ডে-কেয়ার
সেন্টার বা শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের ধারনা আমাদের দেশে খুব বেশি দিন আগের
নয়। শিশুকে ডে-কেয়ার সেন্টারে দেবেন কিনা- এটা নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে রয়েছে
নানা প্রশ্ন ও সংশয়। পরিবারে শিশু প্রতিপালনের জন্য বয়োজ্যষ্ঠ সদস্য থাকলে
মা-বাবা ডে-কেয়ারের কথা চিন্তাও করেন না। আর গ্রামের অভিভাবকরা মনে করেন,
শিশু লালনের জন্যে ডে-কেয়ার সেন্টার বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রশ্ন
হচ্ছে, শহরে মা-বাবা যখন উভয়েই পেশাজীবি তখন শিশুদের দেখাশোনা কে করবে?
পরিবারে বয়োজ্যাষ্ঠ মুরব্বী থাকলে কোন রকমে রক্ষা। তবে এটাও যে খুব ভালো
সমাধান, তা বলা যাবে না। সারাক্ষণ বয়স্ক মানুষের সাথে থাকলে, শিশুর
স্বাভাবিক বিকাশ ব্যহত হয়। আসলে অন্য শিশুদের সাথে খেলাধুলার মাধ্যমেই একটি
শিশুর মানসিক বিকাশ সুন্দর হয়।
অনেকে হয়তো গৃহকর্মী রেখে পরিস্থিতি
সাময়িকভাবে সামাল দেয়ার চেষ্টা করেন। এর ফলও খুব একটা সুখকর হয় না। কারণ
মা-বাবার অনুপস্থিতিতে শিশু গৃহকর্মীর দৃষ্টিভঙ্গি, ভাষা, আচরণ ইত্যাদি
রপ্ত করেন। গৃহকর্মীর যত্নে আন্তরিকতার অভাব থাকলে, অথবা গৃহকর্মী যদি
মোবাইল/ টিভিতে গান ছেড়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করেন, তাহলে এর পরিণাম ভয়াবহ হয়।
এক্ষেত্রে
ডে-কেয়ার সেন্টার একটি সুন্দর সমাধান হতে পারে। উন্নত বিশ্বের
নীতি-নির্ধারকগণ বহু আগেই এসব সমস্যাকে চিহ্নিত করেছেন, সমাধানের ক্ষেত্রেও
বাস্তব কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। শুধু তাই নয়, তারা ডে-কেয়ার
সেন্টারগুলোকে এমনভাবে পরিচালনা করছে, যাতে শিশুরা প্রাথমিক কান্ডজ্ঞান,
আদব-কায়দা, শিষ্টাচার ইত্যাদি বিষয় শিখে যায়। এছাড়াও রাস্তা পারাপারসহ
কীভাবে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে, হঠাৎ আগুন লাগলে বা ভূমিকম্প হলে কী
করতে হবে ইত্যাদি প্রশিক্ষণও শিশুদের দেওয়া হয়। যা শিশুদের সু-নাগরিক
হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে।
আসলে শিশুর সুন্দর বিকাশ ও সামাজীকরনে
ডে-কেয়ার সেন্টারের ভূমিকা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ পরিবারে হয়ত
শিশু একা একা সময় কাটাতো, কিন্তু এখানে সে অনেক শিশুর সাথে মেশার সুযোগ
পাচ্ছে। এর ফলে অন্য শিশুদের সাথে তাকে মানিয়ে চলতে হয়। একসাথে খেলাধুলা
করতে পারে, সবাই মিলে গল্প করা, ছবি আঁকা ইত্যাদি অনেক কিছু শিখে যায়।
মা-বাবা
থেকে কিছুসময় আলাদা থাকার কারণে শিশু কিছুটা আত্ম-নির্ভরশীল হতে শেখে।
এছাড়া অনেক ডে-কেয়ারে শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তুত করা হয়,
যেমন- লিখতে পড়তে ও অন্যান্য দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করা হয়। এর ফলে স্কুলে
ভর্তির আগেই একটি সুন্দর প্রস্তুতি হয়ে যায়। এই শিশুরা স্কুলে ভর্তি হয়ে
খুব সহজে নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারে।
এত কিছুর পরেও আমাদের
দেশে ডে-কেয়ার নিয়ে অভিভাবকরা এখনও দ্বিধা দ্বন্দে ভোগেন। অবশ্য তাদের এই
আশঙ্কার পেছনে কিছু বাস্তব কারণ রয়েছে। শিশুর শারীরিক নিরাপত্তার বিষয়টি
তারা সবচেয়ে আগে ভাবেন। ডে-কেয়ারের পরিবেশ নিরাপদ কিনা? খাবার পানীয়
জীবাণুমুক্ত কিনা? অন্য শিশুদের দ্বারা আঘাত পায় কিনা? ডে-কেয়ারের কর্মীদের
দ্বারা নির্যাতনের আশংকা আছে কিনা? কণ্যাশিশু হলে যৌন নির্যাতনের আশংকা
ইত্যাদি আরো অনেক শঙ্কা।
আরো কিছু বিষয় অভিভাবকদের মনে কাজ করে।
ডে-কেয়ার কতটা মানসম্পন্ন, ডে-কেয়ারের কর্মীদের শিশু প্রতিপালনের প্রশিক্ষণ
আছে কিনা? বেশিক্ষণ ডে-কেয়ারে রাখলে মা-বাবার সাথে শিশুর বন্ধন শিথিল
হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা? ডে-কেয়ারের পরিবেশ পরিপাটি ও বিজ্ঞানসম্মত কিনা?
ডে-কেয়ারের খরচ কত? ইত্যাদি আরো অনেক প্রশ্ন মা-বাবার মনে ঘুরপাক করে।
প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক। কারণ বাস্তব পরিস্থিতিকে কোনোভাবেই অস্বীকার করার
সুযোগ নেই।
ডে-কেয়ার নিয়ে অভিযোগেরও শেষ নেই। ডে-কেয়ার থেকে শিশু
হারিয়ে যাওয়া, দূর্ঘটনা আহত বা নিহত হওয়া, সারাদিন টেলিভিশনে দেখিয়ে
শিশুদের ব্যস্ত রাখা, প্রহার করে অথবা ধমক দিয়ে শিশুদের শান্ত রাখার
চেষ্টা, নোংরা পরিবেশ ইত্যাদি অভিযোগ আমরা প্রায়শ শুনতে পাই।
আসলে
ডে-কেয়ার পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ বিষয় মেনে চলা হয় না বলেই,
পত্রিকার পাতায় আমরা এ ধরনের দূর্ঘটনার খবর শুনতে পাই। ভাড়া বাসায় কিছু
দারোয়ান আর আয়া-বুয়া নিয়োগ দিয়ে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিলেই ডে-কেয়ার হয়ে যায়
না। কিছু সাধারণ বিষয় আছে, যা সব ডে-কেয়ার সেন্টারের মেনে চলা দরকার।
আমাদের
দেশে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের বিধিমালায় ডে-কেয়ার সেন্টার নিবন্ধনের কিছু
শর্ত আছে। যেমন- শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের আয়তন সর্বনিম্ন তিন হাজার বর্গফুট
হতে হবে। প্রত্যেকটি শিশুর জন্য গড়ে ৫০ বর্গফুট জায়গা থাকতে হবে। ভবনে
লিফট না থাকলে সর্বোচ্চ চতুর্থ তলায়, আর লিফট থাকলে সর্বোচ্চ সপ্তম তলায়
কেন্দ্র স্থাপনা করা যাবে। এগুলো হচ্ছে অবকাঠামোগত শর্ত। এর বাইরেও অনেক
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, যা ডে-কেয়ার স্থাপনের আগে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে
হবে।
প্রতিটি ডে-কেয়ার সেন্টারে রেফারেল সিস্টেম থাকা খুব জরুরি। যেমন-
শিশু অসুস্থ হলে কাছাকাছি কোন হাসপাতাল বা ডাক্তারের কাছে নেওয়া হবে?
যেকোনো আইনগত বিষয় সামনে আসলে কারা তা সামাল দিবে? কোনো শিশুর যদি
কাউন্সেলিং অথবা থেরাপির প্রয়োজন হয়, তখন কার কাছে যাবে ইত্যাদি বিষয়
ডে-কেয়ারের দায়িত্বশীলদের জানতে হয়। মাঝে মাঝে অভিভাবকদেরও কাউন্সেলিং এর
প্রয়োজন হয়।
কর্মীদেরকেও কিছু বিষয় মেনে চলতে হয়। যেমন- শিশুদেরকে শক্ত
করে ধরা যায় না, কোনো শিশুকে বেশিক্ষণ কোলে রাখতে নেই, শিশুদের মধ্যে তুলনা
করে কথা না বলা, জোরে কথা না বলা, পরিশীলিত ভাষায় শিশুদের সম্মোধন করা
ইত্যাদি। কারণ কর্মীদের আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যক্তিত্ব শিশুদের উপর খুব
প্রভাব ফেলে।
ডে-কেয়ারের কর্মীদের মানসিক সুস্থতার বিষয়টিও কম
গুরুত্বপূর্ণ নয়। কর্মীরা যদি পারিবারিক অশান্তিতে থাকেন, শারীরিক
অসুস্থতায় ভোগেন, অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে থাকেন অথবা অন্য কোনো মানসিক
অসুস্থায় ভোগেন, তাদের পক্ষে শিশুদের স্বাভাবিক যত্ন দেওয়া অসম্ভব। এছাড়াও
কর্মীরা যদি মানসিকভাবে সুস্থ না হয়, তাহলে এই ট্রমা তাদের আচরণ, কথা, কাজ
এবং দেহের ভাষার মাধ্যমে শিশুদের মধ্যেও সঞ্চারিত হতে পারে।
ডে-কেয়ার
সেন্টারে শিশু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় পার করবে ব্যাপারটি তা নয়।
খাওয়া, ঘুম, খেলাধুলা, টিভি দেখানোর বাইরেও আরো অনেক কিছু খেয়াল রাখতে হয়।
শিশুর শারীরিক কোনো সমস্যা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে কিনা? মানসিক বিকাশ ঠিকমতো
হচ্ছে কিনা? শিশু বয়স অনুযায়ী কথা বলতে পারছে কিনা? সবার সাথে মিশতে পারছে
কিনা? বোধের বিকাশ হচ্ছে কিনা? ইত্যাদি আরো অনেক কিছু।
এই শঙ্কার
বিষয়গুলো দূর হতে পারে যদি সঠিক নীতিমালা ও মনিটরিং এর ব্যবস্থা থাকে।
বর্তমানে বাংলাদেশে কতটি ডে-কেয়ার সেন্টার আছে, তার প্রকৃত পরিসংখ্যান
সরকারের কাছে আছে কিনা- তা আমাদের জানা নেই। আশংকার ব্যাপারটি এখানেই। ডে
কেয়ার সেন্টার যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তা সমাজের জন্য মঙ্গলজনক। আর
সঠিকভাবে পরিচালিত না হলে, তাতে উপকারের চেয়ে অকল্যাণই বেশি বয়ে আনবে।
এছাড়াও সমাজে যখন কোনো সেবার চাহিদা তৈরি হয়, তখন ব্যাঙের ছাতার মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠে। ডে-
কেয়ার
সেন্টারের বেলাও এই বিষয়টি ঘটবে। এজন্য প্রথম দরকার কড়া মনিটরিং। পাশাপাশি
এই ব্যাপারটিকে একটি সুযোগ হিসেবেও গ্রহণ করতে হবে। যদি সঠিক প্রশিক্ষণের
মাধ্যমে এই সব কেন্দ্র পরিচালনা করা যায়, তা শিশুদের সুন্দর বিকাশের জন্য
সহায়ক হবে।
আশার কথা হচ্ছে, আমাদের দেশে বেসরকারী উদ্যেগে মানসম্পন্ন
দিবাযত্ন কেন্দ্র গড়ে উঠছে। কিন্তু খরচের বিষয়টি বিবেচনা করলে, বেশিরভাগ
মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের আয়ত্তের বাইরে। তাই সরকারী উদ্যেগে যদি,
প্রতিটি এলাকায় দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তা প্রান্তিক জনগোষ্ঠির
জন্য কিছুটা হলেও সহায় হবে।
এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও মনিটরিং
প্রয়োজন। পাশাপাশি যারা ডে-কেয়ার সেন্টার পরিচালনা করছে তাদেরকে নিয়মিত
প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশিক্ষণ ছাড়া কেউ যেন, এ ধরনের কার্যক্রম
পরিচালনা না করতে পারে এদিকেও দৃষ্টি হবে।
লেখক- গবেষক ও “প্যারেন্টিং কলাম” বইয়ের লেখক