জুলাই-আগস্টের বিপ্লবে ঢাকার সাইনবোর্ড এলাকায় পুলিশের ছোড়া ছররাগুলিতে মারাত্মক আহত হয় কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলা মাদ্রাসা ছাত্র মো. ফয়েজ আলম। তার সারা দেহে বিদ্ধ হয় ৪০টি ছররাগুলি। এর মধ্যে একটি ছররাগুলি কেড়ে নেয় তার ডান চোখের দৃষ্টি শক্তি। হতদরিদ্র এতিম ওই মাদ্রাসা ছাত্র এখনও হাসপাতালের বিছানায়। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।
আহত মো. ফয়েজ আলম এর পৈত্রিক নিবাস কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার পারুয়ারা গ্রামে হলেও জন্মের পর থেকেই নানার বাড়ি চান্দিনার হারং গ্রামে বসবাস করে। ১২ বছর আগে তিন মাস বয়সী বোনকে কোলে রেখে মা কুহিনুর আক্তার মারা যাওয়ায় শ্রমিক পিতা জাহাঙ্গীর আলম গাজী অন্যত্র বিয়ে করেন। আর দুই ভাই বোনের ঠিকানা হয় নানা বাড়ি হারং গ্রামে। নানা জীবিত না থাকায় নানীই দুই এতিম ভাই বোনের একমাত্র ভরসা।
আহত ফয়েজ আলম চান্দিনা উপজেলার হারং সিনিয়র আলীম মাদ্রাসায় দাখিল শ্রেণীতে অধ্যয়ণরত। বোন তাহনা হারং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এবার পঞ্চম শ্রেণীতে পরীক্ষা দেয়। দুই মামা ইসমাইল ও ইউনুছ পেশায় রিক্সা চালক। দরিদ্র ওই পরিবারে থেকে শৈশবকালে নানী জোগার করতো তার লেখাপড়ার খরচ। আর কৈশোরে নিজেই একটি মসজিদে মোয়াজ্জেম এর কাজ করে নিজের ও বোনের লেখাপড়ার খরচ জোগার করতে হতো আহত ফয়েজকে।
জুলাই বিপ্লবে দূরসম্পর্কের এক মামার বাসা সানারপাড় এলাকায় থেকে রাজধানীতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যুক্ত হয় মাদ্রাসা ছাত্র ফয়েজ আলম। ১৮ জুলাই রাজধানীর সাইনবোর্ড এলাকায় আন্দোলনকালে পুলিশের ছোড়া ছররাগুলিতে মারাত্মক আহত হয় এই ছাত্র। ওই গুলিতে আহত হয়েই পাল্টে যায় তার জীবন ধারার গতিপথ। বছরের শেষ দিকে সহপাঠিরা যখন পরীক্ষার হলে, আর সেই সময়ে হাসপাতালের বিছানায় অপেক্ষার প্রহর গুনে নিরবে চোখের পানি ঝড়াচ্ছে।
আহত ফয়েজ আলম জানায় সেই দিনের লোমহর্ষক ঘটনা। ১৮ জুলাই যখন অন্যান্য ছাত্রদের সাথে সেও সাইনবোর্ড এলাকায় যায় হঠাৎ বৃষ্টির মতো ছররাগুলি ছুড়তে থাকে পুলিশ। এক পর্যায়ে মারাত্মক ভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। সাথে থাকা অন্য আন্দোলনকারীরা তাকে উদ্ধার করে সাইনবোর্ডের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করায়। ওই হাসপাতালে ছাত্রলীগের ক্যাডারদের তোপের মুখে চিকিৎসা নিতে পারেনি ফয়েজ আলমসহ অন্য আহতরা। অবশেষে দূর সম্পর্কের মামার সানারপাড়ের বাসায় টানা ১৮দিন চিকিৎসা নেয়। ওই সময়টায় জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দিন পাড় করে ফয়েজ। ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ৭ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয় সে। সেখানে চলে তার উন্নত চিকিৎসা। সব চিকিৎসার পর বাঁধ সাধে ডান চোখ। ওই চোখের চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় রাজধানীর জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে। ওই হাসপাতালের ১নং বেডে চিকিৎসাধীন ফয়েজ।
আহত ফয়েজ আলম জানায়, টানা ১৮ দিন বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়ে আমার প্রায় দুই লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে এক খালা থেকেই নিয়েছি ১ লক্ষ টাকা। বাকি টাকাগুলো বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে ধার দেনা করে চিকিৎসা খরচ করেছি। জুলাই বিপ্লব ফাউন্ডেশন থেকে ৫০ হাজার টাকা পাই। ওই টাকায় ৫০ হাজার টাকা ঋণ মুক্ত হয়েছি। এখন সব চিকিৎসা খরচ সরকার থেকে করে থাকলেও প্রথম দিকের চিকিৎসায় ঋণ আছি আরও দেড় লক্ষ টাকা। এদিকে আমার পরিবারে কেউ নেই বললেই চলে। আমার এই ঋণ শোধ করবো কিভাবে কিছুই বুঝতেছিনা। আমার চোখের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক।
এদিকে, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের এর কর্ণিয়া বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল কাদের সহ চার সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড প্রতিবেদনে দেখা যায়, আহত ফয়েজ আলম এর চোখের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানো যেতে পারে।