চিত্রটি উদ্বেগজনক। রাজধানীর ছিন্নমূল শিশু-কিশোররা মাদক সেবন ও কারবারের সঙ্গে জড়িত। তারা প্রকাশ্যে মাদক কেনাবেচা করছে। এদের অধিকাংশই মরণ নেশায় আসক্ত। এই আসক্তির ফলে তারা চলে যাচ্ছে অন্ধকার জগতে। শিক্ষালাভের পরিবর্তে অকালেই স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে। জড়িয়ে পড়ছে চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এই সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে মাদকের অপব্যবহার একটি সামাজিক ও স্বাস্থ্য সমস্যা। শিশুর শারীরিক, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে এই মাদকাসক্তি গুরুতর বিরূপ প্রভাব ফেলে। লঙ্ঘিত হয় শিশু মানবাধিকার। একটা পুরো প্রজন্ম এভাবে বড় হচ্ছে শিক্ষাবঞ্চিত অপরাধী ও সন্ত্রাসী হিসেবে। কিন্তু সমাজ ও সরকারের এদিকে কোনো নজর নেই।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার ঘোষণাপত্রে (১৯৫৯) বলা হয়েছে, শিশু-কিশোরদের বিশেষ সুরক্ষা দিতে হবে। বৈষম্য থেকে তাদের মুক্ত রাখতে হবে। এই সুরক্ষা পাওয়া এবং বৈষম্য থেকে দূরে থাকার বিষয়গুলো শিশুর মানবাধিকার। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল ইউনিসেফের পরিসংখ্যান (২০২৩) বলছে, বাংলাদেশে ছিন্নমূল পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, এই পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাদকে আসক্ত। সংগঠনটির হিসাবে ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি স্পট রয়েছে, যেখানে ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা মাদক সেবন করে। তারা সাধারণত গাঁজা, ড্যান্ডি, গামবেল্ডিং ও পেট্রল শুঁকে নেশা করে। ক্ষুধার জ্বালা, একাকিত্বের কষ্ট বা সঙ্গদোষে নিচ্ছে নানা ধরনের মাদক।
দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধূরী খবরের কাগজকে বলেছেন, রাজধানী ঢাকা ও তার আশপাশে প্রায় ৫ হাজার বস্তি রয়েছে। সেখানে প্রায় ২০ লাখ মানুষের বসবাস। এদের এক-তৃতীয়াংশই শিশু। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) তথ্যমতে, দেশে মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৭০ লাখের বেশি। এদের ৮০ শতাংশই কিশোর-তরুণ।
মাদক কেনাবেচা হয় রাজধানীর এ রকম চার-পাঁচটি স্থানে ঘুরে যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তা একদিকে যেমন ভয়াবহ, তেমনই উদ্বেগজনক। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের মাদক চক্রের তৎপরতার খবর কমবেশি সবারই জানা। এই ক্যাম্পের পেছনে বিশেষ কয়েকটি স্থান আছে, যেখানে এই অপরাধ হচ্ছে। কারওয়ান বাজার বস্তির শিশুদের বেশির ভাগই মাদকাসক্ত। কমলাপুর রেললাইনের ছিন্নমূল শিশুদেরও একই অবস্থা। কারওয়ান বাজারের রেললাইনের বস্তিতে রাতের বেলা বসে মাদকের হাট। কমলাপুর রেললাইনসংলগ্ন এলাকার চিত্র প্রায় অভিন্ন। এখানকার ছিন্নমূল ও ভাসমান শিশুরা ‘ড্যান্ডি’ নেশায় মত্ত। পথশিশুদের কথায়, ড্যান্ডি গ্রহণের অন্যতম কারণ ক্ষুধা। ড্যান্ডি নিলে ঝিমুনি ও ঘুম আসে। ক্ষুধার কথা মনে থাকে না।
বাংলাদেশের সংবিধানে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের ক্ষেত্রে পাঁচটি মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো সরকারই ছিন্নমূল মানুষের কথা সেভাবে ভাবে না। মাদকে আসক্ত শিশুদের দায় মূলত বর্তায় রাষ্ট্রের ওপর। ছিন্নমূল শিশু-কিশোররা যেহেতু পরিবার-পরিজনহীন অবস্থায় বড় হয়, এদের মানুষের মৌলিক পরিচয় নিয়ে বেড়ে ওঠা, শারীরিক সুরক্ষা, খাদ্য, রাষ্ট্র প্রদত্ত সর্বজনীন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও বিকাশের বিশেষ ব্যবস্থা থাকা দরকার। এর সবই এই শিশুদের মানবাধিকার। বিশেষজ্ঞদের এই মতের সঙ্গে আমরাও মনে করি, সরকারে যারাই থাকেন, তাদের এসব মানুষের জীবন নিয়ে ভাবতে হবে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলেই এই সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব। তবে তার আগে এই মুহূর্তে জরুরি কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। রাজধানীতে মাদক কেনাবেচার যেসব স্পট বা ‘হাট’ রয়েছে, সেই সব স্পট নির্মূল করা জরুরি। সবার চোখের সামনে যেহেতু মাদক কেনাবেচা হয়, সেহেতু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সেই সব স্পটের কথা জানা আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হলেই এগুলো নির্মূল করা সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, এই অপরাধ কমাতে মাদকাসক্ত ছিন্নমূল শিশু-কিশোরদের সামাজিক পুনর্বাসন প্রয়োজন। সরকার এককভাবে এই সমস্যা দূর করতে পারবে না। আমাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই বিপন্ন বিপথগামী শিশুদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তাদের মাদকাসক্তি থেকে মুক্ত করে স্কুলে ফিরিয়ে নিতে হবে। দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী যারা আছেন, বড় বড় ব্যাংক, তারাও এগিয়ে আসতে পারে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকেও আরও সক্রিয় হয়ে এদের নিরাময়ের দায়িত্ব পালন করাটাও জরুরি হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, এই শিশু-কিশোররা আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অংশ। ভবিষ্যতে তারা মূল নাগরিক সমাজের অন্তর্ভুক্ত হবে। তাদের সমস্যার প্রতি এখনই নজর দিতে হবে; এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। সরকারকে তাদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।