স্কলারশিপ বা শিক্ষাবৃত্তি হলো শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার জন্য এক ধরনের আর্থিক পুরস্কার। বিভিন্ন মানদণ্ডের ভিত্তিতে উন্নত বিশ্বের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হয়। এসব মানদণ্ডের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মানদণ্ড হলো শিক্ষার্থীদের মেধা, একাডেমিক মূল্যায়ন ও শিক্ষার্থীর এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকেও বহুসংখ্যক শিক্ষার্থী শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে উন্নত বিশ্বের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে যাচ্ছে। বিদেশে উচ্চশিক্ষায় এক-দুই বছর আগে থেকেই শিক্ষাবৃত্তি সহায়ক মানদণ্ডগুলো সম্পর্কে জেনে নেওয়া উচিত। বিদেশে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষাবৃত্তি সহায়ক কিছু মানদণ্ড বা যোগ্যতা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
একাডেমিক ফলাফল: উচ্চশিক্ষায় স্কলারশিপে পড়তে যাওয়ার জন্য প্রথমত একজন শিক্ষার্থীকে যে বিষয়টির ওপর জোর দিতে হবে তা হলো, তার একাডেমিক ফলাফল। শিক্ষার্থীর একাডেমিক সিজিপিএ ভালো থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শিক্ষার্থীর একাডেমিক সক্ষমতা এবং পরিশ্রমের পরিচায়ক। শিক্ষার্থীর ফলাফল যত ভালো থাকবে উচ্চশিক্ষায় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্কলারশিপের সুযোগ তত বেশি হবে।
ভাষাগত দক্ষতা: অধিকাংশ বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্কলারশিপ পেতে গেলে ভাষাগত দক্ষতা থাকা আবশ্যক। আইইএলটিএস, টোফেল, জিআরই ইত্যাদির মতো আন্তর্জাতিক ভাষাগত দক্ষতার প্রয়োজন হয়। তবে কিছু কিছু দেশ তাদের নিজস্ব ভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে স্কলারশিপের অপশন রাখে। চীন, জাপান, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া তাদের নিজস্ব ভাষাগত দক্ষতাকে গুরুত দিয়ে থাকে। বেশিরভাগ স্কলারশিপের জন্য ইংরেজি ভাষার দক্ষতা পরীক্ষা দিতে হয়।
কিছু জনপ্রিয় পরীক্ষা হলো- ১. ওঊখঞঝ (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঊহমষরংয খধহমঁধমব ঞবংঃরহম ঝুংঃবস) ২. ঞঙঊঋখ (ঞবংঃ ড়ভ ঊহমষরংয ধং ধ ঋড়ৎবরমহ খধহমঁধমব) ৩. চঞঊ (চবধৎংড়হ ঞবংঃ ড়ভ ঊহমষরংয) কিছু ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য ওঊখঞঝ-এর জন্য ৬.৫-৭.৫ স্কোর ভালো বলে ধরা হয়। ঞঙঊঋখ-এর জন্য ৯০-১০০+ স্কোর প্রয়োজন হতে পারে। কিছু দেশের বা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশেষ পরীক্ষা দিতে হতে পারে, যেমন-এজঊ (এৎধফঁধঃব জবপড়ৎফ ঊীধসরহধঃরড়হ) - টঝঅ, ঈধহধফধ ও ইউরোপের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজন হয়।
এগঅঞ (এৎধফঁধঃব গধহধমবসবহঃ অফসরংংরড়হ ঞবংঃ) - গইঅ বা বিজনেস প্রেগ্রামের জন্য লাগে। ঝঅঞ/অঈঞ - ব্যাচেলর কোর্সের জন্য প্রয়োজন হতে পারে। সিজিপিএ (ঈএচঅ) ভালো রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাচেলরের জন্য ৩.৫+ (৪.০ স্কেলে) হলে ভালো। মাস্টার্স ও পিএইচডির জন্য ৩.৭+ হলে স্কলারশিপের সম্ভাবনা বেশি।
বিদেশে স্কলারশিপে পড়াশোনার ক্ষেত্রে এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটির মধ্যে লেখালেখির দক্ষতা অর্জন করা অনেক জরুরি। এছাড়া ও একজন শিক্ষার্থীকে পড়ালেখার পাশাপাশি নাচ, গান, আবৃত্তি, খেলাধূলা, বিতর্ক, অলিম্পিয়াডের মতো বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এসব দক্ষতা তাকে অন্য সব শিক্ষার্থী থেকে আলাদা মূল্যায়নের মাধ্যম হিসেবে দাঁড় করাবে। শিক্ষার্থী যখন খেলাধুলা, বিতর্ক, গান করবে তখন সে জীবনে ব্যর্থ বা সফল হওয়ার গুরুত্ব বুঝতে পারবে। সহশিক্ষার দক্ষতা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্কলারশিপের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বসহকারে দেখা হয়। বিশেষ ভলান্টিয়ারিং দক্ষতা। বিদেশে স্কলারশিপে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ভলান্টিয়ারিংয়ের দক্ষতা বিষয় স্কলারশিপের ক্ষেত্রে বিবেচনা হয়। ভলান্টিয়ারিং-এর অভিজ্ঞতা একজন শিক্ষার্থীকে ইমারজেন্সি রেসপন্স করতে শেখায়। ভলান্টিয়ারিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থী লিডারশিপের যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, যা শিক্ষার্থীর এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে স্কলারশিপ আবেদনপত্রে ভলান্টিয়ারিং কাজের অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীকে বাড়তি সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে।
কাজের অভিজ্ঞতা পড়াশোনার পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থী যদি তার স্কলারশিপ আবেদনপত্রে কোনো কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে পারে সে ক্ষেত্রে তার জন্য স্কলারশিপ পাওয়ার সুযোগ বেড়ে যায়। আবেদনপত্রে উল্লিখিত বিষয় রিলেটেড কোনো জব সেক্টরে কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করলে বিদেশে উচ্চশিক্ষায় স্কলারশিপ পাওয়ার সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
বিদেশি কিছু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাস্টার্স প্রোগ্রামে স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনার জন্য একজন শিক্ষার্থীর রিসার্চ অভিজ্ঞতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। রিসার্চ পেপার একজন শিক্ষার্থীকে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্কলারশিপ পেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। রিসার্চের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী অবশ্যই আবেদনপত্রে উল্লেখিত বিষয়াদির ওপর রিসার্চ পেপার তৈরি করবে।
কুমিল্লা তিতাস উপজেলার কৃতি সন্তান এক সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মো. আবু বকর যুক্তরাষ্ট্রের ফুলব্রাইট ফরেন স্টুডেন্ট প্রোগ্রামে পূর্ণ অর্থায়নে পড়ার সুযোগ পান। তিনি জানান, একেক দেশের বৃত্তির প্রক্রিয়া একেক ধরনের। আবার বিষয়ভিত্তিক ভর্তির প্রক্রিয়াও ভিন্ন। আগে থেকে শিক্ষার্থীরা যদি প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন, তাহলে বৃত্তিসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সহজে আয়ত্ত করতে পারবেন। প্রতিযোগিতামূলক ও সম্মানজনক বৃত্তিগুলোর জন্য ৭.০ বা ৭.৫ আইইএলটিএস স্কোর গ্রহণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বৃত্তিগুলোতে ৬.৫ স্কোরও গ্রহণ করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে টোয়েফল স্কোর লাগে। অতএব প্রয়োজন বুঝে ভাষা দক্ষতার পরীক্ষা দেওয়া উচিত।
আবু বকর আরো জানান, অধিকাংশ বৃত্তির ক্ষেত্রে নেতৃত্বের গুণাবলি, স্বেচ্ছাসেবক বা গবেষক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা, এসব বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাই এসব অর্জনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে আগে থেকেই।
অস্ট্রেলিয়া অ্যাওয়ার্ড বৃত্তি নিয়ে দ্য অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে পড়েছেন চট্রগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মো. জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, অনলাইনের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে তো বৃত্তির খোঁজ পাওয়াই যায়। এ ছাড়া সরকারি সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের কাছ থেকে ই-মেইল করেও তথ্য জানতে পারেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ কার্যকর। হালনাগাদ সরকারি বৃত্তির তথ্য পাওয়া যায় সব সময়। বিভিন্ন দূতাবাসের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিভাগের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজেও বৃত্তির তথ্য প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া চোখ রাখতে পারেন পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে নিয়মিত তথ্য পাওয়ার সুযোগ আছে।
বিদেশে উচ্চশিক্ষায় স্কলারশিপ পাওয়া যায় এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে হবে। পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে ভর্তির ও স্কলারশিপের নিয়মাবলি সম্পর্কে জানতে হবে। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অনলাইন আবেদন করতে হবে। একাধিক বিশ^বিদ্যালয়ে স্কলারশিপের জন্য আবেদন করা ভাল। শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, সুপারিশপত্র, পাসপোর্ট, নম্বরপত্র ইত্যাদি সংগ্রহ করে রাখতে হবে। আমাদের দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সনদ তুলতে গেলেও একধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়তে হয়। তাই শেষ মুহূর্তের জন্য ফেলে না রেখে সনদ সংগ্রহ করুন যত দ্রুত সম্ভব। হালনাগাদ পাসপোর্টও হাতে রাখুন। কোনো কোনো স্কলারশিপের জন্য ইন্টারভিউ দিতে হতে পারে, তাই প্রস্তুতি রাখতে হবে।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাও, কুমিল্লা।