চোখের
জলে এবারের ঈদ উল আযহা উদযাপন করছেন ৭০ বছরের সুফিয়া বেগম। স্বামী বেঁচে
থাকতে ঈদুল আযহায় কোরবানি দিতেন তিনি। ৩০ বছর আগে অজ্ঞাত এক রোগে তার
স্বামী মারা যান। এত বছর এই কষ্ট নিয়েই বেঁচে ছিলেন। এ বছর ঈদের আগের দিন
সন্তান ভূমিষ্টের সময় মারা যায় তার ছোট মেয়ে জমেলা আক্তার। এর কিছুক্ষণ পর
মারা যায় সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া নাতিও। তাই এবারের ঈদ চোখের জল ফেলেই কাটিয়ে
দিয়েছেন সুফিয়া বেগম। ঈদ আনন্দের পরিবর্তে তার পরিবারে নেমে এসেছে বিষাদের
ছায়া। বৃদ্ধা সুফিয়া বেগম কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার ধামতী গ্রামে মৃত
আবদুল আজিজ ভূঁইয়ার স্ত্রী। আজিজ ভূঁইয়া স্থানীয় একটি মসিজদে ইমামতি করতেন।
সুফিয়া বেগম তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী। মরিয়ম, ফরিদা ও জমেলা আক্তার নামে তার
তিন মেয়ে ছিল। এর মধ্যে জমেলা ঈদের আগের দিন মারা যায়।
গত রবিবার
বিকালে তার বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে, ঘরের দরজায় বসে মেয়ে ও নাতির জন্য কাঁদছেন
বৃদ্ধা সুফিয়া বেগম। পাড়া প্রতিবেশীরা তাকে স্বান্তনা দিচ্ছেন। কেউ কেউ
তার হাতে কোরবানির মাংসের প্যাকেট তুলে দিচ্ছেন। সুফিয়া বেগমের মেয়ে ও
নাতির মৃত্যুর শোকে যেন পুরো গ্রাম থমকে গেছে। স্বামীর বাড়ি দাউদকান্দির
ইলিয়েটগঞ্জের ওলিপুরের একটি কবরস্থানে মা ও ছেলেকে দাফন করা হয়।
বৃদ্ধা
সুফিয়া বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ৩০ বছর ধরে কোরবানির মাংস জোটে না ঘরে।
ঈদের দিন পাড়া-প্রতিবেশীরা যেটুকু দেন তা দিয়ে কোন রকম ঈদ কাটে। ৩০ বছর আগে
আমার স্বামী মারা গেছে। তিনি একটি মসজিদে ইমামতি করতেন। স্বামী মারা
যাওয়ার আগে কোরবানি দিতাম। তিনি মারা যাওয়ার পর বিভিন্ন বাসা বাড়িতে কাজ
করে ও প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় তিন মেয়ের মধ্যে দুই মেয়েকে এইচএসসি পাশ
করিয়েছি। অভাব-অনটনের কারণে মেজো মেয়েকে বেশি লেখা-পড়া করাতে পারি নাই। এত
বছর ভাঙাচোরা একটি ঘরে থাকতাম। গত কয়েক বছর বছর আগে প্রতিবেশী একজন একটি ঘর
তুলে দেন। ঈদ কি জানিনা, আল্লাহ ভালো জানেন। ঈদের দিন পাড়া-প্রতিবেশী সবাই
ঘরে গোশত দিয়া যায়। যেটুকু দেয় তা রান্না করে সবাইকে নিয়ে খেতাম। মেয়ে,
জামাই ও নাতিরা আসে। তাদের নিয়ে কোন রকম ঈদ কাটত। এবার তাও হয়নি। ঈদের আগের
দিন সন্তান ভূমিষ্ট করতে গিয়ে মেয়ে মারা যায়, ফুটফুটে একটা নাতি হইছিল সে
নাতিটাও মারা গেছে। তাদের হারিয়ে এত শোকের মধ্যে কিভাবে ঈদ করি !
সুফিয়া
বেগম আরও বলেন, আবদুল আউয়াল নামে আমার স্বামীর প্রথম সংসারের একটি ছেলে
রয়েছে। সে প্রতিনিয়তই আমাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালায়, মারধর করে। এ
নিয়ে গ্রামবাসী অনেক শালিস করেও লাভ হয়নি। সে চায় আমি আমার স্বামীর ভিটে
মাটি ছেড়ে চলে যাই। ৩০ বছর স্বামীর ভিটে মাটি আগলে রাখছি, এখন আমি হাটতে
চলতে পারি না, এই বয়সে আমি কই যাব! আমার আর যাওয়ার জায়গা নেই।
সুফিয়া
বেগমের বড় মেয়ে মরিয়ম আক্তার বলেন, এত বছর ভাঙাচোরা ঘরেই থাকতে হয়েছে। গত
পাঁচ বছর আগে প্রতিবেশী এক চাচা নতুন একটি ঘর তুলে দেন। ছোট বেলায় বাবা
মারা যায়। এরপর এই মা-ই আমাদের লেখাপড়া করান। আমরা তিন বোন ছিলাম। ঈদের
অগের দিন ছোট বোন জমেলা আক্তার সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা যায়, তার একটি
ছেলে সন্তান হয়। কয়েক ঘন্টার পর সেও মারা যায়। স্বজন হারানোর শোকে এবারের
ঈদ আনন্দ বিষাদে ছেয়ে গেছে। তাই আমাদের মতো গরিবের পরিবারে আবার কিসের ঈদ
আনব্দ!