বৃহস্পতিবার ৬ নভেম্বর ২০২৫
২২ কার্তিক ১৪৩২
পর্যটন শিল্প-অবারিত সম্ভাবনার হাতছানি
মোহাম্মদ মাসুদ রানা চৌধুরী
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর, ২০২৫, ১২:৪৭ এএম আপডেট: ০৬.১১.২০২৫ ১:৪৭ এএম |

 পর্যটন শিল্প-অবারিত সম্ভাবনার হাতছানি
মানুষের চিরায়ত ও নিরন্তর আগ্রহ হচ্ছে অজানাকে জানা, অদেখাকে দেখা। এ থেকেই মানুষের মাঝে ভ্রমনের আগ্রহ জন্মায়, পর্যটক হওয়ার বাসনা তৈরি হয়। যাপিত জীবনের ব্যস্ততা আর ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে ভ্রমণ একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে । ভ্রমণ মনকে উৎফুল্ল করে তোলে মানুষের জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করে। বলা হয়ে থাকে ভ্রমণ নিজের মধ্যে একটি বিনিয়োগের মতো, কেননা, চাকরি আপনার পকেট ভরে কিন্তু ভ্রমণ আপনার আত্মাকে পূর্ণ করে। ভ্রমণ নতুন পরিবেশ এবং নতুন অভিজ্ঞতার সাথে পরিচয় করায়। তাই তো দিনকে দিন ভ্রমণ পিপাসুরা এক টুকরো প্রশান্তির জন্য নতুন নতুন জায়গায় ছুটছেন। ভ্রমণ আমাদের স্বাস্থ্যের জন্যও বেশ উপকারি।  প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সাথে সাথে বিশ্বজুড়ে দূরত্ব সংকুচিত হয়ে আসলেও, মানুষের মাঝে অন্য দেশকে, অন্য দেশের সংস্কৃতিকে জানার আগ্রহ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। পর্যটনের সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে একে আরও প্রাণবন্ত, স্বাচ্ছন্দ্যময়, পরিবেশবান্ধব করবার সুযোগ তৈরী হয়েছে। 
আধুনিক পৃথিবীতে ভ্রমণ পরিণত হয়েছে এক বিশাল অর্থনৈতিক শক্তিতে, যা মানুষকে আনন্দ প্রদানের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকেও গড়ে তুলছে। বিশ্ব জুড়ে অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্প/খাতের অবদান দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনৈতিক খাত হয়েছে উঠেছে পর্যটন অর্থনীতি। ভ্রমণের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে পর্যটকেরা বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব রাখেছেন। একজন পর্যটক যখন কোনো নতুন দেশে ভ্রমণে যান, তখন শুধু ইতিহাস বা প্রকৃতির সৌন্দর্যই নয়, সেই দেশের ব্যাংক, হোটেল, রেস্তোরাঁ, এয়ারলাইন্স, স্থানীয় বাজারে প্রভাব ফেলে আর এর মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে পর্যটন খাত। পর্যটন একটি শ্রমঘন শিল্প। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার সূত্রমতে, ২০২৪ সালে বিশ্ব অর্থনীতির ১০ শতাংশ দখলে রেখেছে পর্যটন শিল্প। অর্থের হিসেবে প্রায় ১১ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্ব পর্যটন খাতে ৩ কোটি ৪৮ লক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই খাতে কর্মসংস্থানের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে, কারণ পর্যটকদের চাপ সামলাতে আরও বেশি কর্মীর প্রয়োজন হচ্ছে।  বিশ্ব ভ্রমণ ও পর্যটন কাউন্সিলের প্রতিবেদন মতে, ২০৩৩ সালের মধ্যে পর্যটন শিল্পের অবদান হবে ১৫.৫ ট্রিলিয়ন ডলার এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে এই খাতের হিস্যা দাঁড়াবে ১১.৫ শতাংশে।
বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে, যাদের অর্থনীতি মূলত পর্যটনের ওপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। গুরুত্বের বিবেচনায় এটি অন্যতম অগ্রাধিকার খাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বিশ্ব ভ্রমণ ও পর্যটন কাউন্সিলের প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ২০২৪–২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর কয়েকটি দেশ এই খাতে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জার্মানি, জাপান, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, মেক্সিকো, ভারত, ইতালি ও স্পেন-এরা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পর্যটন অর্থনীতি। ২০২৪ সালের হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র পর্যটন খাত থেকে আয় করেছে প্রায় ২.৩৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা পৃথিবীর যেকোনো দেশের তুলনায় সর্বাধিক। চীনের পর্যটন অর্থনীতি এখন প্রায় ১.৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান। জার্মানির পর্যটন খাতের অবদান প্রায় ৪৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পর্যটক যে দেশে যায়, সেটি হলো ফ্রান্স। জিডিপির প্রায় ৮-৯.৭% পর্যটন খাতের দখলে। ২০২২ সালে ফ্রান্স সরকার এ খাত থেকে  আয় করেছিল ৫,৮০০ কোটি ইউরো এবং ২০২৪ সালে ১০ কোটির বেশি আন্তর্জাতিক পর্যটক ফ্রান্সে ভ্রমণ করেছেন। এই শিল্পটি ফ্রান্সে প্রায় ২.৯ মিলিয়ন কর্মসংস্থানও তৈরি করেছে। ২০২৪ সালে স্পেনের অর্থনীতিতে পর্যটন খাতের অবদান দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৪ সালে ভারতের পর্যটন খাতের আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্ব ভ্রমণ ও পর্যটন কাউন্সিলের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী দশকের মধ্যে ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম পর্যটন অর্থনীতিতে পরিণত হবার সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে। ভারত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ ২০২২ সালে পর্যটকদের কাছ থেকে আয় করেছে জিডিপি’র প্রায় ৬৮ শতাংশ। সে বছর ১৭ লাখের বেশি মানুষ মালদ্বীপ ভ্রমণ করেছেন। এ জন্য তাঁরা ৪২০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করেছেন। নেপালের অর্থনীতিতে পর্যটন খাত বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম প্রধান উৎস। পর্যটন খাত নেপালে  জিডিপি’র প্রায় ৮% আয় করে এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাত থেকে মোট প্রায় ৫৪৮ মিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন গন্তব্য। দেশি-বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের জন্য সকল ধরনের উপাদান বাংলাদেশে বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশকে বলা যেতে পারে ইকো ট্যুরিজমের স্বর্গরাজ্য! বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, সিলেটের চা বাগান, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটা, নয়নাভিরাম সেন্টমার্টিন, রাঙামাটির কাপ্তাই লেক ও অন্যান্য পর্যটন স্পট, বান্দরবানের সাজেক ভ্যালি, নীলগিরি, চিম্বুক পাহাড়, খাগড়াছড়ির আলুটিলা গুহা, সিলেটের বিছানাকান্দি ও রাতারগুল, নোয়াখালীর নিঝুম দ্বীপ, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, চলনবিল, মহাস্থানগড়, মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া বন, সাফারি পার্ক, পাহাড়পুর, ময়নামতি, উয়ারী বটেশ্বর, ষাট গম্বুজ মসজিদসহ বিভিন্ন পর্যটন এলাকা পর্যটনের জন্য বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটনশিল্প ৩.০২% অবদান রাখছে, যার পরিমাণ ১৭ বিলিয়ন ডলার; এবং এ খাতে বাংলাদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫১ লক্ষ ৩১ হাজার, যা মোট কর্মসংস্থানের ৮.০৭%। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা ৩ কোটি ছাড়িয়েছে।
পর্যটন খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্বের টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখা সম্ভব। আবার পর্যটনের প্রকৃত উন্নয়নের জন্য টেকসই বিনিয়োগের বিকল্প নেই। দায়িত্বশীল পর্যটন সামাজিক অগ্রগতি, শিক্ষার বিস্তার, কর্মসংস্থানসহ নানাবিধ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচনের শক্তি রাখে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে পর্যটন উন্নয়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ ও মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করা আবশ্যক। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত প্রচেষ্টায় পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব। প্রকৃতি-পরিবেশের উপর গুরুত্ব দিয়ে ইকো-ট্যুরিজম বিস্তারের মাধ্যমে পর্যটকের সংখ্যা যেমন বাড়নো যাবে তেমনি জীববৈচিত্র্য ও রক্ষা করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির আয় বৃদ্ধি ও উন্নততর জীবনধারার প্রতিফলন পর্যটনের প্রতি মানুষের আগ্রহ দিনদিন বাড়ছে। অভ্যন্তরীণ পর্যটন উন্নয়নের মাধ্যমে পর্যটন একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সেক্টরে পরিণত হবার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।  
পর্যটন শিল্পে অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক রূপান্তরের একটি শক্তিশালী অনুঘটক। পর্যটন শিল্প মোটা দাগে পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন-এই চারটি স্তম্ভের উপর নির্ভরশীল। পর্যটনের আসল শক্তি শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয়, বরং মানুষকে একে অপরের কাছে আনার মাধ্যমে এক দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রকৃতি-কে সামনে তুলে ধরে। বর্তমানে মেডিকেল ট্যুরিজম, পবিত্র স্থান ভ্রমণ, ব্যাবসা কাজের ফাঁকে অন্য দেশ ভ্রমন, বিভিন্ন সেমিনার অংশগ্রহণের সাথে ভিন দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্হান ঘুরে দেখা,  যাদুঘর পরিদর্শন ইত্যাদি প্রবণতা বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত স্বপ্নবান তরুণ প্রজন্ম পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনায় নতুন সম্ভাবনা দ্বার খুলে দিচ্ছে। তরুণদের অনেকেই অল্প পুঁজি নিয়ে উদ্যোক্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তরুণরা ট্যুর গাইড,  ট্যুরিজম ব্লগার, ট্যুরিজম ফটোগ্রাফার, ভিডিওগ্রাফার, কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে কাজ করছে। পর্যটনশিল্প তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটি গেটওয়ে হিসেবে কাজ করছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দেশি-বিদেশি পর্যটন সংস্থা ও উদ্যোগের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ হতে পারে বিশ্ব পর্যটকদের কাছে একটি আদর্শ পর্যটন গন্তব্য।
লেখকঃ পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।













http://www.comillarkagoj.com/ad/1752266977.jpg
সর্বশেষ সংবাদ
আনন্দযাত্রা পরিণত হলো চিরবিদায়ে
কুমিল্লায় ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে বিএনপি
কুমিল্লা-১০ আসনে রেলপথ ও মহাসড়ক আটকে বিক্ষোভ
বাংলাদেশ তালীমে হিযবুল্লাহ, বাংলাদেশ ইসলামি যুব কাফেলা ও বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র কাফেলা কুমিল্লা মহানগর শাখার পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত হয়
দেবিদ্বারে ভূয়া নির্বাচনে সমিতির কমিটি গঠন: তদন্ত কমিটি গঠন জেলা সমবায় অফিসের
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
শিশু মীমকে হত্যার পর জানাজা দাফনেও অংশ নেয় ঘাতক
বিএনপি নেতা এরশাদ উল্লাহর সঙ্গে গুলিবিদ্ধ সরোয়ার বাবলার মৃত্যু
বিএনপির মনোনয়ন বঞ্চিত হাজী ইয়াছিন সমর্থকদের মশাল মিছিল
চট্টগ্রামে বিএনপির প্রার্থী নির্বাচনী জনসংযোগে গুলিবিদ্ধ
রামমালা গ্রন্থাগার ডিজিটালাইজেশন উদ্যোগ নেওয়া হবে: তথ্য উপদেষ্টা
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২