কুমিল্লায় সরকারি হিসেবে ডেঙ্গুর সংক্রমনের তথ্যের সাথে বাস্তবতার মিল নেই। জেলায় শুধুমাত্র দাউদকান্দি উপজেলাতেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসেবে আক্রান্তের চেয়ে অন্তত ৫ গুন বেশি। এছাড়া অন্যান্য উপজেলার তথ্য ফলাও ভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাপক সংক্রমনের শিকার দাউদকান্দি পৌরসভার নাগরিকদের অভিযোগ, সংক্রমনের সঠিক তথ্য আগে জানা গেলে - প্রতিরোধ ব্যবস্থাও আগে করা যেত। স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে তথ্য না থাকায় সাধারন মানুষকে আগে থেকে সচেতন করা যেমন সম্ভব হয় নি, তেমনি নেয়া যায় নি বাড়তি প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
২২ জুন কুমিল্লা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের অফিশিয়াল ফেসবুক পেইজে জন সাধারনের জন্য প্রকাশিত তথ্য মতে, এবছর ১ জানুয়ারি থেকে ২১ জুন পর্যন্ত জেলায় সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা মাত্র ২৬৪ জন। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা করিয়ে সনাক্ত হয়েছে ২৪৪ জন এবং বাকিরা সনাক্ত হয়েছে বেসরকারি হাসপাতালে বলে রিপোর্ট দিয়েছে সিভিল সার্জন কার্যালয়। অথচ শুধুমাত্র দাউদকান্দি উপজেলায় জুন মাসের ২০ দিনে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে অন্তত ১৫ শ জনেরও বেশি বলে নিশ্চিত করেছেন দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. হাবিবুর রহমান। এছাড়াও দাউদকান্দি উপজেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চার নারী ও এক পুরুষসহ মোট পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে।
কুমিল্লা সিভিল সার্জন আলী নূর মোহাম্মদ বশির আহমেদ বলেন, আমরা শুধু কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বিভিন্ন সরকারি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্যগুলো সংগ্রহ ও প্রকাশ করছি। আমরা জানি যে দাউদকান্দি উপজেলাতে অন্তত ১ হাজার ৫ শত জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, চারজন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছে। তারা বেশিরভাগই বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে শনাক্ত হয়েছেন। সরকারি আপডেটের জন্য যেসব তথ্য প্রয়োজন সেগুলোও পূর্ণাঙ্গ না পাওয়ায় এই তথ্যের গরমিল হয়েছে। আমরা সেটি রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটকে (আইইডিসিআর) জানিয়েছি।
৫নং ওয়ার্ডের সাহাপাড়া এলাকার বাসিন্দা সংবাদকর্মী লিটন সরকার বাদল বলেন, মে মাসের শুরুতে যখন সংক্রমন বেশি হচ্ছে ধারণা করা হয়- তখন কেউ সচেতন হয় নি। এর মধ্যে একবার বৃষ্টি হয়ে আবার অনেকদিন বন্ধ থাকায়- বদ্ধ ডোবা-নালায় বৃষ্টির পানি জমে এডিস মশার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং জুনের শুরুতে ঈদের পর পর আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
লিটন সরকার অভিযোগ করে বলেন, সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দোনারচর এবং সাহাপাড়ায়। স্বাস্থ্যবিভাগ শুরু থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সাধারণ মানুষকে জানাতে পারেনি। যে কারণে সংক্রমণ সম্পর্কে কারো কোন ধারণাও ছিল না। আর বেসরকারি হাসপাতাল তিনি গুলো থেকে তথ্য পায়নি তারা। মূলত শুরুতে এডিস মশা নিয়ে সচেতন না হওয়ায় সংক্রমন বেড়ে গেছে।
পাঁচ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর বিল্লাল হোসেন সুমন বলেন, আমরা ইতিমধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণ রোধে পৌর প্রশাসনের সহযোগিতায় কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। তবে এই মুহূর্তে সংক্রমণ বেড়ে গিয়েছে। আগে থেকে গুলোর অবস্থা জানা থাকলে - আরো আগে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া যেত।
দাউদকান্দি পৌর বিএনপির সভাপতি নূর মোহাম্মদ সেলিম সরকার বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের গাফিলতির কারণে দাউদকান্দির ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে আর প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে লাভ কি! উপজেলায় এত এত মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলো অথচ স্বাস্থ্য বিভাগ যে জেলার তথ্য দিচ্ছে তা খুবই অবাস্তব। মানুষ জানতে পারেনি তারা মহামারীতে আক্রান্ত হচ্ছে, তাই সচেতন ও হয়নি।
কুমিল্লার দাউদকান্দিতে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। দাউদকান্দি উপজলো স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. হাবিবুর রহমান জানান, সর্বশেষ ২২ জুন ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের নাগের কান্দি গ্রামের নুরুল আমিন (৫৫)। এর আগে নিহত অন্যান্যরা হলেন, মারুকা ইউনিয়নের লিমা আক্তার (২৪)। অন্যরা হলেন, দোনারচর গ্রামের সালমা বেগম (৫৬), শাহীনূর আক্তার (২৪) এবং সবজিকান্দি গ্রামের জ্যোস্না বেগম (৬০)। জুন মাসের ১ তারিখ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত উপজেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে অন্তত ১ হাজার ৫ শ মানুষ। যাদের বেশিরভাগই বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। যে কারণে তাদেরকে সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত করা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে।
দাউদকান্দির দায়িত্বপ্রাপ্ত পৌর প্রশাসক ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রেদওয়ান ইসলাম বলেন, পৌরসভার পক্ষ থেকে দুটি ওয়ার্ডকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধে মশকনিধন কর্মসূচি ও সচেতনতায় প্রচার-প্রচারোনা চালানো হচ্ছে।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোঃ আমিরুল কায়সার জানান, আমরা দাউদকান্দিতে ডেঙ্গু সংক্রমিত এলাকাগুলো সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছি। সেখানকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পৌর প্রশাসক সংক্রমণ কমিয়ে আনতে এবং এডিস মশা নিধনে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আশা করছি খুব কম সময়ের মধ্যে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসবে।
তথ্য সংগ্রহে স্বাস্থ্য বিভাগের অবহেলা- প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সময় ক্ষেপন হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, আমি মনে করি না এখানে কোন অবহেলা হয়েছে। এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সংক্রমণ কমিয়ে আনা। আমরা সে বিষয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।