
লিও টলস্টয়ের আনা কারেনিনা আমার
প্রিয় উপন্যাস। শেষজীবনে টলস্টয় তাঁর নিজের সৃষ্টির উপর বিরুপ হয়েছিলেন।
আর্টের যে সীমানা তিনি বেঁধে দিতে চেয়েছিলেন তা মহৎ ভিন্ন আর কাউকে
স্বীকৃতি দেবে না। ‘আনা কারেনিনা’র বিষয়বস্তু তাঁর মতে মহৎ নয়। শুধু তাঁর
মতে কেন, অনেকেরই মতে মহৎ নয়। কিন্তু ইলিয়াডের বিষয়বস্তু যদি হয় হেলেন ও
প্যারিসের নিষিদ্ধ প্রেম তাহলে সেই মহাকাব্যকেই বা মহৎ কাব্য বলব কেন? তাতে
যুদ্ধের বর্ণনা আছে বলে? টলস্টয় তো শেষজীবনে যুদ্ধের পক্ষপাতী ছিলেন না।
‘আনা কারেনিনা’র শেষখন্ডে তাঁর যুদ্ধবিরোধী জীবনদর্শনের প্রভাব পড়েছে।
‘আনা
কারেনিনা’ যখন প্রথম পড়ি তখন আমার বয়স কত? আঠারো উনিশ কুড়ি। বইখানা
নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু বিষয়বস্তু নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ বলেই আগ্রহ এত। আদ্যোপান্ত
পড়ার মতো ধৈর্য নেই, অর্ধেকের উপর তো লেভিনের অর্থাৎ টলস্টয়ের জমিদারি
দর্পণ ও জীবনজিজ্ঞাসা। ওসব আমি লাফ দিয়ে ডিঙিয়ে যাই। আমার একমাত্র আকর্ষণ
নিষিদ্ধ প্রেমে ও প্রেমিক প্রেমিকার মিলনে বিরহ। পরিণাম যে লেভিন ও কিটির
সমাজসম্মত প্রেমের বেলা হবে সুখের এটা তো ভালোই, কিন্তু আনা ও ভ্রনস্কির
অসামাজিক প্রেমের বেলা হবে পাপের ও পাপের ফলে পতনে ও পতনের ফলে মৃত্যুর এতে
আমার অন্তরের আপত্তি ছিল। এটা তো হোমারের মতো হলো না, হলো না খ্রীস্টপূর্ব
গ্রীক জীবনবোধের বা মূল্যবোধের মতো। পাপ থেকে পতন, পতন থেকে মৃত্যু
হেলেনের বেলা ব্যবস্থা নয়। প্রেমিকের সঙ্গে কুলত্যাগিনী হেলেন পারিসের
সঙ্গে পতিপত্নীরূপে আনন্দেই দশ বছর বাস করেছিল। পরে হেলেনই মেনেলাউসের ঘরে
সম্মানের সঙ্গে ফিরে আসে ও পতিপত্নীরূপে বাস করে। সমাজবিধানে বা নীতিবোধে
বাধে না। খ্রীস্টীয় ক্ষমাধর্মেরও প্রয়োজন হয় না। হেলেন হরণের জন্যে ট্রয়
অভিযানেরই প্রয়োজন ছিল। যেহেতু গ্রীকদের সম্মান নষ্ট হয়েছিল। নষ্ট সম্মান
পুনরুদ্ধার করতে হলে যুদ্ধ করে হেলেনকে পুনরুদ্ধার করতে হয়। এর মধ্যে পাপ
কোথায়, পতনই বা কার? পতন যদি কারো হয়ে থাকে তবে তা ট্রোজানদের। মৃত্যুও
তাদেরই। কিন্তু হেলেনকে তা বলে কেউ বলবে না ‘ফলন উত্তম্যান’ বা ‘পতিতা
নারী’। বস্তুত ‘পতিতা’ কথাটিও ইংরেজী ‘ফলন নারী’র অনুবাদ। এখন ওটি গণিকার
সমার্থক হয়েছে। গ্রীকরা বা প্রাচীন ভারতীয়রা অমন কথা ভাবতেই পারতেন না। ওটা
ইহুদী-খ্রীস্টান ধারণা। টলস্টয় ওটা গ্রীক রোমান ক্লাসিক ঐতিহ্য সূত্রে
পাননি, পেয়েছেন ইহুদী খ্রীস্টীয় ঐতিহ্যসূত্রে। ব্যভিচার সেখানে হত্যার মতো
অপরাধ। দশবিধ অনুজ্ঞার অন্যতম ‘ব্যভিচার করিয়ো না’। নারীপক্ষে অতি কঠোর
শাস্তি। সকলের দ্বারা লোষ্ট্রাঘাতে নিধন। পুরুষের পক্ষে অতটা কঠোর নয়। কারো
কারো বেলা আদৌ কঠোর নয়। রাজা ডেভিড তো অপরের ক্ষেত্রে পুত্রলাভ করেন।
ইতিহাসে রাজা সলোমনের স্থান কত উচ্চে! সেই উত্থানের পেছনে ছিল পতন, কিন্তু
তার জন্যে শাস্তির কথা কেউ কখনো বলেনি। সাধারণের বেলায়ই শাস্তি। বিশেষত
নারীর বেলায়। টলস্টয় এই প্রাচীন ধারনার উত্তরসূরী।
খ্রীস্টধর্ম
প্রবর্তনের পরও তার সঙ্গে সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হচ্ছিল অভিজাত সমাজের
পূর্বতন নরনারীর প্রেমনীতি। নাইট ও লেডীদের হৃদয় বিবাহের দ্বারা শাসিত ছিল
না। রাজা আর্থারের রানী গুইনেভেয়ার ছিলেন নাইট ল্যান্সলটের প্রেমাসক্ত। সে
প্রেম নিতান্ত অশরীরী ছিল না। ‘কোটলি লাভ’ বা রাজসভাসম্মত প্রেম যাকে বলা
হতো সেটা ছিল উত্তমের প্রতি অধমের পূজা নিবেদন। অন্তত প্রকাশ্যে
কামগন্ধহীন। তার থেকে এসেছে অসংখ্য রোমান্স ও ত্রুবাদুর গীতি। এদেশে যেমন
কানু বিনে গীত নেই ইউরোপে তেমনি ‘কোর্টলি লাভ’ বিনে মধ্যযুগীয় কাব্য ও
রোমান্স নেই। সাধুরা পছন্দ করতেন না, কিন্তু জনসাধারণ ভালোবাসত। সাধুরা
নিয়ে এলেন এর মধ্যে পাপবোধ। পাপের পরিনাম মৃত্যু। যেখানে মৃত্যু নয় সেখানে
সমাজের বাইরে পতিত হয়ে থাকা। সেটা মৃত্যুর চেয়েও অসহনীয়। আত্মঘাতিনী না হলে
টলস্টয়ের আনা কারেনিনাকেও অপাঙ্ক্তেয় হয়ে থাকতে হতো। বড়লোকের রক্ষিতার যে
পরিমাণ মর্যাদা তার বেশী সে পেত না। ভ্রনস্কির দ্বারা পরিত্যক্ত হলে সে যা
হতো তাকে বলে ফরাসীভাষায় ‘দেমি মঁদ’। আমরা বলি “হাফ গেরস্ত”। অপেরা বা
থিয়েটারের অভিনেত্রীদের মর্যাদা আগে যেরকম ছিল। দিনকাল বদলেছে। তাঁরাও জাতে
উঠেছেন। একশো বছর পরে লেখা হলে ‘আনা কারেনিনা’র পরিণাম অবশ্যম্ভাবীরূপে
ট্র্যাজিক হতো না। এমন কি সমসাময়িক ফ্রান্সে বা ইংলন্ডে লেখা হলেও কাহিনীর
শেষটা অতখানি মর্মান্তিক না হতেও পারত। গলসওয়ার্দি যে ওটা মেনে নিতে পারলেন
না তার কারণ তাঁর অভিজ্ঞতা ভিকটোরিয়া ভন্ডামির হলেও পশ্চিম ইউরোপীয়
উদারতার। টলস্টয় দুটোর কোনোটার পক্ষপাতী ছিলেন না । তিনি মনে প্রাণে
খ্রীস্টীয় আদর্শে বিশ্বাসী। তার থেকে করুণা। আবার তারই থেকে মরণান্ত
সমাধান। মাঝখানে অবশ্য আরো একটা বিকল্প ছিল। আনা অনুতাপ করে স্বামীর সংসারে
ফিরে যেত। সেই ভরসায় স্বামী স্ত্রীর ডিভোর্স ঘটানো হয়নি। কিন্তু তাতে
রসভঙ্গ হতো। টলস্টয় নীতিনিপুণ হলেও আর্টিস্ট। আর্টের দিক থেকে স্বামীর
সঙ্গে মিলন অসম্ভব। আবার নীতির দিক থেকে প্রেমিকের সঙ্গে বিবাহ অবাঞ্ছনীয়।
তাহলে তো নারীর পদস্খলনকে পুরস্কৃত করা হলো। সেইসঙ্গে পুরুষের পদস্খলনকেও।
০২
‘যুদ্ধ
ও শান্তি’ লেখা সমাপ্ত হয় ১৮৬৯ সালে। পরের বছর টলস্টয়ের পত্নী তাঁর বড়
বোনকে লেখেন এবার তাঁর স্বামী লিখতে চান একটি অভিজাতশ্রেণীর বিবাহিতা
মহিলার পদস্খলনের কাহিনী। তাঁর সমস্যা হবে তাঁর কাহিনীর নায়িকাকে এমনভাবে
উপস্থাপিত করা, যাতে তাকে গিলটি মনে না করে প্যাথেটিক মনে করা হয়। দোষী মনে
না করে করুণ মনে করা হয়। বই লেখা শুরু হয় ১৮৭৩ সালে। কিন্তু ইতিমধ্যে ১৮৭২
সালে ঘটে যায় এক সত্যিকার দুর্ঘটনা। রেল লাইনে কাটা পড়ে মারা যান এক
ভদ্রমহিলা, তাঁর নামও আনা। প্রতিবেশী এক বিপত্নীক জমিদারের উপপত্নী। জমিদার
তাঁর সন্তানদের গভর্নেসকে বিবাহ করতে চান শুনে আনা আত্নহত্যা করেন।
টলস্টয়কে এই অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। সম্ভবত এর থেকেই
তিনি পেয়ে যান তাঁর নায়িকার নাম ও পরিণাম। যা শুধুমাত্র করুণ হতে পারত তাই
হলো ট্র্যাজিক। ট্র্যাজেডিকে অবশ্যম্ভাবী করতে হলে তার কারণ দর্শাতে হয়।
কারণ থেকে কার্য ঘটে এটা যেমন সত্য তেমনি সত্য কার্যও কারণকে চুম্বকের মতো
নিয়তির অভিমুখে টানে। আমার অনুমান টলস্টয়ের আনার ভবিতব্যই তার অতীতকে
নিয়ন্ত্রিত করেছে। কাহিনীকে সত্যঘটনামূলক করতে গিয়ে মূল কল্পনাকে তদানুযায়ী
করতে হয়েছে। ওরকম একটা দুর্ঘটনা না ঘটলে কার্য হয়তো কারণ থেকে নিম্নমুখে
বইত, জেনে নিয়ে বই লিখতে আরম্ভ করেন। কিছুদূর এগোতে না এগোতেই এক রেল
দুর্ঘটনা। একটি লোক চাকার তলায় পড়ে মারা যায়। স্বেচ্ছায় কিংবা নেশার ঘোরে
কিংবা কুয়াশায়। ভ্রনস্কির সঙ্গে আনার প্রথম সাক্ষাতের পরক্ষণে ওটা কি
শুভদৃষ্টি না অশুভদৃষ্টি?:
আনার বিয়ে হয়েছিল যাঁর সঙ্গে তিনি তার থেকে
বয়সে বিশ বছরের বড়ো, সুদক্ষ ও প্রবীণ রাজকর্মচারী। দেশের সবাই তাঁকে একডাকে
চেনে। বিদেশেও তাঁর নামডাক। এমন মানুষের সময় কোথায় যে স্ত্রীকে সঙ্গ
দেবেন? বিয়ের আগে ভালোবাসা হয়নি, বিয়ের পরেও না। স্বামী স্ত্রীর সম্বন্ধ
নিতান্তই কর্তব্যের সম্বন্ধ। দু’জনেই দু’জনের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ। ভালোবাসা
আনার জীবনে যখন এল তখন সে শুধু একজন বিবাহিতা মহিলা নয়, একটি পুত্রের
জননী। তার ছেলের বয়স আট বছর। তার হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা তার ছেলের উপরেই
কেন্দ্রীভূত। তার ছেলেই তার জীবনের কেন্দ্র। একটা দিনের জন্যেও সে ওকে ছেড়ে
থাকতে পারবে না। এমন যে পুত্রগত প্রাণ জননী তার জীবনে কোন্ এক অশুভক্ষণে
অবিবাহিত ভ্রনস্কির আবির্ভাব। কাউন্ট ভ্রনস্কি ধনীর সন্তান, স্বেচ্ছায় বেছে
নিয়েছে সৈনিকের জীবন, সেটা তার কেরিয়ার হলেও জীবিকা নয়, ঘোড়দৌড় ইত্যাদি
নিয়েই সে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। প্রেমে পড়ার মতো অবসরও নেই, অভিপ্রায়ও নেই।
বিবাহ তো দূরের কথা। তাকে স্বামীরূপে কামনা করেছিল আনার ননদ কিটি, তার
প্রেমেও পড়েছিল ওই অষ্টাদশী তরুণী। আনার আরেক ননদ ডলি একদিন তার স্বামী
স্টিভার অবিশ্বস্ততার প্রমাণ পেয়ে স্তম্ভিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়। তখন তাকে
শান্ত করার জন্যে পিটার্সবুর্গ থেকে মস্কো ছুটে আসে আনা। রেলপথে
সহযাত্রিণী হন বর্ষীয়সী কাউন্টেস ভ্রনস্কি। মস্কো ষ্টেশনে তাঁকে ট্রেন থেকে
নামিয়ে বাড়ি আনার জন্যে যায় তাঁর পুত্র। সেইসুত্রে ভ্রনস্কির সঙ্গে আনার
প্রথম দর্শনে প্রেম।
এই নিষিদ্ধ প্রেম তাদের দু’জনকেই ভাসিয়ে নিয়ে যায়
এক অপ্রতিরোধ্য বণ্যায়। সে যেন এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যার উপরে মানুষের হাত
নেই। প্রকৃতিই স্থির করে দেয় তাদের নিয়তি। আনার বিবেক একটুও সায় দেয় না,
কিন্তু সারা দেহ সারা মন সারা হৃদয় সারা সত্তা সাড়া দেয়। এই বন্যায় সে তার
পায়ের তলার মাটি থেকে ছিটকে পড়ে। সেটার নামই কি পদস্খলন? পতন? ভ্রষ্টতা?
ভ্রনস্কিরও একই দশা। কিন্তু তার তো স্ত্রী নেই, সন্তান নেই, তাদের প্রতি
কর্তব্যের টান নেই। সে অপেক্ষাকৃত স্বাধীন। কিন্তু পুরোপুরি স্বাধীন সেও
নয়। নিষিদ্ধ প্রেমে জড়িয়ে পড়ে মিলিটারি ডিউটিতে অবহেলা করলে তারও চাকরি
নিয়ে টানাটানি। অবিবাহিত পুরুষের জীবনে বিবাহিতা নারীর সঙ্গে ‘অ্যাফেয়ার’
নতুন কিছু নয়। অমন তো কত হয়। তেমনি বিবাহিতা নারীর জীবনেও অবিবাহিত পুরুষের
সঙ্গে ‘অ্যাফেয়ার’ অজ্ঞাত বা অশ্রুত নয়। উভয় পক্ষই ওটাকে ক্ষণস্থায়ী বলে
জানে, তাই অনিত্যের জন্যে নিত্যকে বিসর্জন দেয় না। ওটা ক্ষণিকের মতিভ্রম।
ব্যাপার-টাকে ওইভাবে নিলে আনাকেও কুলত্যাগ করতে হতো না, তার স্বামীকেও
হতমান হতে হতো না, ভ্রনস্কিরও মিলিটারি সার্ভিস থেকে পদত্যাগ ঘটত না,
কিটিরও হতাশ প্রেম থেকে অসুখ বাধত না, ভ্রনস্কির সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত তার
বিয়ে দিয়ে মধুরেণ সমাপয়েৎ করতে পারা যেত। ‘আনা কারেনিনা’ হতো একখানি কমেডী।
তা না হয়ে যা হলো তা একখানি ট্র্যাজেডী। মূল কারণ, আনা ও ভ্রনস্কির প্রেম
অভিজাত সমাজে প্রচলিত সাধারণ একটা ‘অ্যাফেয়ার’ নয়, যাকে দুদিন বাদে বা
দুবছর বাদে ঝেড়ে ফেলতে পারা যায়। অবৈধ সহবাস সত্ত্বেও। অবৈধ
সন্তানলাভসত্ত্বেও। কারেনিনা যথেষ্ট ক্ষমাশীল ছিলেন, আত্মীয়স্বজনও যথেষ্ট
দরদী। কিন্তু যে-নারী পরপুরুষকে ও যে-পুরুষ পরনারীকে বরাবরের জন্যে নিজের
করতে চায় তাদের একপক্ষের যদি একটি সন্তান থাকে ও সে সন্তানের মায়া কাটানো
পরমদুঃখকর হয় তবে তার পরম দুঃখের কোনো ক্ষতিপূরণ নেই। সেই দুঃখিনী দয়িতাকে
সুখী করা ধন দিয়ে নয়, মান দিয়ে নয়, সঙ্গ দিয়ে নয়, এমন কি ডিভোর্সের পর
বিবাহ দিয়েও কারো সাধ্য নয়।
এক্ষেত্রে ধনের কোনো অভাব ছিল না। মানের
অভাব ছিল, পিটার্সবুর্গের অভিজাত সমাজে আনা অপমানিত হয়েছিল। মস্কোর অভিজাত
মহলেও সে অপাঙক্তেয়। গ্রামে গিয়ে বসবাস করাই ছিল প্রকৃষ্ট পন্থা। যেদিন ওরা
গ্রামে ফিরে যাবে তার আগের দিন ঘটে আনার স্বেচ্ছাবৃত অপঘাত। আনা নিশ্চয়ই
আশঙ্কা করেছিল যে গ্রামেও সে সমানভাবে মিশতে পারবে না। সেখানেও তার আসন হবে
জমিদারের রক্ষিতার। সেখানেও তার মনে সন্দেহ থাকবে যে আনার ডিভোর্স যখন
হয়নি তখন ভ্রনস্কি তাকে বিয়ে না করে অন্য একজনকে বিয়ে করতে পারে। অথচ আনার
ডিভোর্সের জন্যে ভ্রনস্কির যত মাথাব্যথা আনার ততখানি নয়। আনার পক্ষে
ডিভোর্স পাওয়া না পাওয়া ছিল সেকালের আইন অনুসারে তার স্বামীর করুণানির্ভর।
যে নারী ব্যভিচারে দোষে দোষী সে কখনো তার স্বামীকে দোষ দিয়ে ডিভোর্সের
জন্যে আদালতে যেতে পারে না। আদালতে যেতে হলে যেতে হবে তার স্বামীকেই।
স্বামীই স্ত্রীকে দোষ দিয়ে ডিভোর্স আদায় করতে পারে। কিন্তু সেরুপ স্থলে
স্ত্রীর কলঙ্ক হবে, ছেলের কলঙ্ক হবে, স্বামীরও যে কলঙ্ক হবে না তা নয়।
কারেনিন সেটা এড়াতে চেয়েছিলেন, তা সত্ত্বেও উকিলের পরামর্শ নেন। পরে দেখা
গেল কারেনিন একজন বিশ্বাসী খ্রীস্টান। খ্রীস্ট নিষেধ করে গেছেন স্ত্রীকে
ডিভোর্স করতে। দোষী হলেও তাকে ক্ষমা করতে হবে। চার্চেরও সেই বিধান। কারেনিন
প্রথমটা উপরোধে পড়ে নিজের ঘাড়ে দোষটা টেনে নিয়ে আনাকে ডিভোর্স দিতে রাজী
ছিলেন না। পরে তাঁর কথা থেকে মনে হলো তিনি তাতেও রাজী, কিন্তু কন্যার
জন্মের পর কন্যাকে নিয়ে যখন আনা ভ্রনস্কির সঙ্গে ইটালী চলে যায় তখন
কারেনিনের সঙ্গে কথাবার্তার খেই ছিঁড়ে যায়। ইতিমধ্যে কারেনিন পড়েন কাউন্টেস
লীডিয়ার প্রভাবে । এই ধার্মিক মহিলা তাঁকে বোঝান যে ডিভোর্স পেলে আনা ঘরে
ফিরে আসতে চাইলেও ফিরে আসতে পারবে না, তার ভালো হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
আনার মঙ্গলের জন্যেই ওর প্রত্যাবর্তনের পথ খোলা রাখাই শ্রেয়।
কারেনিন
নিজে আবার বিয়ে করতেন না। তিনি আদর্শ খ্রীস্টান হতে চেয়েছিলেন। কেউ যদি
তোমার একগালে চড় মারে তুমি তার দিকে আরেক গাল বাড়িয়ে দেবে, এই নীতির
অনুসরণে তিনি অপরাধিনী স্ত্রীকে তার দ্বিতীয় বিবাহে সাহায্য করতে সম্মত
হয়েছিলেন। কিন্তু আনা তাঁর কাছে করুণা প্রার্থনা করেনি, তার হয়ে করেছিল তার
দাদা। সে অনুতপ্ত হয়নি। প্রেমের জন্যে তার দেহমনহৃদয় ক্ষুধার্ত। তার
ক্ষুধার নিবৃত্তি তার ভরা যৌবনে না হলে সে সারাজীবন জ্বলত। তার জীবন
জুড়িয়েছে বলে কি সে অনুতাপ করবে? তবে এটাও জানে যে সে বিবাহের শপথভঙ্গ করে
অপরাধী হয়েছে। তার অপরাধবোধ সত্য। অথচ অপরাধের দরুণ করণীয় যে অনুশোচনা সেটা
অসত্য। ঈশ্বর তাকে যেমন করে গড়েছেন সে তেমনি। সে সত্যকথা বলে, সত্যাচরণ
করে, না পারলে বিবেকের দংশনে পীড়া পায়। ছলনা তার স্বভাবে নেই। স্বামীর
অঙ্গীকৃত ডিভোর্স প্রত্যাখ্যান করে আনা দ্বিতীয় বিবাহের সুযোগ হারায়। পরে
যখন ভ্রনস্কির পীড়াপীড়িতে স্বামীর করুণাপ্রার্থী হয় ততক্ষণে খুব বেশী দেরি
হয়ে গেছে। তিনি অঙ্গীকারভঙ্গ করেন।
০৩
ভ্রনস্কির মতো সম্ভ্রান্ত
পরিবারের সন্তানকে যে দুঃখ পোহাতে হয় সে দুঃখ অন্যপ্রকার। আনার গর্ভে তার
যে কন্যা তাকে সে নিজের বলে দাবী করতে পারে না। আইনত সে কারেনিনের। তার
পদবী ভ্রনস্কি নয়, কারেনিন। পরে যেসব সন্তান জন্মাবে তারাও কেউ ভ্রনস্কি
বলে পরিচিত হবে না, হবে কারেনিন বলে। তাহলে বংশরক্ষা হবে কী করে? সে ধরে
নিয়েছে যে আনার সঙ্গে তার আইন অনুসারে বিয়ে হবে, যদি তার আগে ডিভোর্সটা হয়।
চার্চ তেমন বিবাহ স্বীকার করবে না, কিন্তু রাষ্ট্রে তার নজীর আছে। তখন তো
তার সন্তানদের ব্রনস্কি বলে পরিচিত হতে বাধা থাকবে না। আনার মতিগতি কিন্তু
বিপরীত। সে আর মা হতে চায় না। তা বলে সে ব্রহ্মচারিণী নয়। জন্মশাসনের উপায়
জেনে নিয়েছে। এ নিয়ে প্রেমিক প্রেমিকাতে মনোমালিন্য। ভ্রনস্কি চায়
স্বামী-স্ত্রীর সহজ স্বাভাবিক জীবন। তার কি ধনের অভাব যে একটি সন্তানেই সে
সন্তুষ্ট হবে? তাও পরের নামাঙ্কিত। সে চায় আরো সন্তান। পুত্রসন্তান।
সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। আনার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তার কাছে তার স্বামীর
দিকের পুত্রই যথেষ্ট। এক মুহূর্তের জন্যেও সে তার পুত্রকে ভুলতে পারে না।
তার জীবনকে সে ভাগ করে দিয়েছে পুত্র আর প্রেমিক দুজনের মধ্যে। সে একই কালে
পুত্রগত প্রাণ ও প্রেমিকগত প্রাণ। কী করে তাদের একবৃন্তে মেলাবে এই তার
সমস্যা। ডিভোর্স এ সমস্যার সমাধান নয়, যদি না পুত্রকেও তার পিতা তার মাতার
সঙ্গে থাকতে দেন। না, কিছুতেই তিনি এতে রাজী হবেন না। এটা দুরাশা।
আনা
ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়ছিল পুত্রের সঙ্গে প্রেমিকের জোড় মেলাতে না পেরে। সে
মেনে নিতে পারছিল না যে তাকে পুত্রের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবনধারণ করতে
হবে। তার মনে হচ্ছিল তার মরণই ভালো। এ রকম একটা সমাধান তার মাথায় আসে যখন
তার কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পরে সূতিকারোগে তার প্রাণ সংশয় হয়। ঘটনাটি
ঘটে তার স্বামীর গৃহেই। আনাকে বাঁচাতে তিনিও যৎপরোনাস্তি করেন। কন্যাটি
যদিও তাঁর নয় তা সত্ত্বেও তিনি তাকে ভালোবাসেন। সেই সন্ধিক্ষণে আনার মৃত্যু
হলে আশ্চর্যের বিষয় হতো না, কারণ ডাক্তাররাও সেই আশঙ্কা করেছিলেন।
ভ্রনস্কির বেদনা তখন দেখবার মতো। মৃত্যু আসন্ন জেনে আনা নিজেই উদ্যোগী হয়ে
স্বামীর সঙ্গে প্রেমিকের শান্তি স্থাপন করে। এমন একটি স্বর্গীয় দৃশ্য
বিশ্বসাহিত্যে দুলর্ভ। গ্রন্থ যদি এইখানেই সমাপ্ত হতো স্বামী স্ত্রী ও
প্রেমিকের মহিমাময় মিলনের মধ্যে কাহিনীর পরিণতি কী মহৎ হতো! তবে সূতিকারোগে
মরণ ঘটত আনার।
কিন্তু গ্রন্থকারের অভীষ্ট ছিল সে রকম মৃত্যু নয় অন্যরকম
মৃত্যু সংঘটন। তার ইঙ্গিত তিনি দিয়ে রেখেছিলেন ভ্রনস্কির সঙ্গে আনার প্রথম
দর্শনের সময়। দুর্ঘটনার বার্তা শুনে আনা মন্তব্য করেছিল, “এটা একটা অশুভ
লক্ষণ। তাদের মিলনের পরেও দেখা দেয় আর একটি অশুভ সংকেত। ঘোড়াদৌড়ে জয় হতে
যাচ্ছে ভ্রনস্কির। এমন সময় সে লম্ফমান ঘোড়ার পিঠে লম্বমান না হয়ে ধপ করে
বসে পড়ে। ঘোড়ার পিঠ ভেঙে যায়। যন্ত্রণার থেকে মুক্তিদানের অন্য উপায় না
থাকায় ঘোড়াটিকে গুলী করে মারতে হয়। ওটি অশ্বনয়, অশ্বিনী। সুন্দরী ও সুগঠিত।
যেন আনা কারেনিনার প্রতিরূপ। ভ্রনস্কি তাকে ভালোবেসে মনোনয়ন করেছিল। অথচ
তারই অপঘাত মৃত্যুর নিমিত্ত হলো।
শেষের দিকে আনা মৃত্যুর জন্যে অধীর হয়ে
উঠেছিল। ডিভোর্স পেলেও কি সে বাঁচতে চাইত? দ্বিতীয়বার বিবাহ করলেও কি সে
বাঁচত? তার জীবন কি সার্থক হতো পুত্রকে বরাবরের মতো হারিয়ে প্রত্যাবর্তনের
পথ বরাবরের মতো রুদ্ধ করে? এ বই তিনরকম ভাবে লিখতে পারা যেত। এ ব্যাপার
পঞ্চাশ বছর আগে ঘটলে কারেনিন পুশকিনের মতো ডুয়েল লড়ে মারা যেতেন। ভ্রনস্কিও
তো আনার মৃত্যু আসন্ন দেখে আত্মঘাতী হতে যাচ্ছিল। গুলীটা বুকে লাগলে সে-ই
মারা যেত। ত্রিভুজকে দ্বিভুজে পরিণত করতে হলে একজন না একজনকে মরতে হতোই।
সেই একজন হলো টলস্টয়ের বিচারে আনা। লেখকের বিচারই চূড়ান্ত। আনা যোগ দিল
বিশ্বাসাহিত্যের ট্র্যাজিক হীরোইনদের সঙ্গে। হেলেন তাদের একজন নয়। তার
সঙ্গে তুলনা বৃথা। ট্র্যাজিক হিরোইন হওয়া কি সম্ভব হতো আনা যদি পতিহারা বা
সাথীহারা হয়ে বেঁচে থাকত? পতিহারা হলে পুনর্বিবাহ সুগম হতো সন্দেহ নেই,
কিন্তু পুত্রের সঙ্গে দ্বিতীয় স্বামীর সামঞ্জস্য হতো কী করে? সাথীহারা হলে
পুত্রসুখে সুখী হতো, কিন্তু প্রিয়সঙ্গ পেত কোথায়?
মরণ ঝাঁপ দেবার আগে
আনার স্বগতচিন্তার বিক্ষিপ্ত টুকরোর মধ্যে এটাও ছিল যে তার প্রেমিক তাকে
প্রেম দিয়ে তৃপ্ত করতে পারেনি। কামনার তৃপ্তির জন্যে সে পিপাসার্ত। তার
শঙ্কাও ছিল যে ভ্রনস্কি তাকে একদিন সঙ্গ না দিয়ে পরিত্যাগ করবে।
পতিপরিত্যাগিনী হবে প্রেমিকপরিত্যক্তা। ভ্রনস্কি আগের মতো সমাজে মেশে, আনা
তো তা পারে না। এটাও তার সহ্য হয় না। তা বলে কি পুরুষ মানুষ তার সব কাজ
ফেলে প্রিয়ার সঙ্গে সমস্তক্ষণ কাটাবে? একটি দিনের জন্যেও বাইরে যাবে না?
গেলে তার প্রিয়া তাকে ভুল বুঝবে? বস্তুত বিবাহ একজন পুরুষকে বা নারীকে যে
পরিমাণ স্বাধীনতা দেয় বিবাহব্যতিরিক্ত একত্রবাস সে পরিমাণ স্বাধীনতা দেয়
না। বিবাহেই নিরাপত্তা বেশী। সোয়াস্তি বেশী। সুখের চেয়ে সোয়াস্তি ভালো।
কারেনিনের সঙ্গে আনার সুখ ছিল না, সোয়াস্তি ছিল। আর ছিল সামাজিক মর্যদা ও
মেলামেশার পরিসর। ভ্রনস্কির সঙ্গে সুখ ছিল, সোয়াস্তি ছিল না। আর ছিল না
সামাজিক স্বীকৃতি ও নিমন্ত্রণ আমন্ত্রণ। কোলের মেয়েটিকে নিয়ে কী জানি কেন
তার আনন্দ ছিল না। ভ্রনস্কিরও না। সে-ই হতে পারত তাদের মিলনের সেতু। কিন্তু
আনা তাকে ভালোবাসত না, ভ্রনস্কিও যে আদর করত তা তো মনে হয় না। বরং
কারেনিনেরই তার প্রতি একটা অহেতুক মমতা।
০৪
টলস্টয়ের ‘যুদ্ধ ও
শান্তি’র একটা শাশ্বত আবেদন আছে। এক শতাব্দী পরেও তার ইতরবিশেষ হয়নি। ‘আনা
কারেনিনা’ সম্বন্ধেও সেকথা বলা চলে কি? তারও কি একটা শাশ্বত আবেদন আছে? ১৫০
স্থ পরেও ও তেমনি সজীব, তেমনি সুন্দর, তেমনি সার্থক, তেমনি প্যাসন ও তেমনি
কম্প্যাশন ভরা? টলস্টয় যেসব প্রতিমায় জীবন্যাস করেছিলেন তারা কি তেমনি
রক্তমাংসের মানুষ, তেমনি ভালোয় মন্দে মেশা? এটি একটি আশ্চর্য
চরিত্রচিত্রশালা। যে যেমন সে তেমন। প্রত্যেকেই বিশিষ্ট। শিল্পকর্ম-হিসাবে
‘আনা কারেনিনা’ এখনো অতুলনীয়। যে টলস্টয় আর্টিস্ট তিনি তাঁর প্রতিভার
স্বাক্ষর রেখে গেছেন এতে। আর্টের দিক থেকে স্বয়ং ডস্টয়েভস্কির মতে এ নভেল
নিখুঁত। বিতর্ক কেবল মনস্তত্ত্ব নিয়ে। মনস্তত্ত্ব ইতিমধ্যে আরো বেশী
সূক্ষ্ম হয়েছে। ফ্রয়েড এসে চিরকালের রুদ্ধ দুয়ার খুলে দিয়েছেন। অবচেতনে
অবগাহন করলে চিন্তার ও আচরণের অন্যরকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তারপর সেকালের
সেই শাদা-কালো দোরঙা নীতি ও নরনারীর দোরোখা নীতি একালে মেনে নেওয়া যায় না।
মরালিস্ট টলস্টয়ের সঙ্গে একালের বিদগ্ধ জনের মতভেদ অন্যায্য নয়। আনা যদি
বাঁচত তাহলে ভ্রনস্কির প্রতি তার একনিষ্ঠ প্রেমই তাকে সাধারণ পতিব্রতার
চেয়ে মহত্তর আসন দিত। যেমন দিয়েছে রাধাকে। পরিত্যক্তা বলে রাধাকে তো মরতে
হয়নি। তবে রাধা তো শ্যামের জন্যে কুলত্যাগ করেন নি। যার জন্যে কুলত্যাগ
সে-ই যদি পরিত্যাগ করে তবে তার শাস্তি প্রাণত্যাগ। তার মর্ম নিজের মৃত্যু।
ভ্রনস্কিকে আনা ভুল বুঝে গুরু দন্ড দিয়ে গেল। ধ্বংস করে গেল তার জীবন। যাকে
ভালোবাসে তার সর্বনাশ করাই কি প্রেমিকার সাজে? এটাই হয়তো বাস্তব সত্য।
যেমন তীব্র প্যাশন তেমনি তীব্র সন্দেহ ও ঈর্ষা। দুঃখীরা দুঃখ দিতে
ভালোবাসে। আনার মতো দুঃখিনী কে? ওটাও তো প্রেমের পরীক্ষা। ভ্রনস্কির প্রেম
যদি সর্বংসহ হতো তবে হয়তো বা তাদের মিলিত জীবন স্থায়ী হতো।
এদের দু’জনের
প্রেমকে আমরা সামাজিক তথা নৈতিক দৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত। তাই মনে করি এদের
ট্র্যাজেডির মূলে সামাজিক তথা নৈতিক বিধি লঙ্ঘন। এ ধারণা ভুল নয়, কিন্তু
পুরোপুরি ঠিকও নয়। মূলের নিচেও মূল আছে। তলিয়ে না দেখলে নজরে পড়ে না। এই
রহস্যের তল মনস্তত্ত্বের অতলে। আনা ভ্রনস্কিকে ভালোবাসে, বহুভাগ্যে
পরস্পরকে কাছে পেয়েছে। কিন্তু ওই যে কাছে পাওয়া ওটাই ওদের কাল হলো। কাছে
এলেই ঠোকাঠুকি বাধে। কেন বাধে তার নানা বিচিত্র কারণ। কিন্তু আধুনিক
মনোবিদরা ক্রমেই উপলব্ধি করছেন যে, অনুরাগের উল্টো পিঠে বিরাগও থাকে। যাতে
সবচেয়ে আনন্দ তাতে সবচেয়ে বেদনা বা বিকার। তা ছাড়া ওটা একপ্রকার রণ। রণ
থাকলে জয়-পরাজয়ের প্রশ্নও থাকে। আনা চায় ভ্রনস্কির উপর বিজয়িনী হতে।
ভ্রনস্কি কি বার বার পরাজয় মেনে নেবে? কখনো কি বিদ্রোহী হবে না? আনা চায়
বিজিতকে বন্দী করে রাখতে। বন্দী কি মুক্তির জন্যে ছটফট করবে না? আজকাল
প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায় একটা কথা। সেকস ওয়ার। ওর তর্জমা করলে কটু লাগবে।
উপযুক্ত পারিভাষিক শব্দ নেই। আনা কারেনিনার স্রষ্টা শুধু যে মনোবিদ্ ছিলেন
তাই নয়, বহু নারীর সংসর্গে এসে হাতে কলমে পরীক্ষা নিরীক্ষাও করেছিলেন। তাঁর
নারীচরিত্রগুলি সেইজন্যে এমন জীবন্ত। তিনি যেন তাদেরই একজন হয়ে ভিতর থেকে
তাদের দেখেছিলেন ও বুঝেছিলেন।
নারীজাতি সম্বন্ধে বিষম তিক্ত ছিলেন
টলস্টয়। গোর্কীকে যা বলেছিলেন তার মর্ম নারী সম্বন্ধে সত্য কথা বলা
বিপজ্জনক। যেদিন তাঁর মৃত্যু হবে সেদিন তিনি একটি পা কবরের মধ্যে রেখে নারী
সম্বন্ধে সত্য কথাটি নির্ভয়ে বলবেন। তাড়াতাড়ি আর-একটি পা কবরের ভিতর টেনে
নিয়ে ধপ করে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়বেন। সঙ্গে সঙ্গে শেষ নিঃশ্বাস ফেলবেন।
দুঃখের বিষয় তাঁর মৃত্যুর কয়েকদিন আগেই তিনি সংজ্ঞা হারান। মনের কথাটা মনেই
থেকে যায়।
‘আনা কারেনিনা’ বিশ্লেষণধর্মী রচনা। তখনকার দিনের পক্ষে
ব্যতিক্রম। তা হলেও নরনারী সম্পর্কের উপর নির্ভয়ে আলোকপাতের অনুকূল ছিল না।
মেনটালের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে এলিমেন্টাল স্তরে পৌঁছেছিলেন। যেকথা বলি বলি
করে বলতে সাহস হলো না সেকথা বোধহয় এলিমেন্টাল।
উপন্যাসটির চাবী নিহিত
রয়েছে বাইবেল থেকে উদ্ধৃত সেই উক্তিটিতে যেটি মুদ্রিত হয়েছে ‘আনা কারেনিনা’
নামটির নিচে। তার মর্ম “প্রতিশোধ আমারই। আমিই অন্যায়ের শোধ নেব।” অর্থাৎ
দন্ডদানের কর্তা ঈশ্বর স্বয়ং। দন্ড দিতে হয় তিনিই দেবেন। দেবেন যথাকালে
যথানিয়মে। মানুষ মানুষকে দন্ড দিতে পারে না। কারেনিন আনাকেও না। আনা
ভ্রনস্কিকেও না। বাইবেলে আছে-“উবধৎষু নবষড়াবফ, ধাবহমব হড়ঃ ুড়ঁৎংবষাং; নঁঃ
ৎধঃযবৎ মরাব ঢ়ষধপব ঁহঃড় ৎিধঃয; ভড়ৎ রং ঃরং ৎিরঃঃবহ, ঠবহমবধহপব রং সরহব; ও
রিষষ ৎবঢ়ধু, ংধরঃয ঃযব খড়ৎফ. ঞযবৎবভড়ৎব রভ ঃযরহব বহবসু যঁহমবৎ, ভববফ যরস:
রভ যব ঃযরৎংঃ, মরাব যরস ফৎরহশ: ভড়ৎ রহ ংড় ফড়রহম ঃযড়ঁ ংযধষঃ যবধঢ় পড়ধষং ড়ভ
ভরৎব ড়হ যরং যবধফ. ইব হড়ঃ ড়াবৎপড়সব ড়ভ বারষ, নঁঃ ড়াবৎপড়সব বারষ রিঃয মড়ড়ফ.”
(ঘবি ঞবংঃধসবহঃ, জড়সধহং, ঈযধঢ়ঃবৎ ১২, াবৎংবং. ১৯-২১)
এই বই লেখার সময়
টলস্টয়ের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। সাংসারিক সাফল্যে তাঁর বৈরাগ্য এসেছিল।
তিনি খুঁজছিলেন জীবনের অর্থ। যা না পেলে জীবন বৃথা। একটু একটু করে তিনি
ঝুঁকছিলেন খ্রীস্ট ধর্মের দিকে। কিন্তু গির্জার দিকে নয়। অন্যান্য ধর্মের
প্রতি তাঁর দৃষ্টি ছিল। ধীরে ধীরে তিনি এই প্রত্যয়ে পৌঁছন যে, হিংসার উত্তর
প্রতিহিংসা নয়, অহিংসা। আঘাতের উত্তর প্রত্যাঘাত নয়, ক্ষমা। অনিষ্টের
উত্তর পাল্টা অনিষ্ট নয়, উপকার। ভ্রষ্টাতার উত্তর বর্জন নয়, করুণা। পাপের
উত্তর সাজা নয়, অন্যায়ের উত্তর প্রতিশোধ নয়, শত্রুকে তার ক্ষুধার অন্ন
তৃষার জল যোগানো। মন্দের উত্তর প্রতিরোধ নয়, অপ্রতিরোধ।
এই উপন্যাসের
অন্যতম প্রধান লেভিন। সে যেন বত্রিশ তেত্রিশ বছর বয়সের টলস্টয়। জীবিকার
চেয়ে জীবনকে নিয়েই সে ভাবিত। তার জীবন পরিশেষে অর্থবান হয়, তার অন্তর হয়
নতুন অনুভূতির দ্বারা আপ্লুত। তাকে ভালো হতে হবে, ভালো কাজ করতে হবে, তার
জীবনকে ভালো দিয়ে ভরে দিতে হবে। লেভিনের মতো টলস্টয়ের জীবনও ভালোর দিকে মোড়
নয়। সেই বয়সে নয়, আরো পরিণত বয়সে। ‘আনা কারেনিনা’ লিখতে গিয়ে তিনি লেভিনের
কলমে নিজের ধর্মীয় অনুভূতির কথাও লিপিবদ্ধ করেন। আনা ও ভ্রনস্কির কাহিনী
ফুরিয়ে যাবার পরেও লেভিনের কাহিনীর রেশ থাকে। আর্ট নয়, মরালিটি নয়,
মনস্তত্ত্ব নয়, ধর্মীয় উপলব্ধির উপরেই যবনিকা পড়ে। লেভিনের তথা টলস্টয়ের
অন্তঃপরিবর্তন এ গ্রন্থের উপসংহার। এখন থেকে তিনি ঋষি টলস্টয়।।
লেখক, গবেষক ও অনুবাদক
julfikarnewton@gmail.com
