বৃহস্পতিবার ৬ নভেম্বর ২০২৫
২২ কার্তিক ১৪৩২
দুর্যোগে মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটে
অধ্যাপক ডাঃ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর, ২০২৫, ১২:৪৭ এএম আপডেট: ০৬.১১.২০২৫ ১:৪৭ এএম |

 দুর্যোগে মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটে
বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে আয়োজিত ১৬ অক্টোবর ২০২৫ এ অনুষ্ঠিত মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি গোল টেবিল বৈঠকের আলোকে এ ফিচারটি রচিত। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল “বিপর্যয় এবং জরুরী পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা যেন পায়।” দেশের বেশির ভাগ মানসিক রোগী এখনো চিকিৎসার বাইরে থাকছে। এর অন্যতম কারণ সক্ষমতার অভাব। প্রচার কম, বাজেট, অজ্ঞতা, চিকিৎসক সংকট, ধর্মীয় গোড়ামি, অবৈজ্ঞানিক চিন্তা ও কুসংস্কার। বাংলাদেশে মানসিক চিকিৎসা এখনও পুরোনো আদলে আটকে আছে। অনেকে এ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে দ্বিধাবোধ করেন। কারণ মানসিক রোগকে সমাজে ভিন্নদৃষ্টি ভঙ্গিতে দেখা হয়।
উত্তরায় মাইলষ্টোন স্কুল এন্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হওয়া এবং গণঅভ্যুত্থানের ঘটনার আহত ও ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সংকট তৈরি হয়েছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসার প্রবণতা কম। এ ছাড়া চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিবেশ, স্বাস্থ্যসেবায় জনবল স্বল্পতা, রেফারেন্স ও বাজেট সমস্যাও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দূর্ঘটনা বা দূর্যোগ পরবর্তী আহত ব্যক্তিদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা অত্যন্ত জরুরী। মাইলষ্টোনের ঘটনায় শিক্ষকদের সচেতনামূলক প্রোগ্রাম হয়েছিল। সেখানে দু’একজন শিক্ষককে কান্না করে তাঁদের মানসিক সমস্যার কথা বলতে দেখা গিয়েছে। এসব শিক্ষকদের এখনো অনেকে মানসিক সমস্যায় ভূগছেন। তবে সমস্যাটা যে এতটা গুরুতর সেটা অনেকেরই জানা ছিল না। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে, বিপর্যয় বা জরুরী পরিস্থিতিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি পাঁচজনে একজন মানসিক সমস্যায় ভুগে থাকেন। মাইলষ্টোনে বিমান দূর্ঘটনা পরবর্তী ২৫৫ জন শিক্ষক শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকের উপর চালানো জরিপে দেখা গেছে Ñ৭১ শতাংশ ঘুমের সমস্যা, ২৯ শতাংশের খিটখিটে মেজাজ, ২৬ শতাংশ ফ্লাশব্যাক, ২৬ শতাংশ ক্ষুধামন্দা, ২০ শতাংশ মনযোগে ঘাটতি, ২০ শতাংশ কাজে অনাগ্রহ Ñএসব সমস্যায় ভুগছেন। আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, রোগের তীব্রতা না বাড়লে চিকিৎসাকের আওতায় আসার প্রবণতা কম।
যেহেতু প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছোট ছোট বাচ্চারা সরাসরি ঘটনাটি দেখেছে, তাদের মধ্যে কিছু শিক্ষার্থী এখনও ট্রমার মধ্যে আছে যারা স্বাভাবিকভাবে কথা বলে না, শুধু তাকিয়ে থাকে। সাইকিয়াট্রিষ্টদের ধারণা শিক্ষকদের অবস্থা ছাত্রদের চেয়েও খারাপ। তিনজন শিক্ষকতো মারাই গেলেন। এখনো ৬ জন শিক্ষক স্বাভাবিক কথা বলেন না। একজন ক্লাসে ফেরার চেষ্টা করেও পারেন না। তাঁদের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মত চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়নি। তাছাড়া সাতজন শিক্ষার্থী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছে। তাদের অনেকে ক্লাস শুরু করছে। অভিভাবকদের একাংশ এখনো বিপর্যস্ত। আরেক অংশ ছেলে-মেয়েদের চেয়ে অর্থ প্রাপ্তির বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন। এটিও মানসিক রোগ কিনা কে জানে।
বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থানে সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার ভুক্তভোগীদের মধ্যে বিষন্নতা ও পোষ্ট ট্রমেটিক ষ্ট্রেস ডিস অর্ডার সংক্রান্ত বালাইয়ে হয়। এতে দেখা গেছে, আহত ব্যক্তিদের এক চতুর্থাংশ গুরুতর বিষন্নতায় ভোগছিলেন। জাতীয় অর্থোপেডিক্স হাসপাতালে ভর্তি আহতদের এক তৃতীয়াংশ গুরুতর মানসিক রোগে ভোগছিলেন। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে এই হার ছিল ২১.৮। এসব রোগীর চিকিৎসা করতে সাইকিয়াট্রিষ্টদের অনেক চ্যালেঞ্জের মুখামুখি হতে হয়েছে। রোগীর দেখাশোনার জন্য কোন স্বজন ছিল না। অনেকে সুস্থ হয়েও হাসপাতাল ছাড়তে চাচ্ছিলেন না। এরা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কোন কথা বলতে চাননি। তাঁরা চাচ্ছিলেন উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হোক বা অর্থ সহায়তা দেয়া হোক। এক্ষেত্রে চিকিৎসা দেয়া অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ে।
একটি মেয়ে শিশু ছোটবেলা থেকেই অনিরাপত্তার মধ্যে বড় হয়ে উঠে। তাকে সীমাবদ্ধতা শেখানো হয়, ধৈর্য্যধারণ করতে শেখানো হয়। শেখানো হয় Ñকি করা যাবে, কি করা যাবে না। এদের জীবন কাটে ট্রমার মধ্য দিয়ে। না বলা কথা বহন করতে করতে কিশোরী হয়ে উঠে, কখনো কাউকে বলতে পারে না। বললেও মা বলছেন, এটা বলা যাবে না,  বললে মানুষ খারাপ বলবে। কখনো বিয়ে দেয়া যাবে না। এ ব্যাপারে বাবারাও যেন কিছু বলতে চান না। বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরীরা নানারকম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। হরমোনিক পরিবর্তন যুক্ত হয়, আরও যুক্ত হয় পরিবার ও সমাজের চাপ। তখন সে খিটখিটে মেজাজের হয়ে যায়। কথা শুনতে চায় না বিরক্ত বোধ করে। মনের ও আবেগের নানা ধরনের সমস্যা হয়। কিন্তু তখন আমরা কেউ মনরোগ চিকিৎসকের কাছে যাই না। অনেক কিশোরী স্কুল টিফিনের টাকা জমিয়ে চিকিৎসার জন্য আসে। তারা জানায় বাসায় সমস্যার কথা বললে কেউ গুরুত্ব দেয় না। মুদ্দা কথা হচ্ছে, এভাবেই আমাদের মেয়েরা চিকিৎসার বাইরে থাকছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, একজন নারী চিকিৎসার আওতায় এলে পরিবার, সন্তান সবাই ভাল থাকবে।
বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল ৯২ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা নেন না মূলতঃ সামাজিক সমস্যা বা ষ্টিগমার কারণে। অনেকে ভাবেন, একবার মানসিক চিকিৎসা শুরু করলে আর এ চিকিৎসা বন্ধ করা যাবে না। এতে বিয়েতে সমস্যা বা সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হতে পারে। ফলে চিকিৎসা না নিয়ে বিষয়টি চেপে রাখেন। বর্তমানে দেশে মাত্র ৫০০ জনের মত ক্লিনিকেল সাইকোলজিষ্ট আছেন, অথচ প্রয়োজন ৩৫০০ বা ৪০০০ জন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে প্রতিবছর এ বিষয়ে মাত্র ২০ জন ছাত্র ভর্তি হয়। গত ৩০ বছরে স্নাতক হয়েছেন মাত্র ৫২০ জন যা সাড়ে তিন কোটি মানসিক রোগীর তুলনায় অনেক কম। দেশের অনেক মানুষ জানে না কোনটা মানসিক রোগ। তাই সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এক্ষেত্রে স্কুল কলেজ পর্যায়ে সেমিনার ও কর্মশালার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করা যেতে পারে। দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এটি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সবসময় সেবা দিতে হবে Ñএমনটি নয়। একজন এমবিবিএস ডাক্তারও যদি দক্ষ হন, তবে তিনি সেবা দিতে পারিবেন। এজন্য তাঁদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে সাইকিয়াট্রিষ্টদের সুপারিশমালা নিম্নরূপ ঃ-
১)    মানসিক রোগী মানেই ‘পাগল’ নয়, সমাজে এর ব্যাপাকতা ও সচেতনতা প্রচার বাড়াতে হবে
২)    সব বিশ^বিদ্যালয়ে ক্লিনিকেল সাইকোলজি বিভাগ ও মেডিক্যাল কারিকুলামে মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থান জোরদার করতে হবে 
৩) রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতাহারে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের কর্মসূচী থাকতে পারে 
৪) ৩৭ টি সরকারি মেডিকেল কলেজকে দূর্যোগকালীন স্বাস্থ্যসেবার ফোকাল পয়েন্ট হিসাবে যুক্ত করা হোক
৫) দক্ষ জনবল বাড়াতে প্রশিক্ষনের গুরুত্ব দিতে হবে
৬) মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বাজেট বাড়ানো দরকার 
৭) দূর্যোগ পরবর্তী পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে প্রাধান্য দিতে হবে
৮) প্রান্তিক পর্যায়ে টেলি-সাইকিয়াট্রিক ব্যবস্থা ও রেফারেল সিস্টেম চালু করতে হবে
৯) প্রাইমারি হেলথকেয়ারের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা যুক্ত করা হোক
১০) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্যের পরামর্শ পেতে সাইকোলজিষ্ট নিয়োগের ব্যবস্থা করা হোক। 
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ












http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
আনন্দযাত্রা পরিণত হলো চিরবিদায়ে
কুমিল্লায় ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে বিএনপি
কুমিল্লা-১০ আসনে রেলপথ ও মহাসড়ক আটকে বিক্ষোভ
বাংলাদেশ তালীমে হিযবুল্লাহ, বাংলাদেশ ইসলামি যুব কাফেলা ও বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র কাফেলা কুমিল্লা মহানগর শাখার পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত হয়
দেবিদ্বারে ভূয়া নির্বাচনে সমিতির কমিটি গঠন: তদন্ত কমিটি গঠন জেলা সমবায় অফিসের
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
শিশু মীমকে হত্যার পর জানাজা দাফনেও অংশ নেয় ঘাতক
বিএনপি নেতা এরশাদ উল্লাহর সঙ্গে গুলিবিদ্ধ সরোয়ার বাবলার মৃত্যু
বিএনপির মনোনয়ন বঞ্চিত হাজী ইয়াছিন সমর্থকদের মশাল মিছিল
চট্টগ্রামে বিএনপির প্রার্থী নির্বাচনী জনসংযোগে গুলিবিদ্ধ
রামমালা গ্রন্থাগার ডিজিটালাইজেশন উদ্যোগ নেওয়া হবে: তথ্য উপদেষ্টা
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২