
বাংলা 
সাহিত্যে রবীন্দ্রবলয় থেকে বের হয়ে আলাদা ও মৌলিক যে দু’জন কবি- তারা হলেন-
 নজরুল ও জীবনানন্দ দাশ।  জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলার মাটি, ফুল, ফল, 
প্রকৃতি-নদী ও বৃক্ষলতা ভেসে উঠেছে প্রাণবন্তভাবে। তিনি হৃদরের গভীর থেকে 
গভীরে প্রচণ্ডরকম নাড়া দিয়ে উচ্চারণ করলেন ঃ-
‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি,
তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’।
তিনি
 আবেগ ও অনুরাগের সংমিশ্রণে দেশ প্রেমের যে ঢেউ তুলে ধরেছেন । এই  প্রবাহ 
বয়ে চলবে  আনাগত কালের পরিক্রমায়। কবিতাটি প্রসঙ্গে বায়রণ বলেছেন- 
ঙহব ভরহব সড়ৎহরহম ও ড়িশব ঁঢ় ধহফ ভরহফ সুংবষভ ভধসড়ঁং!
১৯৩০
 এর দশকে বাংলা সাহিত্যে যে সমস্ত কবি উজ্জ্বল আলোয় প্রকাশিত ছিলেন, 
জীবননান্দ দাশ তাঁদের অন্যতম। ৩০ এর দশকের পরবর্তীতে বাংলা কাব্যের যে কোনো
 আলোচনা  তাঁকে বাদ দিয়ে অসম্ভব।  কবি জীবনানন্দ দাশের অন্যতম দিক হচ্ছে 
তিনি ছিলেন নির্জনের নির্ঝর। তাঁর চিত্তের  সর্বোতমূখী বিচরণ ছিল। আকাশ, 
মাটি, কাক, কূয়াশা ও ভূগোল এসবের  বিচিত্র সমাবেশ ছিল কবিতার মূল 
প্রতিপাদ্য বিষয়।
বাংলা সাহিত্যে যে কয়জন অতি মেধাবী কবি দেখতে পেয়েছি। 
জীবনানন্দ দাশ তাঁদের অন্যতম। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করে 
এ-পাড় বাংলা- ওপাড় বাংলায় অনেকগুলো কলেজে অধ্যাপনা  করেছেন। না, তিনি কোনো 
কলেজেই স্থির হতে পারেননি। অধ্যাপনা থেকে অপসারণ হয়েছেন। বেকার থেকেছেন, 
ব্যবসা করেছেন, ব্যবসায় সফল হতে পারেননি। এই যে না পারাটা-ই জীবনানন্দ 
দাশকে নির্জন পিয়াসী মানুষ হিসেবে বিশেষত্ব দিয়েছেন।
জীবনানন্দ দাশ তাঁর
 সমকালীন প্রবাহে অনেকটা অপ্রকাশিত ছিলেন। সময়ের প্রতিটি পরতে পরতে অবহেলিত
 ছিলেন। অন্যসব কবিদের আড্ডা থেকে নিজেকে আড়ালে রেখে নির্জনে-নিভৃত্যে 
ছিলেন ঠিকই। কিন্তু তিনি পরগাছা বা  বনসাই হয়ে কবিতা লিখেন নি। তাঁর শিল্পী
 সত্ত্বা ও মানব সত্ত্বার শিকড় প্রিয় স্বদেশের নরম মাটির গভীরে প্রোথিত 
ছিল। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চ শিক্ষিত এবং বড় বড় কলেজে অধ্যাপনা ও 
করেছেন। বিশেষ দিক হচ্ছে যে, তিনি পশ্চাত্য সাহিত্য ও আধুনিক সাহিত্যের 
সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। কবির দৃষ্টি ছিল বৈশি^ক ও সীমাহীন আকাশের 
দিকে। কিন্তু পা ছিল দেশের মাটিতে। 
তাঁর  সমকালীন যারা বিখ্যাত কবি ও 
লেখক ছিলেন, তারা হলেন- সমরসেন, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, প্রেম মিত্র
 ও সুকান্ত ভট্টাচার্য। তারা ঐ সময়ে বিদেশের প্রভাবে প্রভাবিত ছিলেন। 
জীবনানন্দ দাশ ও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তারও বিদেশী সাহিত্যের প্রতি দৃষ্টি 
ছিল। কিন্তু তাদের সাথে জীবনানন্দ দাশের দারুণ পার্থক্য ছিল। জীবনানন্দ দাশ
 দেশের মাটিকে সার্বজনীন হিসেবে ভালোবেসে কবিতায় প্রকাশ করলেন-
 তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও-
আমি এই বাংলার পাড়ে রয়ে যাব
দেখিব কাঁঠাল পাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে
চলে যায় কুয়াশায়- তবু জানি কোনোদিন পৃথিবীর ভীড়ে
হারাব না তারে আমি- সে যে আছে আমার এ- বাংলার তীরে।
কবি
 জীবনানন্দ দাশের আদিবাস ছিল বিক্রমপুরের পদ্মাপাড়ে ‘গাউপাড়া গ্রামে। কবির 
স্মৃতি বিজরিত  গ্রামটি এখন আর নেই।  রাক্ষসী পদ্মা গিলে ফেলেছে। দাশ 
পরিবারটি ঐতিহ্যগতভাবে সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠা পরিবার। পরিবারটি 
ব্রাদ্মধর্মগ্রহণ করে বিক্রমপুর  থেকে বরিশালে চলে যান।
কবি জীবনানন্দের
 পিতা সত্যানন্দ তখনকার সময়ে উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন। বরিশাল ব্রজমোহন উচ্চ 
বিদ্যালয়ের  দীর্ঘ সময় প্রধান শিক্ষক ছিলেন। প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন 
বরিশাল শহর থেকে ব্রাম্ম সমাজের মুখপত্র ‘ব্রাম্মবাদী’ পত্রিকার সম্পাদক 
ছিলেন। জীবনানন্দের পিতা তাঁর-কর্মে, সমাজে, সাহিত্যে, রাষ্ট্রে ও পরিবারের
 মোহজড়তা থেকে মুক্ত হয়ে দার্শনিক  হয়ে উঠেছিলেন। এইটা জীবনানন্দ দাশের উপর
 যেমন প্রভাব পড়েছিল, তেমনি আরও বেশি প্রভাব পড়েছিল তাঁর মা- কুসুম কুমারীর
 সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে।
বরিশালের মেয়ে মা কুসুম কুমারী উত্তরাধীকার সূত্রে
 কবিত্ব প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। এর পেছণে যথেষ্ট উদাহরণ আছে। একটি 
হচ্ছে-কুসুম কুমারীর পিতা চন্দ্রনাথ নিজেও কবি ছিলেন।  কুসুম কুমারী তখনকার
 বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা লিখতেন। বিশেষ করে শিশুতোষ কবিতার জন্য তিনি 
বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর একটি কবিতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মানুষের মুখে মুখে 
উচ্চারিত হয় ঃ-  
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।
বাংলা 
 সাহিত্যে যদি সকল কবিদের মায়েদেরকে একসাথে উপস্থাপন করি, তবে জীবনানন্দ 
দাশের ‘মা’ ই  সেরাদের সেরা।  একথাটি নিশ্চিত করে বলা যায়।  মায়ের কবিতা 
প্রসঙ্গে কবির মূল্যায়ন হচ্ছে যে,
একটি শান্ত অর্থঘন সুষ্মিত ভোরের আলো, শিশির লেগে রয়েছে যেন এসব কবিতার শরীরে, সে-দেশ মায়েরই স্বকীয় ভাবনা- কল্পনার স্বীয় দেশ।
কবিকে
 বড় মানুষ হওয়ার জন্য তাঁর মা দেশ- বিদেশের মহাপুরুষদের তালিকা দিয়ে 
বলেছিলেন, তাঁদের মতো বড় হও বাবা”। এছাড়া তিনি আরও পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, 
যেকোনো তুচ্ছ মানুষকে শ্রদ্ধা ও বিশ^াস করতে। কবির উপলব্ধি থেকে বলেছিলেন 
এখন বুঝেছি, আমার মা কুসুম কুমারী ঠিকই বুঝেছিলেন। মায়ের সম্পর্কে কী 
প্রতিভা সুলভ কথা কবির মনোভাবে ফুটে উঠেছে। যা বর্ণনা করা যথেষ্ঠ কঠিন।
সত্যানন্দ
 ও কুসুম কুমারীর বড় সন্তান ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। পারিবারিক পরিমণ্ডলে 
স্বাধীন ও স্বতঃস্ফুর্তভাবে তিনি নিজে শিশু শিক্ষাটা পেয়েছিলেন মা-বাবার 
কাছ থেকে। কবি জীবনানন্দ দাশ কবি হয়ে উঠার পেছনে উল্লেখযোগ্য দিকগুলোর 
মধ্যে একটি হচ্ছে- তিনি শৈশবে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা মা-বাবা, ঠাকুরমা এবং 
পরিবারের অন্যান্যদের  কাছ থেকে দেশ-বিদেশ, নদী-পাখি ও বিচিত্র ধরণের গল্প 
শুনে শুনে ভিতরে সাহিত্য ও  সংস্কৃতির বীজ বপন করতে পারা । জীবনের  
মধ্যাহ্ন পেরিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে  বলেন, কার কাছ থেকে তিনি শিক্ষা 
পেয়েছিলেন? আমি অন্তত তিনজন মানুষের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছিলাম।  একজন 
বাবা, একজন মা, আরেকজন ব্রজমোহন স্কুলের প্রধান শিক্ষক জগদীশ চন্দ্র  
মুখোপাধ্যায়। তিনি স্বীকার করে নিয়ে বলেছিলেন যে,  এক এক সময়ে মনে হয়, মহা 
ভারতের রচনাকর্তা বেদব্যাসের মতো  দৃষ্টি নিয়ে এরা সবই শিখিয়ে ছিলেন আমাকে।
 আমার জীবনে সে শিক্ষা যদি ব্যবহারিকভাবে ফলপ্রসু না হয়ে থাকে, তাহলে 
তাঁদের কোনো দোষ নেই; যদি মনলোকে কিছু সার্থক হয়ে থাকে, তাহলে এঁদেরই 
প্রকাণ্ড দানের ফলে।
জীবনানন্দ দাশ কবি খ্যাতির পাশাপাশি খুব ভালো ছাত্র
 ছিলেন। বিশেষ গুণ ছিল যে, তিনি পরীক্ষার বাহিরে নানা বিষয়ে গভীরভাবে 
অধ্যয়ন করতেন। জীবনের শেষ প্রহর পর্যন্ত নানা বিষয়ে গভীরভাবে পড়তেন । 
লিখতেন রাতের শেষপ্রহর পর্যন্ত। নিজের সন্তানদের লেখাপড়া ও মনোবলের যথেষ্ট 
ঘাটতি থাকায়, কবির মনে গভীর বেদনা সঞ্চারিত হতো।  ব্যথিত মনে নিরাশার 
দুঃখবোধ থাকলেও সন্তানদের প্রতি ছিল স্নেহপ্রবণ একজন পিতা হিসেবে।
শত 
প্রতিকূলতা ব্যক্তি জীবনে প্রবাহিত হলেও কাব্যিক জীবনে তিনি ছিলেন অবিচল।  
তিনি ছিলেন প্রকৃতির কবি।  ফুল, লতা, ঘাস, আমের মুকুল, নারকেলের সবুজ পাতা,
 কাক ও ভোরের কুয়াশা, সোনালী-ধানের গন্ধেভরা বাতাস, মরা গাঙের আইল, কাশের 
বন, ধানের ক্ষেতে আলো ছায়ায় লুকোচুরির খেলা তাঁর মনে সৃষ্টি হতো প্রকৃতির 
বিষ্ময়কর সৌন্দর্যের নীলাভ ভালোবাসা। বাংলার নরম মাটি, জলজ বাতাসের ঘ্রাণ, 
কলমি লতার দোলন কিংবা হিজলের বর্ষার রূপ ও কাঠাল ছায়ার তপ্ত দুপুরের আবহ 
ছেড়ে তিনি কোথাও যেতে চাননি। তাইতো তিনি বাংলার সরলণপ্রাণ মানুষদেরকে কবি 
কণ্ঠের আশ^াস দিয়ে লিখেছেন- 
আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-
এই বাংলায়
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেতে ভালোবেসে
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে
দেখিব ধবল বক- আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।
কবির
 অনুরাগের প্রেমময় দৃষ্টি কতটা সহজ- সরল, কতটা দেশপ্রেম লালন করলে, সুললিত 
শব্দের সমাহারে কবি জীবন্ত ছবি হয়ে আছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মানুষের  
ভালোবাসার গহীন থেকে গহীনের ভিতর।  শুধু গাছ-পালা তরুলতা-ই নয়, পাখিদের 
উড়াউড়ির দৃশ্য ও তাঁকে ব্যাকুলিত করেছে।ধবল বকের সাথে নিবিড় কথোপকথনে দেখতে
 পাই-
‘ধবল বক আমারেই পাবে তুমি হইাদের ভীড়ে’।
 কবির ভালোবাসার জায়গাটা কতটা নিষ্কামও পবিত্র ছিল যে, ধবল বকের প্রতি মায়াবী আশ^াসই প্রমাণ করে। 
 জীবনানন্দ
 দাশের কবিতায় শুধু প্রেমও প্রকৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কবিতায় বিষণ্নতা 
আছে, অস্তিত্বের যন্ত্রণাও আছে। আশার কথা হচ্ছে- প্রবল আশাবাদ এবং উত্তরণের
 ইঙ্গিত ও আছে। পূর্বাশার দুয়ারে তরুণ- অরুণের আভাও আছে। প্রিয়তমা স্ত্রী 
লাবণ্য দাশের প্রতি পরোক্ষ ইঙ্গিত করে লিখেছেন-
ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে
অবহেলা করে আমি দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে
ঘৃনা করে দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে...।।
আরেকটি কবিতায় তিনি লিখলেন-
হায় চিল, সোনালি ডানার চিল
এই ভিজে মেঘ দুপুরে
তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে- উড়ে ধান সিঁড়ি নদীটিরপাশে।
মেঘের
 দুপুুরের সাথে জীবনানন্দ দাশের ছিল গভীর একাত্মতা। একাকিত্ব, শূন্যতা, 
বিষণ্নতা এবং অস্তিত্বের যন্ত্রনাই ছিল তাঁর কাব্যের মূল সুর। বিশেষ করে 
তিনি নির্জনতা ও একাকিত্বকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। 
প্রত্যেক বড় কবিরই  
একটি বিশেষ প্রতিভা থাকে। জীবনানন্দ দাশ এর ব্যতিক্রম নয়। কারণ নিজের  জগতে
 সে আক্ষরিকভাবে সিদ্ধ। এটা প্রতিটি লেখায় প্রমাণিত হয়েছে। তাঁর অর্জন 
কাব্য-সৃষ্টির ভিতরে। প্রতিভা-ই তাঁকে কবি বানিয়েছে।  শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনে
 তিনি দারুণভাবে সিদ্ধ। অন্য কোথাও তাঁর সিদ্ধতা যাচাই করার প্রয়োজন আছে 
বলে মনে করি না। কারণ কবি জীনানন্দ দাশ তাঁর অসীম প্রতিভার সঙ্গে ভাবের 
মিলন ঘটিয়েছেন, কবিতার নিজস্বতা দিয়ে বার বার প্রমাণ করেছেন। তিনি তো অকপটে
 বলেছেন- “সবায় কবি নয় কেউ কেউ কবি”।
জীবননান্দ দাশের জীবন ও কর্মের নান
 প্রবাহে গভীরভাবে বিচরণ করে  মনের ভেতর একটি জিজ্ঞাসা তৈরি হয়েছে, সেটি 
হচ্ছে- কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা আমাদের জীবনের পক্ষে সত্যই কি প্রয়োজন? 
কেন প্রয়োজন? মানুষের সামাজিক জীবন ও ব্যক্তিগত জীবনকে সর্বাঙ্গীন ও সুখের 
আখরে গড়ে তুলতে তাঁর কবিতার স্থান কোথায়?
হ্যাঁ কবি জীবনানন্দ দাশের 
সৃষ্ট শুধু কবিতাই নয়, তাঁর সৃষ্ট গল্প- উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে যে জায়গা 
তৈরি করেছে- তা অনাগত দিনে বাঙালির মানসúটে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চায়, বাংলার 
প্রকৃতি ও নৈসর্গিক দৃশ্য ভেসে বেড়াবে  মানব থেকে মানব হৃদয়ে। 
কবির 
জীবদ্দশায় তিনি অনেকটা অপ্রকাশিত-ই ছিলেন। লোক চক্ষুর অন্তরালে আড়ালে- 
আবডালে বিচরণ করতে তিনি অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিলেন। জীবদ্দশায় কবির প্রকাশিত 
কাব্য গ্রন্থের সংখ্যা মাত্র সাতটি। মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে- রেখে যাওয়া 
পান্ডুলিপিগুলো প্রকাশ শুরু হলেও তাঁর প্রথম উপন্যাস মাল্যবান প্রকাশিত হয় 
প্রয়াণের উনিশ বছর পর। কবি জীবনানন্দ দাশ বিশ^াস করতেন প্রতিভার কাছে  
কবিকে বিশ^স্ত থাকতে হবে। কবিতা লেখার সময় মাথায় ঘুরপাক খেত একটি কথা, সে 
কথাটি হচ্ছে- হয়তো কোনো একদিন পৃথিবীর বিখ্যাত কবিদের কবিতার সঙ্গে তাঁর 
কবিতাবৃত্ত প্রয়োজন হবে। সমস্ত চরাচরের, সমস্ত জীবনের মৃত্যুহীন স্বর্ণগর্ভ
 ফসলের ক্ষেতে বুননের জন্যে। যখন দেখি শত বছর পর এসে জীবনানন্দ চর্চা হয় 
বাঙালির সংস্কৃতির টেবিলে; তখন উপলব্ধি জাগে যে, খ্যাতিমান কবিদের গবেষণার 
বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে কবি জীবনান্দন দাশ।  
কবি জীবনানন্দ দাশের স্বল্প
 দৈর্ঘ্য জীবনের  বাঁকে বাঁকে অর্থনৈতিক দুর্দশা নিত্যসঙ্গী ছিল।  অর্থের 
প্রতি কোনো আকর্ষণ ছিল না, কবি যে চাকরি পেতেন না, তা কিন্তু নয়। তিনি 
চাকরি করতে চাইতেন না। কাছের মানুষদেরকে বলতেন, বলো তো কী নিদারুণ সময়ের 
অপচয়।  বড় ক্ষতি হয়।  এভাবে এতোটা সময় চলে যাওয়া।  আক্ষেপ করে বলতেন- আহা 
যদি আমার এমন সঞ্চয় থাকত যে, এভাবে সময় নষ্ট না করলেও চলত। না অর্থ তাঁকে 
টানেনি, টেনেছে কবিতা-গল্প-উপন্যাসে। তিনি গাছের তলায় বসে লিখছেন- 
একদিন এই বৃক্ষতলে বসে
সারাদিন একটা বিড়ালের সঙ্গে ঘুরে ফিরে  কেবলই আমার দেখা হয়;
সারাদিন সূর্যের পিছনে পিছনে চলেছে সে-
গাছের ছায়ায় রোদের ভিতরে বাদামি পাতার ভিড়ে নিজের হৃদয়কে নিয়ে- মৌমাছির মতো মগ্ন হয়ে আছে দেখি।
জীবনানন্দ 
 দাশ বাংলার আকাশের নিচে মানব বসতিতে মানবের হৃদয়ে গেঁথে আছেন তার রুপসী 
বাংলা ও বনলতা সেন অমর কাব্য সৃষ্টির জন্যে। কবিতা ছাড়া তিনি উপন্যাস গল্প ও
 প্রবন্ধ লিখেছেন। মাঝে মাঝে তিনি পেন্সিলে ছবি ও  আঁকতেন। তিনি বাংলা 
সাহিত্যের সব্যসাচী। এমন কি জীবিত জীবনানন্দ দাশের  চেয়ে মৃত জীবনানন্দ দাশ
 অনেক বেশি শক্তিশালী।
কবি জীবনানন্দ দাশ যেহেতু মানুষ। অন্যসব মানুষের 
মতো তারও জীবনের সমাপ্তী আছে। আকাশসম মানুষটির স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। এটা 
অন্যতম দুঃখজনক স্মৃতির পান্ডুলিপিময় কথা। ট্রাম্প দুর্ঘনায় আহত হয়ে 
মৃত্যুবরণ করেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, তিনি একহাতে ছাতা অপর হাতে 
ভীড়ের মধ্যে ট্রামের হাতল ধরতে গিয়ে ফসকে পড়ে যান।  তাঁর পাঁজর, কণ্ঠি ও 
উরুদেশ চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যায়। জীবানানন্দ দাশ নিজেই লিখেছেন-
একটি মোটরকার গড়ালের মতো গেল কেশে
অস্থির পেট্রল ঝেড়ে
এই গাড়লের গ্রাস হতে অব্যাহতি পেলেন না জীবনানন্দ দাশ।
না,
 জীবনান্দ দাশ গাড়লের গ্রাস হতে রেহাই তিনি সত্যি-ই  পাননি। আর পাননি বলেই 
জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যের  লেখক -পাঠক মহলে চিরঞ্জীব হয়ে জ¦ল জ¦ল করে 
ঠাঁই হয়ে থাকবেন অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত। 
লেখক: অধ্যাপক, কলাম লেখক ও প্রাবন্ধিক
                        
