
গ্রামীণ
উন্নয়ন তখনই অর্থবহ হয় যখন স্থানীয় মানুষ এবং প্রশাসন প্রকল্পগুলোতে
সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং
ক্ষমতার স্থানীয়করণ গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। বিশ্বব্যাংকের মতে,
বিকেন্দ্রীকরণের মূল ধারণা হলো কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকা ক্ষমতা স্থানীয়
স্তরে স্থানান্তরিত করা। স্থানীয় জনগণ এবং জনপ্রতিনিধিরা তাদের বাস্তব
অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রকল্প নির্ধারণ করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, একটি গ্রামের সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের ক্ষেত্রে স্থানীয়
প্রয়োজন বোঝার ক্ষমতা জেলা প্রশাসনের চেয়ে অনেক বেশি। এর ফলে প্রকল্প
কার্যকর, প্রাসঙ্গিক এবং দীর্ঘমেয়াদী টেকসই হয়।
কিন্তু বাস্তবতা সবসময়
আদর্শের সঙ্গে মিলে না। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা আগে সংসদীয় আসন ১০-এর
উদাহরণ স্পষ্ট। সেখানে সংসদ সদস্য ছিলেন একজন অর্থনীতিবিদ এবং সাবেক
অর্থমন্ত্রী। তবুও কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক অক্ষমতার কারণে গ্রামের
সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন বাস্তবে কম দেখা গেছে। সংসদ সদস্য নানবিদ
ব্যস্ততায় সংসদীয় আসনে সেভাবে সময় দিতে পারেননি কিংবা দেয়ার প্রয়োজন মনে
করেননি। এর ফলে সাধারণ জনগণের সঙ্গে সরকারের এ স্টেকহোল্ডারের একটা দূরত্ব
তৈরি হয়েছিল। লুটপাটের রাজনীতি এবং পদবিভাগের আর্থিক অভিযোগ সাধারণ
নাগরিকদের মধ্যে বিরক্তি তৈরি করেছে, যার ফলে তারা রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে
অনেকাংশে বঞ্চিত হয়েছেন। উদাহরণ টেনে বলা যায়, সুয়াগাজী বাজারের পূর্বপাশের
ইউনিয়ন ০৬নং পূর্ব জোড়কাননের কথা। এ প্রত্যন্ত অঞ্চলটি ঢাকা চট্টগ্রাম
মহাসড়কের পাশে হলেও তার সব কটি বাড়িতে এখনো পৌঁছায়নি রান্নার গ্যাস সংযোগ।
ঝুঁকিপুর্ণ স্থানে স্থাপন হয়নি সৌরবিদ্যুতের খুঁটি। গ্রামের রাস্তাগুলোর
অবস্থাও অনেকটা ছিল সংকীর্ণ। কিন্তু স্থানীয় সরকারের পূর্ববর্তী বাজেট
দেখায় ভিন্ন চিত্র। অর্থাৎ, কাজের আগেই ভোগ দখল শেষ। উক্ত এলাকায়
বিরোধীদলীয় স্টেকহোল্ডারদের মতামত নেয়ার ও প্রয়োজন মনে হয় নি। ফলে প্রকৃত
গণতন্ত্রের চর্চা ব্যাহত হয়েছে বলেই এর ক্ষতিকারক প্রভাব পড়েছেন স্থানীয়
পর্যায়ে। স্বজনপ্রীতির মত আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে
তাঁদের হাতেই ক্ষমতা থাকে। ফলে এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে গ্রামীণ
রাস্তাগুলোতে অবাদে পরিচালনা করা হয় মাটি কাটার ট্রাক চলাচলের কাজ। যার
প্রভাবে নির্মিত বা নির্মাণাধীন রাস্তাগুলো তাঁদের স্বকিয়তা হারায়।
সাবেক
উপজেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় সরকারের অক্ষমতাও লক্ষ্য করা যায়। উপজেলা
নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপের অধীনে থাকায় তার
স্বতন্ত্র কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ফলে ইউএনও হিসেবে তার
যে উদ্যোগ বা সক্রিয়তা ছিল, তা যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়নি। যদি জেলা,
উপজেলা এবং স্থানীয় সরকার প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতারা দলমত নির্বিশেষে
দায়িত্বশীলভাবে কাজ করতেন, তবে অবকাঠামোগত উন্নয়নের সুফল মানুষের কাছে
স্পষ্ট হতো এবং রাজনৈতিক প্রভাবও ইতিবাচক হতো। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে
রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ববোধের গুরুত্ব স্পষ্ট। স্থানীয় সরকার ও
রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিমূলক পদক্ষেপ ছাড়া উন্নয়নের পথ
বন্ধ এবং অস্থিরতা তৈরি হয়। সুতরাং, ভবিষ্যতে যেসব ব্যক্তি বা দল স্থানীয়
সরকার ও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবে, তাদের অবশ্যই সচেতন ও
কার্যকর হতে হবে। শুধুমাত্র প্রকল্প বাস্তবায়ন নয়, বরং মানুষের ক্ষমতায়ন
এবং দীর্ঘমেয়াদী সুফল নিশ্চিত করাই হবে মূল লক্ষ্য।
সর্বোপরি, রাজনৈতিক
বিকেন্দ্রীকরণ, সচেতন স্থানীয় সরকার, দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং
সুশীল সমাজ একসাথে কাজ করলে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন শুধু সম্ভাবনা নয়,
বাস্তবতায় পরিণত হবে। গ্রামের মানুষ তখন প্রকৃত অর্থে উন্নয়নের অংশীদার
হবে, আর উন্নয়নের ছোঁয়া পৌঁছাবে প্রত্যেকের জীবনে।
লেখক: প্রধান, জনসংযোগ বিভাগ, আশা ইউনিভার্সিটি।
