বুধবার ২৫ জুন ২০২৫
১১ আষাঢ় ১৪৩২
রবিবাসরীয়..
প্রকাশ: রোববার, ৭ জানুয়ারি, ২০২৪, ১২:৫৫ এএম |

রবিবাসরীয়..








সাধন-ভজনের মহাগুরু- মনমোহন দত্ত

শাহীন শাহ্  ।।

মহর্ষি মনমোহন দত্ত আমাদের এই মৃত্তিকার মহান সন্তান। ১৮৭৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরের সাত মোড়া গ্রামে এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রকৃতির স্বভাবজাত নিয়মে মানুষের প্রিয় আয়ূষ্কাল সীমিত হওয়ার কারণে মহর্ষি মনমোহন দত্ত ও তার ব্যতিক্রম নন। আপন ভুবনে চিরকালের বাসিন্দা হওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা নেই বিধায় এখন চলছে মহর্ষি মনমোহন দত্তের বিগত জীবন। আমাদের চোখের পাতায় ও হৃদয়ে গভীর থেকে গভীরে তিনি জীবন্ত ইতিহাস ও পথিককৃত হয়ে আছেন এবং থাকবেন  ভাবিকাল পর্যন্ত। তাঁর সৃষ্ট অমর কীর্তির কল্যাণে তিনি সর্বহৃদয়ে বর্তমান এবং প্রাসঙ্গিক। মহর্ষি মনমোহন দত্তের সৃষ্ট কর্মের বিশেষ দিক হচ্ছে, ধর্মের কীর্তন এঁড়িয়ে গিয়ে মানবের কীর্তনে রচিত গান, কবিতা ও মর্মবাণী দিয়ে পৌঁছাতে পেরেছিলেন মানব থেকে মানবের হৃদয়ে এক অনন্য উজ্জ্বল প্রভায়। তিনি শাস্ত্রীয় রীতিও নীতির বাহিরে গিয়ে সাধন-ভজনের মহাগুরু ছিলেন। যা মানব কল্যাণের পথে পথে সৃষ্টি করেছে এক নতুন ধারা। যে ধারায় মনের মুক্তির দ্বার খুলে যায়। মনমোহন দত্ত কেবল হিন্দু সম্প্রদায়ের নয়, তিনি হিন্দু- মুসলমান ও সর্বধর্মের অনুসারীদের নিকট কালে কালে আলোচনার বিষয়-বস্তুর কেন্দ্রে আলোকিত হয়ে আছেন। তাদের আবেগের ও মননশীলতার আত্মউন্নয়ের জায়গাটায় একজন দীক্ষা গুরুর মর্যাদায় নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছেন সৃষ্ট কর্মের কল্যাণে। মহর্ষি মনমোহন দত্তের লেখায়-রচনায়ও গানে প্রমাণিত সত্য যে, তিনি ছিলেন অপেক্ষকৃত আধুনিক যুগের মানুষ। তিনি বিশ^াস করতেন ও ভক্তবৃন্দের হৃদয়ে সঞ্চালন করতেন, একটি কথা সেটি হচ্ছে-জীবনের স্বার্থকথা অর্থ-উপার্জনে নয়, খ্যাতি প্রতিপত্তিতে নয়, লোকের মুখে সাধুবাদে নয়, এমনকি ভোগেও নয়। সে স্বার্থকথা শুধু জীবনকে গভীরভাবে উপলব্দি করার ভেতর। এই মহত্তোম ভাবনার কারণে মনমোহন দত্ত মানুষের হৃদয়ে মহর্ষি হয়ে আছেন। মহর্ষি মহমোহন দত্ত ¯্রষ্টার প্রেরিত কোনো অতিমানব ছিলেন না  আত্মজীবনীমূলক লীলারহস্য বইয়ে তার নিজের বোধ ও বিবেকের সাথে সংগ্রামের এক নিগুঢ় তত্ত্বের বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি যে মানুষ ছিলেন, আট-দশজন মানুষের মতো রিপুর তাড়না ছিল তা তিনি অকপটে স্বীকার করে লিখেছেন-‘‘ইতিমধ্যে কাম-ক্রোধ বৃত্তি ও নিতান্ত প্রবলভাব ধারণ করিয়া দুষ্কার্য্য করাইবার প্রয়াস পাইতে লাগিল এবং কিছু কিছু আপনা আপনি দু’একটা ঘটনা ঘটিয়া যাইবার উপক্রম হইল। মনকে শক্ত করিয়া বাঁধিলাম, বাঁধ মানে না, জ্ঞানে বুঝাইলাম, বুঝ মানে না, ক্রোধের কারণ আসিয়া প্রতিহিংসা বিষে জ¦ালাইতে লাগিল। ক্রমে মোহ, লোভ, মদ মাৎসর্য, ঘৃণা, লজ্জা, হিংসা সকলেই প্রবলভাবে আবরিয়া ধরিতে লাগিল, ঠিক যেন কি আত্মহারা, মাঝে মাঝে জ্ঞানহারা, বুদ্ধিহারা-শুদ্ধিহারা, শক্তি হারা, শক্তি হারার ন্যায় শূন্য মনে শূন্য লইয়া বিষয়ের বিষবৎ জ¦ালায় অধীর হইতে লাগিলাম। কখন যেন একটু একটু করে শান্তির ক্ষীণ চন্দ্রালোকের ন্যায় আসিয়া উঁকি - ঝুঁকি দিয়া যেন প্রাণটা রক্ষা করিয়া
যাইতো।’’ এই যে মনমোহন সাধুর নিজেকে শুদ্ধ রাখার চেষ্টা সবশেষে শুদ্ধতম ও নিষ্কাম মানুষে পরিণত করতে পারা এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মানুষের কাছে আশা ও আস্থার জায়গা হিসেবে পরিগণিত হবেন বলে বিশ^াস করি। মানুষকে শুদ্ধতম মানুষ পরিণত করতে মহর্ষি মনমোহন দত্তের সৃষ্ট কর্মগুলোর কল্যাণে তিনি সর্বজনের নিকট সার্বজনীন হয়ে আছেন। মহর্ষি মনমোহন দত্ত ছিলেন একজন মরমি সাধক, কবি ও দার্শনিক। তিনি বাংলার লোকায়ত ধর্ম-দর্শন চর্চায় একজন ক্ষণজন্মা লোক সাধক। মাত্র ৩১ বছর ছয় মাস জীবন সীমার মধ্যে রেখে গেছেন মানব মুক্তির মর্মবাণী। তিনি লিখেছেন-
‘‘সত্য যে সকলের জন্যই সত্য
এবং সত্য এক ইহাতে কোনো ভেদাভেদ নেই।’’
এই যে সত্যের মূল্যায়ন তাহা সকল ধর্মের মর্মবাণী হিসেবে পাথেয় হয়ে থাকবে অনন্ত সময়। সব সম্প্রদায়ের মানুষকে তিনি এক করে পেতে চেয়েছিলেন। প্রত্যেকের সাথে মৈত্রীর সাধনা লক্ষ্য করা গেছে তাঁর জীবনপাঠে। তাঁর ভালোবাসা থেকে কোনো ইতর প্রাণী ও বঞ্চিত হয়নি। উপলব্দির বিষয় ছিল- ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা শুধু মানুষকে ঘিরে। ধর্মকে ঘিরে নয়। এই বিশেষ উপলব্দি মনমোহন সাধুকে প্র্যাত্যহিকতার উর্দ্ধে স্থাপন করেছিল। সে উপলব্দি হচ্ছে- মানবকল্যাণে নিজেকে সঁপে দেওয়া। রূপসাগরে ডুব দিয়ে অরুপকে উপলব্দির চেষ্টা জীবনের অন্যতম মূল দর্শন ছিল। এই উপলব্ধির অন্যতম মাধ্যম ছিল সংগীত। বাংলাভাষা-ভাষীর জন্য অনন্য কীর্তি মলয়া সংগীত তাঁকে নিয়ে গেছে ঋষিতে-কবিতে ও সংগীতের যাদুকরে। মলয়া সংগীতের মূল সুর হলো ¯্রষ্টার প্রতি প্রেম ও পরমাত্মার সঙ্গে মিলনের তীব্র আকাক্সক্ষা। সংসারের ভোগ-বিলাসের মধ্যে থেকেও ভোগ-বিলাসের কামনা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে কঠিন সাধনায়-তিনি আমৃত্যু ব্রতী ছিলেন। সংগীতেই ছিলো মনমোহন সাধুর জীবনের শ্রেষ্ঠ বিনোদন। অপরূপকে তিনি ধরতে চেয়েছিলেন সংগীতের মাধ্যমে। তিনি পীর-সন্নাসী-কিংবা দরবেশী জীবন কামনা করেন নি। সংগীতের ভিতর দিয়ে কামনা-বাসনা পূরণ করতে চেয়েছিলেন। মনমোহন দীর্ঘায়ূ লাভ করেন নি বিধায় পরিণত বয়সের পরিপূর্ণ জীবন থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন। শৈশবে পিতা পদ্মনাথ দত্তের নিরহংকার, সহজ-সরল জীবনাচরণ পুত্র মনমোহনের জীবনের ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছিলো। পরবর্তীতে তাঁর যাপনে-সৃজনে-মননে দারুণভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। শৈশবে ছাত্র বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও দরিদ্রতার নীলবিষে জর্জরিত হয়ে তিনি প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পাননি। আনন্দের বিষয় হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ সম্ভব না হলেও তিনি অর্জন করেছিলেন আধ্যাতিক বিদ্যা। মনমোহন দত্তের আধ্যাত্মজীবন, সাধন-ভজন ও সৃষ্ট কর্মের মূলে যার অবদান তিনি গুরু মহারাজ আনন্দ চন্দ্র স্বামীর কল্যাণে। মাত্র ঊনিশ বৎসর বয়সে ১৮৯৬ সালে ব্রাহ্মজ্ঞানের প্রথম কবিতা লিখে ফেললেন। কবিতাটির চরণ:-
‘‘নাথ:- তোমা বিনে এ ভব ভুবনে
যত কিছু কিছু নয়
তুমি মূলধারার সর্ব্ব সারৎসার
তুমি হে ব্রহ্ম-ময়।’’
মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে ব্রাহ্মজ্ঞান ও জ্যোতিদর্শন লাভ করেন বলেই তাঁর জীবনে অগ্রজ লালন সাঁইজির স্বভাব, অনুজ হাছন রাজা ও সমকালীন কবি গুরু রবিন্দ্রনাথের প্রভাব স্পষ্টত লক্ষ্য করা যায়।
হাসন রাজারভাবে দেখি-
‘‘অন্তরে বাহিরে দেখি কেবল দয়াময়’’
লালনের মগ্নতায় ভেসে উঠে-
‘‘পারে লইয়া যাও
ওহে দয়াময় ’’
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে দেখি-
‘‘হে দয়াময়
কোথা হে দেখা দাও।’’
এই মহীরুহদের সৃষ্টিতত্ত্বের ভাবনায় মনমোহন সাধু একই রূপে দৃশ্যমান। মনমোহন সাধুসহ এরা সবাই একেশ^রবাদের বিশ^াসে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। মনমোহন সাধু অকপটে স্বীকার করে বলেছেন ‘‘আমি না হিন্দু, না মুসলমান, না-খ্রীষ্টান, না-ইহুদী এবং না-বৌদ্ধ। আমি সর্বধর্মের, আমি সর্বজনের।’’ উপলব্দিতে জাগে সকল শক্তিই ¯্রষ্টার। পূর্ণ অথবা আংশিক শক্তি কোনো ব্যক্তির অস্তিত্বে নেই। ¯্রষ্টা পূর্ণ ও নিরাকার। তিনিই দয়াময়। মানব জমিনে যতকিছু সৃষ্ট হচ্ছে ধর্মকে কেন্দ্র করে। মনমোহন দত্ত বলেন- ‘ধর্ম হচ্ছে স্বভাব।’ স্বভাবকে সংযত করার নামই হচ্ছে সাধনা। মনমোহন সাধু স্বভাবকে ধারণ করতে পেরেছিলেন বলে তিনি মানুষের অন্তরে মহর্ষি ও সাধু হিসেবে জাগরুক হয়ে আছেন এবং থাকবেন অনন্ত সময় পর্যন্ত। মনমোহনের স্বভাবে, মনোভাবে, সাধনায় দৃশ্যমান যেটি, সেটি হচ্ছে প্রভুর সান্নিধ্য লাভের কামনা। তিনি বলেন- ‘চাই না বেহেস্ত, চাই না দোজখ, আমি চাই শুধু তোমারে?’
প্রভুর প্রেমে কতটা আকুতি থাকলে, কতটা বিশ^াস থাকলে জীবন সমুদ্রের দুটি কাল-ইহকাল-পরকাল কেবল প্রভুর সান্নিধ্যের একাগ্রচিত্ত্বের বাসনা মনমোহনকে নিয়েগেছে অসীম থেকে আরও গভীরতর দিকে। মনমেহান দত্ত যেহেতু মানুষ। ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার জায়গা থেকে তিনি মোক্তারী পড়ে আইনজীবী হতে চেয়েছিলেন। বিভিন্ন কারণে তা হয়ে উঠেনি। চাকুরির খোঁজে হন্য হয়ে ঘুরেছিলেন। না তাও জোটেনি। এই না হতে পারা মনমোহনকে আমরা যে দর্শনে যে অসীম সৃজনের মহাত্মা হিসেবে পেয়েছি তা অনন্য ও অসাধারণ। যদি তিনি আইনজীবী কিংবা চাকুরিজীবী হয়ে যেতেন। তাহলে হয়তো মনমোহন সাধুকে আমরা এভাবে পেতাম না। জীবনের বাঁক পরিবর্তনই তাঁকে মহর্ষি মনমোহন দত্তে পরিণত করেছে। মনমোহন দত্তের যত সৃষ্ট কর্ম আছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মলয়া সংগীত। তখনকার সময় ভারতবর্ষে অমরকীর্তি মলয়া গানের সুরের মূর্ছনা ও ঝংকার মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে সঞ্চালিত তথা বহমান ছিল। এই ধারা এখনও বর্তমান। বিশেষ করে মহর্ষি মনমোহন দত্তের এবং ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁ সাহেবের সুরে যে গান এপার বাংলা ওপার বাংলার সংগীতপিয়াসীসহ সর্বস্তরের মানুষকে গভীরভাবে সিক্ত করেছে তা মলয়া সংগীতের কল্যাণে। আধ্যাত্মিকতার মিশ্রণে সম্প্রীতি ও মানবতার এক অনন্য সৃষ্টি হিসেবে মলয়া সংগীত আজও সমভাবে সমাদৃত। মলয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায় বসন্তের দখিনা বাতাস, স্বর্গীয় উদ্যান, নন্দন কানন ইত্যাদি ইত্যাদি। মলয়া শব্দটির উদ্ভব ও প্রচলন যা রামায়ণ ও মহাভারতে বিধৃত হয়েছে। মহর্ষি মনমোহন দত্ত প্রদত্ত মলয়া শব্দটিতে রয়েছে ভিন্নভাব, ধারা, শক্তি, ধ্যান, তপস্যা, সুর, ছন্দ, আধ্যাত্মিকতা, সাম্য, সম্প্রীতি ও মানবতার সম্মিলিত একটি সরোবর। প্রকৃত অর্থে মলয়া সংগীতের মূলভাব হচ্ছে-আধ্যাত্মিকতা, মানবতা, সাম্য, সম্প্রীতি ও সর্বধর্ম সমন্বয়ে সুরের এক অমিয় ঝর্ণাধারা।
মলয়া গানের নামকরণ নিয়ে কথিত আছে মনমোহনের ‘‘ম’’ লব পালের ‘‘ল’’ এবং আফতাব উদ্দিনের ‘‘আ’’ এই তিন আদ্যাক্ষরের মিলনে মলয়া।
এই ধারণাটি- অনুসারী-কিংবা ¯েœাতাদের বিশ^াসের জায়গাটায় ঠাঁই করে নিয়েছে দারুণভাবে। প্রশ্ন হচ্ছে আত্মজগতের ভাবনা কি তিনজনে একত্রে শেয়ার করা যায়? না, তা সম্ভব নয়। গান রচনা তো বিশাল ব্যপার, এমনকি একটি ছোট্ট কবিতা ও তো একত্রে লেখা জটিল কাজ। জানা যায় মনমোহনের শিষ্য লব চন্দ্র পাল বা ফকির আফতাব উদ্দিন তাদের জীবিতকালে মলয়াগানে অংশীদারীত্বের দাবি করেন নি। মলয়া সংগীতেরসংখ্যা এক হাজারের অধিক। এই গান গেয়ে যারা সুনাম কুঁড়িয়েছেন তারা হচ্ছেন- কণ্ঠশিল্পী মনু’দে, সাবিনা ইয়াছমিন, ফরিদা পারবিন, ফেরদৌস আরা এবং সুবীর নন্দী। রেডিও-টেলিভিশনে এদের গাওয়া মলয়া গানে বিশাল এক জনগোষ্ঠি ভক্ত হয়ে আছেন। মলয়া গানের কিছু চরণ না উল্লেখ করলে লেখাটির সীমাবদ্ধতা সম্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হবে:-
বুঝে বুঝলি না তুই মনরে কানা
বাজে খরচ করে কেবল হারাইলি ষোল আনা’’
আমিকি তোমার ভজন জানি
অভজনে আছ কিনা, ভেবে মরি দিন রজনী
ভালোবাসি বলি রে শ্যাম এত দাগা সয়ে থাকি
পাখি নৈলে কি আর সইত এত ভাঙতো খাঁচা উড়ত পাখি
জীবে শিবে কত প্রেম জানাব তাই কেমনে
অভেদ প্রভেদহীন বেদ বিধি পুরাণে
দয়াময় নাম মহামন্ত্র গুরু দিলেন আমার কানে
যেন কত শান্তি সুধারশি বিতরিল তপ্ত প্রাণে।

উল্লেখিত গানের প্রতিটি চরণ দেখে চোখ বুঝে যায় বিষ্ময়কর ঘোরে। প্রভু, আত্মা এবং মিলনের তীব্র কামনা বৃষ্টির ধারার মতো করে ঝরে পড়ছে মানব জমিনে, মানব হৃদয়ে। পরাণ জুড়ে ¯্রষ্টার প্রতি অসীম প্রেমই মলয়ার মূর্ত প্রকাশ। মহর্ষি মনমোহন সাধুর অমরকীর্তি ‘মলয়া’ সংগীতকে গুণিজনেরা বিশ্লেষণ করেছেন, চিহ্নিত করেছেন এইভাবে- ‘‘গানের সকল বীর্য শক্তিকে যে ধারণ করিয়া রাখে সে-ই মলয়া’’। মূলত মলয়া সংগীতের প্রতিটি বাণীতে মহর্ষি মনমোহন দত্ত প্রকাশ করেছেন সর্বধর্ম, মানবতা, সাম্য ও সম্প্রীতির প্রায় সকল উপকরণের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন সুনিপুণ ও সাবলীলভাবে। সবচেয়ে সফলতার জায়গাটা হচ্ছে- তিনি দরিদ্র থেকে উচ্চবিত্ত, নিরক্ষর থেকে উচ্চশিক্ষিত, সাধারণ থেকে অতি সম্মানীয় সর্বস্তরের মানুষের কাছে ‘মলয়া’ সংগীতে কে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন দৃষ্টিনন্দন শৈলীতে ও হৃদয় বিহবিলত আবেগকে। মলয়া সংগীতের মধ্যে অর্ন্তগত বিষয়গুলো হচ্ছে- শ্যামা সংগীত, ভাবসংগীত, ইসলামী সংগীত ও আধ্যাত্মিক সংগীতসহ নানা ধরনের বৈচিত্রময় গান। যে সংগীত শুনলে চিত্ত আঁদ্র হয়ে যায়, মানব হৃদয় নরম হয়ে যায়, তা-ই মলয়া সংগীত।
মলয়া সংগীত রচনার ক্ষেত্রে যার ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনি হচ্ছেন মহারাজ আনন্দ স্বামী। মনমোহন সাধু যখন মহারাজ আনন্দ স্বামীর সান্নিধ্যে যান। মহারাজ আনন্দ স্বামী বলেছিলেন, তুমি কি চাও? জবাবে বলেন ‘নিষ্কাম ধর্ম’। অর্থাৎ ধর্মের পথ ক্ষুরধারের ন্যায় শাণিত। স্বামীজী আনন্দ চন্দ্র মনমোহন কে বলেন, আজ থেকে তোমার মনে যে সব কথা জাগরিত হবে, তা তুমি লিখে রেখো। স্বামীজীর নির্দেশনা মন্ত্রের মতো কাজ হয়ে যায়।  
মহর্ষি মনমোহন দত্তের লেখার যাত্রা-প্রথমে কবিতা, সবশেষে মলয়া সংগীত। তিনি ¯্রােতা-ভক্তকূলকে দেখিয়েছিলেন আলোর পথ ও সর্বধর্ম সমন্বয়ের পথ। মনমোহন দত্তের রচিত মলয়া গানের সুর দিয়েছিলেন ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁ এবং তাল দিয়েছিলেন বিখ্যাত প-িত লব চন্দ্র পাল। উভয়ে মনমোহন সাধুর প্রিয় শিষ্য ছিলেন। ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁ ছিলেন সুর স¤্রাট আলা উদ্দিন খাঁ’র বড় ভাই। আফতাব উদ্দীন খাঁ’র সুললিত মধুর কণ্ঠে সারা বাংলা তথা ভারত বর্ষের বাংলা ভাষীদের কাছে ঘুরে ঘুরে গেয়ে গেয়ে মানুষের কাছে মলয়া সংগীতকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যান সে সময়ে। গর্বের বিষয় হচ্ছে ফকির আফতাব উদ্দীন খাঁ কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কলকাতার জোড়া সাঁকোতে গিয়ে মলয়া সংগীত শুনিয়ে মুগ্ধ করেছিলেন। গান শুনে কবিগুরু বলেন, ‘‘এ-কার গান?’’ উত্তরে ফকির আফতাব উদ্দীন খাঁ বলেন, ‘‘গানের রচয়িতা মহর্ষি মনমোহন দত্ত।’’ কবি গুরু বলেন ‘কবি লেখেন কল্পনা থেকে, আর সাধক লেখেন অনুভূতি থেকে’। ফকির আফতাব উদ্দীনের গান শুনে কবি গুরু আরও বলেন, ‘এই গান রচয়িতা আত্মাকে জানিয়াছে’।
গানটির প্রথম কলিÑ ‘মন মাঝে যেন কার ডাক শুনা যায়’।
মলয়া যেমন শ্রুতিমধুর ও সুললিত কণ্ঠের মরমী গাওয়া এক ঐতিহ্যবাহী অপরূপ শিল্প। তেমনি কিছু কিছু গান ব্যতিক্রম ও জটিলভাবে সৃজন করা যা ¯্রােতাদের শুনলে মন টানে না। এইসব গানে এমন রাগের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন যে, রাগগুলো খুব প্রচলিত নয় এবং ¯্রােতারা ও শুনতে অভ্যস্ত নয়। যেমন- বারোয়া, প্রসাদী, মনোহর, সাই, আলেয়া, সিন্ধু ইত্যাদি ইত্যাদি। এক সময় দুই বাংলাতেই বেশ জনপ্রিয় ছিল মলয়া সংগীত। বিশেষভাবে লক্ষণীয় ষাট, সত্তর ও আশির দশকে বেতার থেকে নিয়মিত মলয়া সংগীত প্রচারিত হতো। মহর্ষি মনমোহন দত্ত সাত মোড়াতে জন্মলাভ করলেও প্রকৃতপক্ষে ভূমিষ্ঠ হলেন ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার সরাইলের কালিকচ্ছে মহারাজ স্বামী আনন্দ চন্দ্রের গুরু গৃহে। মহারাজের সান্নিধ্য প্রাপ্তির পূর্বে মনমোহন দত্ত একজন সাধারণের চেয়েও সাধারণ ছিলেন।
মনমোহন দত্তের আত্মজীবনী বর্ণনায় পাওয়া যায় তাঁর প্রতিভাদীপ্ত মনছিল। সেই মনের উপযোগ সৃষ্টির প্রয়োজনীয় রসদ ছিল না। সেই রসদ লাভ করলেন কালিকচ্ছে স্বামীজীর আর্শীবাদ ও কল্যাণে। সৃজনশীল জগতে যারা লব্দ প্রতিষ্ঠা পেয়ে অমরত্ব লাভ করেছেন, তাদের বেশির ভাগই কোনো না কোনো অগ্রজ সাধকের প্রেরণায় সৃষ্টি ধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন। মনমোহন দত্ত এই ধারার ব্যতিক্রম নন। মহর্ষি মনমোহন দত্তের লেখা আত্মজীবনী বই ‘লীলা রহস্য’ বইটির মূলভাব বিশ্লেষণ করলে একটা সত্য বেড়িয়ে আসবে। সেটি হচ্ছে তিনি যথার্থ চেয়েছিলেন হিংসা বিদ্বেষহীন এক পৃথিবী। যেখানে জাতি হিসেবে আমাদের একটাই পরিচয় থাকবে আমরা মানবজাতি এবং সব ধর্মাবলম্ভীরা এই জাতির বিশেষ ও অবিভাজ্য অংশ। মনমোহন দত্তের সমস্ত সৃষ্টি কর্মের বিচার বিশ্লেষণ করলে একটি পরিমিত সত্য ফুঁটে উঠে, তাঁর মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ ও অনুরাগের কোনও প্রকারের ঘাটতি দৃশ্যমান হয়নি। দুঃখ সংবরণ করে বলতে হয় যে, তাঁকে একজন মরমী দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ¯্রষ্টা হিসেবে দেখার, কিংবা বিচার করার মনোভাব আজও গড়ে ওঠেনি। মহর্ষি মনমোহন দত্ত একজন মহান সাধক, চিন্তা-ভাবনায় অগ্রসর এবং আলোকিত মানুষ। প্রাসঙ্গিকভাবে তিনি শ্রদ্ধা এবং অনুরাগ দাবি করার মহত্তোম যোগ্য। কিন্তু আমাদের শিক্ষা কাঠামোর পরিম-লে মনমোহনের এই মহত্ত্ব এবং উচ্চতা কি যথার্থভাবে মূল্যায়ণ করা হয়? না তা আজও পরিলক্ষিত হয়নি। কিংবা সাহিত্যেও অন্যান্য শ্রেষ্ঠ কীর্তিমাণ মানুষের সৃষ্টকর্মের পাশাপাশি আমরা কী মনমোহনের সৃষ্ট কর্মের তুলনা করে থাকি? না, তাঁকে বুঝে, জুজে, খুঁজে, মিলিয়ে দেখবার উদ্যোগ কেউ নেয় নি। বাঙালির মানসপটে এইটা চরম হতাশার। অন্তত আমাদের উত্তর প্রজন্মেও মানুষের কথা ভেবে তাদের আত্মউন্নয়নে মনমোহন পাঠ জরুরি এবং আবশ্যকীয় একটি দায়িত্ব।
লেখক: অধ্যাপক, কলাম লেখক ও প্রাবন্ধিক



ভোট দিতে চাই


ডাঃ মল্লিকা বিশ্বাস ।।

আমার ভোটাধিকার আছে বলেই
নির্বাচন এলেই নিজেকে
অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে মনে হয়।
 গ্রাম -গঞ্জ, শহরের রাস্তা, অলি-গলি
বহুবর্ণ প্রজাপতির মতো পোস্টার,
ব্যানার, ফেস্টুনে সজ্জিত হয়।
শহর বন্দরের ল্যাম্পপোস্ট গুলিও
বহু বিচিত্র রঙ্গের স্বপ্নের কামিজ পরে
দিব্যি সহাস্য বদনে দাঁড়িয়ে থাকে।
ভোটে দাঁড়ানো প্রার্থীরা বিলিয়ে দেন
রঙ্গিন পুস্তিকা, ম্যানিফেস্টো-
সেসব আমি উড়িয়ে দেই নীলিমায়
যদি ওরা বৃষ্টি হয়ে মাটিতে, নদীতে, সাগরে
মিশে গিয়ে সত্যি হয়ে যায়।

আমার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতেই হবে
তাই আমি ভোট কেন্দ্রে যাবো।
উৎসবমুখর পরিবেশে বর্ণিল কাপড়-ঘেরা বুথে
খুব ঝুঁকে ব্যালট পেপারে
অনেক ভেবেচিন্তে  ভালোবেসে আমি
জাতীয়তাবাদ,সমাজতন্ত্র,
গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতাকেই ভোট দেবো।












সর্বশেষ সংবাদ
কুমিল্লায় এ বছর এইচএসসিতে ঝরে গেছে ২৫ হাজার শিক্ষার্থী
কুমিল্লায় ট্রাক চাপায় মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু, স্ত্রী হাসপাতালে
দাউদকান্দিতে ডেঙ্গুতে আরো একজনের মৃত্যু
কুমিল্লা সদর দক্ষিণে আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেফতার
জহির মোল্লা হত্যা মামলার ৪ আসামি কারাগারে
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
১৫ আগস্ট পর্যন্ত সব কোচিং সেন্টার বন্ধ
সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম নিয়ে ৮০ শতাংশ ‘সন্তুষ্ট নয়’
কুমিল্লায় বোগদাদ পরিবহনের বাস কাউন্টারে হামলা॥ আহত ১
লালমাইয়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা গ্রেফতার
৫ মাসেই কোরআনে হাফেজ ৮ বছরের সাইদুল!
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২