সম্পদ,
অপার সম্ভাবনা ও অপরূপ সৌন্দর্যে ডাকাতিয়া বর্ষায় সকলের আকর্ষণ কেড়ে নিলেও
শীত আসার সাথে সাথে তার সৌন্দর্য লোপ পেতে থাকে। পানি কমতে থাকে।
ভূমিদস্যুরা মাটি কাটায় ও পাড় দখলে ব্যস্ত হয়ে উঠে। বিভিন্ন স্থানে
কলকারখানার আবর্জনা ও দূষিত বর্জ্য ফেলে বিষাক্ত করে তোলে নদীর প্রবাহিত
পানিকে। দুই তীরের বসতবাড়ি থেকে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ময়লা আবর্জনা
ফেলার কারণে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। মশামাছি, বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকামাকড়ের
উপদ্রব দিন দিন বাড়ছে। দীর্ঘদিন যাবত খননকার্য চালু না থাকায় অনেক স্থানে
ডাকাতিয়া মরা খালে রূপান্তরিত হয়েছে। যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নদী,
এলাকার কৃষক, ভ্রমণপিপাসু ও ব্যবসায়ীরা।
ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে,
ত্রিপুরার মগ উপজাতি ও ফিরিঙ্গিরা দস্যুবৃত্তিতে বিখ্যাত ছিল। নদী দিয়ে
ত্রিপুরার জলদস্যুরা কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলার নদীর অংশে এবং নদীর
অববাহিকায় ডাকাতি করত এবং পরে আবার নদী দিয়েই নিজস্ব আস্তানায় ফেরত যেত। এ
দস্যুবৃত্তির কারণে নদীটির নাম ডাকাতিয়া হয়েছে বলে অনেকে ধারণা করেন।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে বর্ষাকালে অজস্র জলরাশির করাল গ্রাসে
দুপাড়ের মানুষ সর্বস্ব হারাত। ঘরবাড়ি ফসলের মাঠ এমনকি পালিত পশুসমূহও নদীর
স্রোতে ভেসে গিয়েছে। হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে দুপাড়ের মানুষ। নদী পাড়ি
দিতে জীবন খোয়াতে হয়েছে অনেককে। ডাকাতের মত সর্বগ্রাসী রূপ ছিল বলেই
নামাঙ্কিত হয়েছে ডাকাতিয়া।
সাপের মত আঁকাবাঁকা হয়েই নদীটি প্রবাহিত।
ডাকাতিয়া ভারত-বাংলাদেশের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের
পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ হয়ে বাগমারা দিয়ে
বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বিখ্যাত ডাকাতিয়া। নদীটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ২০৭
কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৬৭ মিটার (২২০ ফুট), তবে এলাকাভেদে প্রস্থের বাড়তি
কমতি লক্ষণীয়। অনেক খাল তার প্রবাহে মিলেছে যেমন Ñ কুমিল্লা শহরের বর্জ্য ও
পানি বহনকারী খালটিও সেই ডাকাতিয়ায় গিয়েই মিশেছে। সবশেষে লক্ষীপুরের পাশ
দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁদপুরের নিকট মেঘনায় গিয়ে মিশেছে, যার জন্য তাকে
মেঘনার একটি উপনদীও বলা হয়। নদীটি কুমিল্লার লাকসাম, নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ,
চাঁদপুরের শাহরাস্তি ও হাজীগঞ্জ উপজেলা অতিক্রম করে চাঁদপুরের মেঘনায় গিয়ে
শেষ হয়েছে।
চাঁদপুর সদর উপজেলার দক্ষিণ মৈশাদির এক বিস্তীর্ণ জনপদ
ডাকাতিয়ার করাল গ্রাসে বিলীন হওয়ার পথে। মৈশাদি গ্রামের প্রায় আড়াই
কিলোমিটার ভয়াবহ ভাঙ্গনের কবলে, হুমকির মুখে পড়েছে অসংখ্য বাড়ীঘর, স্কুল,
মসজিদ, খেলার মাঠ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কবরস্থান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানাদি। এ
বছর বন্যা শুরুর পূর্বেই ভাঙ্গন শুরু হয়ে গেছে। এজন্য নদীপাড়ের মানুষের
আতঙ্গিত। মৈশাদি নদী তীরবর্তী এলাকার জমিদার বাড়ীতে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছে।
অবর্ণনীয় ক্ষতির শিকার হয়েছে নদী পাড়ের বাসিন্দারা বিশেষ করে দক্ষিণ
মৈশাদিতে বাড়ীঘর ও ফসলী জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে নদীভাঙ্গনের কারণে সড়ক এমনকি বিদ্যুতের পিলারও বিলীন হয়েছে
ভাঙ্গানের মুখে। নদী তীরবর্তী মানুষ ঘরবাড়ী ভেঙ্গে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে
নিচ্ছেন।
নদী ভাঙ্গনরোধে জাতীয়ভাবে কোন পদক্ষেপ না নিলে নদীপাড়ের
মানুষগুলো আরো অসহায় হয়ে পড়বে। নদী পাড়ের মানুষের উক্তি Ñপরিবার পরিজন নিয়ে
আতঙ্কের মাঝে প্রতিরাত নির্ঘুম কাঁটাতে হচ্ছে। নদীভাঙ্গনের ফলে তাদের
বসতভিটা যেন আর হারাতে না হয় তাই জরুরী পদক্ষেপ নিতে তাদের আকুল আবেদন
সরকারের নিকট। উপজেলা প্রশাসন এলাকা ঘুরে জনসাধারণকে সাহায্য সহায়তার আশ^াস
দিয়েছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নেয়ার পদক্ষেপ
নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন, ডাকতিয়ার চলমান ভাঙ্গন বিষয়ে চাঁদপুর পানি উন্নয়ন
বোর্ড অবশ্যই ওয়াকেবহাল আছেন যে মৈশাদী, নানীপুর সহ কয়েকটি স্থানে ভাঙ্গনের
প্রবণতা আছে। ভাঙ্গনরোধে স্থায়ী কাজ বাস্তবায়নের জন্য ডিটেইল ফিজিবিলিটি
স্টাডি করে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া উচিত। স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এ
ডাকাতিয়া নদী প্রতিবছরই একবার করে ভাঙ্গে। নদী ভাঙ্গনের ফলে তীরবর্তী
লোকেরা বাড়ী সরাতে হয়। বয়স্ক লোকজন বলাবলি করে স্বাধীনতার চারবার বাড়ি
সরাতে হয়েছে। শেষ বয়সে এসে বাড়ী সরানোর সামর্থ্য নাই। সরকারীভাবে যদি
পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয়, তাহলে কয়েকদিন পর বাড়ীঘর হারিয়ে পরিবার নিয়ে খোলা
আকাশের নীচে থাকতে হবে। কিছুদিন পরপর মিডিয়ায় নদীপাড়ের লোকজনের দুর্দশার
চিত্র তুলে ধরার কারণে সরকারি কিছুলোক এসে মাপজোখ দেয়, পরে আবার চলে যায়।
নদীভাঙ্গন রোধে আর কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।
কোতয়ালী ও সদর
দক্ষিণের সকল খালসমূহের গভীরতা ও প্রস্থতার সঠিকতা বজায়ের ব্যবস্থা করে দখল
ও দূষণমুক্ত ড্রেনেজ সিস্টেম শুরু না করলে শুধু যে কুমিল্লা সিটি
কর্পোরেশনই দূষণমুক্ত হবে না তা নয়, ডাকাতিয়াও হয়ে উঠবে আরও বেশি দূষণীয়।
সম্ভাবনাময় ডাকাতিয়ার লাকসাম, নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ অংশের নদীকে দখল ও
দূষণমুক্ত করার নিমিত্তে খনন কাজ সম্পন্ন করে বছর জুড়েই দর্শনীয় ও
সম্পদশালী করে রাখার জন্য স্থানীয় লোকজন দাবী জানিয়ে আসলেও এ বিষয়ে
কার্যকরি কোন পদক্ষেপ এখনও দৃশ্যমান হয়নি। হাইকোর্টের রায়টি কার্যকর করার
জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ও এলজিইডি বিভাগ সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করলেই
ডাকাতিয়ার খনন ও দূষণমুক্তকরণ কর্মসূচী বাস্তবায়িত হবে বলে এ অঞ্চলের সকল
পরিবেশবিদরা মনে করে। লাকসাম পৌরসভা এলাকার কিছু খালও এসে ডাকাতিয়ায়
মিশেছে। সেগুলোও দখলমুক্ত করে ডাকাতিয়ার সঙ্গে একটি দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প
গ্রহণ করলে লাকসাম অঞ্চলটিও সম্পদশালী, পর্যটনবান্ধব ও বিশাল অর্থনৈতিক
অঞ্চলে রূপ নিবে।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ
