।
দেশীয় কাগজশিল্পের উদ্যোক্তারা এই খাতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। কাগজশিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে ৩০০টির বেশি সহায়ক শিল্প গড়ে উঠেছে। এই খাত প্রতিবছর পাঁচ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব দিয়ে আসছে। আমদানি বিকল্প শিল্প হিসেবে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করছে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) নির্ধারিত স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী চাহিদার সব কাগজ সরবরাহে সক্ষমতা রয়েছে দেশীয় মিলগুলোর।
২০ বছর ধরে এনসিটিবির সরাসরি কেনা কাগজ দেশীয় মিলগুলো নির্ধারিত গুণগত মান বজায় রেখে এবং এনসিটিবির সব শর্ত পরিপালন করে সরবরাহ করে আসছে। তা সত্ত্বেও কাগজ আমদানির জন্য প্রযোজ্য শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) মওকুফ করা হয়। এর ফলে এনসিটিবির কার্যাদেশ পাওয়া মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দেশীয় মিলের কাগজ না কিনে বিনা শুল্কে ছাপার কাগজ আমদানি করছে এবং শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানির শর্ত ভঙ্গ করে খোলাবাজারে তা বিক্রি করে দিচ্ছে, যা দেশীয় কাগজশিল্পের অস্তিত্বের জন্য বিরাট হুমকিস্বরূপ। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে এসব তথ্য তুলে ধরে আমদানিতে শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমএ)। সংগঠনটির পক্ষে এর আগেও শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে দেওয়া আবেদনে বলা হয়, দেশীয় কাগজকলগুলোর দেশের চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদনক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিদেশ থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাগজ আমদানি করা হচ্ছে এবং খোলাবাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে দেশীয় কাগজশিল্প। এই অবস্থায় ছাপার জন্য কাগজ আমদানিতে শুল্ক মওকুফের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়েছে বিপিএমএ।
আমরা মনে করি, দেশীয় কাগজশিল্পের স্বার্থে শুল্ক সুবিধায় কাগজ আমদানির অনুমতি প্রত্যাহার করা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি যারা এই সুবিধার অপব্যবহার করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।