শিক্ষকদের একটা ফেসবুক গ্রুপে দেখলাম একজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পোস্ট দিয়েছেন, শিক্ষকতার পাশাপাশি কিছু একটা করতে চান! কয়েক হাজার মন্তব্য পড়েছে সেখানে। পড়ার চেষ্টা করলাম। কেউ কেউ তাকে গালিগালাজও করেছেন। তিনি সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন বেতনে তার সংসার চলছে না।
অনেকেই তাকে চাকরির পাশাপাশি কী করা যায় পরামর্শ দিয়েছেন। নিজেরা শিক্ষকতার পাশাপাশি কে কী করেন, তা লিখেছেন। কেউ বিকাশের দোকান, কেউ ওষুধের দোকান, কেউ কাপড়ের দোকান, কেউ বা মুদি দোকান দিয়েছেন। আর কিছু লোক টিউশনির কথাও উল্লেখ করেছেন। এটিই এখন বাংলাদেশের শিক্ষকদের বাস্তব চিত্র।
অথচ একটা ভালো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমেই রাষ্ট্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে থাকে। এক-দেড় বছরের একটা গাঠনিক প্রশিক্ষণও দেয়। কিন্তু পরিবার-পরিজন নিয়ে সামাজিকভাবে সুন্দর মতো চলতে পারে, এমন বেতন রাষ্ট্র তাকে দিতে পারেনি। তাদের কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার ভার রাষ্ট্র নিতে পারেনি। তার কাছ থেকে রাষ্ট্রও তার পাওনা বুঝে নিতে পারেনি।
নানান ধরনের কাজ প্রাথমিক শিক্ষকদের দিয়ে রাষ্ট্র করিয়ে নেয়। কার শিশুর টিকা খাওয়া হয়েছে, কে কবে ভোটার হয়েছে, কার বাড়ির টয়লেট কয়টি, কয়জন লোক টয়লেট ব্যবহার করেন- এমন যত নন-প্রোডাক্টিভ কাজ আছে সব করেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা হচ্ছেন সমাজ পরিবর্তনের ‘মূল শক্তি’। তাদের দিয়ে গোটা সমাজটাকে বদলে দেওয়া সম্ভব। অথচ আজও পঞ্চম শ্রেণি পাস করে একটা শিশু ট্রাফিক সিস্টেম জানে না, সমাজকে কীভাবে পরিচ্ছন্ন রাখতে হয় বুঝে না, এমনকি টয়লেট থেকে বের হওয়ার পর হাত পরিষ্কার করতে হয়- তাও পরিপূর্ণভাবে শিখতে পারছে না!
আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলি- কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে আনতে রাষ্ট্র যত টাকা ব্যয় করে, তার এক-তৃতীয়াংশ টাকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেছনে সঠিকভাবে ব্যয় করলে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। মনে রাখতে হবে লাঠি দিয়ে কখনও কাউকে ‘মানুষ’ বানানো যায় না।
মেধার এমন অপচয় দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা অংশের কর্মসংস্থান হয়েছে ঢাকার সাতটি কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের অধীনে যাওয়াতে। উক্ত সাত কলেজকে ঢাবির অধীনে নিয়ে শিক্ষার মানের ন্যূনতম কোনও উন্নতি হয়েছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়নি। তবে সে বিষয়ে গবেষণা করে দেখা যেতে পারে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ভীষণ ভোগান্তি হয়েছে। তবে ঢাবির শিক্ষক এবং উক্ত সাত কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক অশ্রদ্ধা তৈরি হয়েছে সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারি। ঢাকার বড় সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার সাত বছর পর এবার নয়টি সরকারি কলেজকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার পদক্ষেপ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করেন সরকারি কলেজের শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা। চাকরিতে প্রবেশের প্রথম দিকে ব্যাপক ডেডিকেশন দেখা যায়। চাকরির দুই বছরের মধ্যে তাদের অধিকাংশই অধ্যক্ষের রুমের চারপাশে ঘুরঘুর শুরু করেন। কারণ বুদ্ধিবৃত্তিক কোনও কাজই তার নেই।
বিভিন্ন দেশের লেখাপড়া পদ্ধতি নিয়ে আমার পড়াশোনা আছে, প্রচুর আগ্রহও আছে। তাই যখন যে দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে, সেখানেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিজিট করেছি। এ নিয়ে আমার সহকর্মীদের কেউ কেউ আমাকে বলেন- তুমি বিভিন্ন দেশে গিয়ে তোমার মাথায় শুধু সেটাই ঘুরে!
তাঁদের উদ্দেশে একটা তথ্য দিতে চাই-
হয়তো বছরখানেক আগে আমার খুব কাছের এক ছোট ভাই একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন। প্রায় দুই লাখ টাকা বেতন, সঙ্গে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। তাকে দেখি সারাক্ষণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে ব্যস্ত। অ্যাসাইনমেন্ট, টার্মপেপার, থিসিস নিয়ে আলোচনা। প্রচুর গবেষণা করেন। সপ্তাহে একদিন স্টুডেন্ট কনসালটেন্সি। টেবুলেশন শিট তৈরি বা রেজাল্ট শিট ফরমেট করে যেন তার মূল্যবান সময় নষ্ট না হয় সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাহায্য করতে দিয়েছে একজন টিচিং অ্যাসিসট্যান্ট। এটাই হচ্ছে মেধার যথাযথ প্রয়োগ। স্টুডেন্ট কনসালটেন্সি এটা বিরাট বিষয়! কত ছেলেমেয়ের জীবনের মোড় ঘুরে যায়! যে কেউ পারবেন তরুণ প্রজন্মকে সঠিক পথে রাখতে।
রাষ্ট্র এ দেশের মেধাবীদের মূল্যায়ন করেনি কখনও। মেধাপাচার দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। তার মধ্যে যতটুকু পাচারবিহীন থাকে, তার ব্যবহার নেই বললেই চলে।
আরেকটা কথা না বললেই নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায়ই চোখে পড়ে অমুক দেশে অধ্যাপকের বেতন রাষ্ট্রপতির সমান, তমুক দেশের অধ্যাপককে আদালতে বসতে দেওয়া হয়, ইত্যাদি।
সেসব অধ্যাপকের বিষয়ে আমাদের খোঁজ নেওয়া উচিত। লেখাপড়াবিহীন, বয়সের ভারে অধ্যাপক পৃথিবীর কোথাও নাই। গবেষণা নেই, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা নেই, সমসাময়িক জ্ঞান থেকে অনেক দূরে- তবু তিনি অধ্যাপক।
আবার ফলাফল যতই খারাপ হোক, আঞ্চলিক রাজনীতির পাশাপাশি কোনোভাবে ম্যানেজ করে বেসরকারি কলেজে যোগদান করতে পারলেই তিনি অধ্যাপক। তাই অধ্যাপক পদটি এখন আর সমাজের চোখে সম্মানজনক থাকতে পারছে না। রাষ্ট্র অধ্যাপক তৈরি করেনি, তার কাছ থেকে রাষ্ট্রের প্রাপ্যও বুঝে নেয়নি, তাকে সম্মানও দেয়নি। এমনকি জাতি গঠনের মতো বেতনও দেয়নি।
এ প্রসঙ্গে শেষ কথা বলি।
অনেকেই বলেন শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে।
আমি বলি- না, অবশ্যই নয়।
বেতন বাড়িয়ে দিলেই সব অযোগ্য শিক্ষক যোগ্য হয়ে যাবেন? সব ‘তেলবাজরা’ তেলবাজি ছেড়ে ছাত্রছাত্রীদের জন্য আত্মনিয়োগ করবেন? অসম্ভব।
অন্যান্য চাকরির সঙ্গে মিল রেখে শিক্ষকদের বেতন নির্ধারিত থাকবে। তবে শিক্ষকদের আয় বাড়াতে হবে, হবেই। যিনি মেধা ব্যয় করবেন, যিনি নিজেকে রাষ্ট্রের জন্য যতটুকু নিবেদিত করবেন, যিনি রাষ্ট্রকে তথা জনগণের জন্য যতটা কল্যাণকর হবেন, রাষ্ট্রও তাকে ততটা ফিডব্যাক দেবে। সারা দিন খেটেখুটে এক রুটি, আর খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থেকেও এক রুটি-তা হবে না।
সোজা কথা, টাকা জনগণের। তাই যার দ্বারা জনগণের যত বেশি রিটার্ন, তারও প্রাপ্য তত বেশি সুযোগ-সুবিধা, তত বেশি সম্মান। সোজা হিসাব।
লেখক: বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা), পিএইচডি (চীন)