শুক্রবার ২৩ মে ২০২৫
৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
‘আম কুড়াতে সুখ’ তবু কেন কৃষকের শোক
মোস্তফা হোসেইন
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৩ মে, ২০২৫, ১২:৩৫ এএম আপডেট: ২৩.০৫.২০২৫ ১:৩৩ এএম |

 ‘আম কুড়াতে সুখ’ তবু কেন কৃষকের শোক
পুকুর পাড়ে কিংবা ঘরের পেছনে দু-চারটা আমগাছ। টিনের চালে টুপটাপ দু-একটা আম পড়ার শব্দ। শিশুদের ঝড়ের বেগে দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু-আম কুড়ানোর লক্ষ্যে। সবার স্মৃতিতেই থাকার কথা এমন শৈশবের কথা। বোধকরি, কবি জসীম উদদীন ‘ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ’ লিখেছিলেন সেই স্মৃতিতেই। সুখের এই স্মৃতির মধ্যেও ইঙ্গিত আছে-আমের প্রাচুর্য ছিল না আজকের মতো।
মাত্র বছর কুড়ি আগেও কেউ ভাবতে পারেনি, আম উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান হবে পৃথিবীর মধ্যে নবম। কেউ ভাবতে পারেনি, বাংলাদেশ আম রফতানিকারক দেশের তালিকায় নিজের নাম যুক্ত করতে পারবে। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন আম রফতানিকারক দেশ। পৃথিবীর ২৮টি দেশে এখন বাংলাদেশের আম রফতানি হয়। অন্য আরেকটি তথ্য আছে ৩৪টি দেশে আম রফতানির কথা। আর এপথে যাত্রাটাও খুব বেশিদিন আগের নয়, ২০১৫ সালে প্রথম আম রফতানি হয় বাংলাদেশ থেকে। এত দ্রুত আম উৎপাদনে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে যে ইংল্যান্ড, জাপান, ইউরোপের বেশ কিছু দেশ বাংলাদেশ থেকে আম আমদানি করতে উৎসাহ প্রকাশ করেছে।
একসময় ঢাকার বাজারে দেশি টক-মিষ্টি আম ও মৌসুমের শেষ দিকে ফজলি আমের দেখা মিলত। টক-মিষ্টি আমের ভেতর থাকতো পোকা। কোনোটা আবার এত টক হতো যে মুখে দেওয়া যেতো না। কিন্তু মৌসুমি ফল এবং রসের কারণেই আম ফলটি কবিদেরও দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছিল। বাজারে চাহিদা ছিল অনেক, সরবরাহ ছিল কম। যে কারণে এখনকার তুলনায় তখন আমের দাম ছিল বেশি।
আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীদের (আম) মেধা ও শ্রম এবং আম চাষীদের অক্লান্ত পরিশ্রম বাংলাদেশকে আজ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। আজ বাংলাদেশে উৎপাদিত আম অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম শুধু তাই নয়, রফতানিও করতে পারছে। ক্রমবর্ধমান উৎপাদনের এই যাত্রায় এখন ২৭ লাখ মেট্রিক টনে গিয়ে পৌঁছেছে। চাষ হচ্ছে ২৭ হাজার ৪৬৬ হেক্টর জমিতে। বিজ্ঞানীদের সাফল্য দৃশ্যমান। একের পর এক জাতের আম বাজারে আসছে তাদেরই কল্যাণে। ফলনও বেড়েছে একই কারণে। কিন্তু ফলন বৃদ্ধির পরও চাষির মুখে যতটা হাসি ফোটার কথা ছিল সেই হাসি নেই। বাজারে চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হওয়ায় কৃষক কাঙ্ক্ষিত মূল্য পাচ্ছে না।
অন্যদিকে বিশ্ববাজারে প্রবেশের যোগ্যতা অর্জন সম্ভব হয়নি এখনো। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী রফতানি করা আমের গুণগত বিশ্বমানের না হওয়ায় বাংলাদেশের আমের প্রতি বিদেশিদের আকর্ষণ কম হচ্ছে। এক্ষেত্রে যে বিষয়টি উল্লেখ্য তা হচ্ছে স্থানীয় কৃষক ও সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়হীনতাই প্রধান কারণ। সরকারি কর্তৃপক্ষ উৎপাদন বৃদ্ধিতে যতটা বেশি নজর দেয় গুণগত মান বৃদ্ধি, বাজারজাতকরণে ততটাই উদাসীন বলে মনে করা হয়। নতুন নতুন জাতের আম উৎপাদন ও উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাজারজাতকরণ, গুণগত মান বৃদ্ধি, উন্নত সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও বাজারজাতকরণে অধিকতর মনোযোগী হতে হবে। বিদেশিদের চাহিদা নিরূপণ ও সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের দিকেও নজর দিতে হবে।
এবছর আমের ফলন গত বছরের চেয়ে ভালো। এবং দাম গত বছরের তুলনায় অনেক কম। আগে উৎপাদন কেন্দ্রের কাছাকাছি আড়তগুলোতে যেখানে মৌসুমের শুরুতে আম বিক্রি হতো ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে এবার নেমে ৩০-৪০টাকায় পৌঁছেছে। এই আম বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছাতে পৌঁছাতে হয়তো দাম হয়ে যায় ৮০-১০০টাকা কেজি। এতে ভোক্তারা খুশি হলেও উৎপাদনকারীদের লোকসান গুনতে হয়। কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আম উৎপাদন করে কিন্তু তার আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং বাজারজাতকরণের ধারণা কম। সেটা স্বাভাবিকও। ফলে বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদার বিষয়টি তৃণমূলের কৃষকদের অজানা থেকে যায়।
সরকারিভাবে গুণগত মান বজায় রাখার ব্যাপারে নিবিড় সহযোগিতার বিষয়টিও প্রশ্নাতীত নয়। অন্যদিকে বাজারজাতকরণে যে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য তাকেও উপেক্ষা করার মতো নয়। কৃষকরা বাগান থেকেই আম বিক্রি করে ফড়িয়াদের কাছে। সেগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যায়। রফতানিকারকদের সামান্য অংশই বাগান থেকে সরাসরি আম কেনে। এটা হয় মূলত পরিবহন ব্যয় সংকোচন চিন্তার কারণে। এই সুযোগটাই আমাদের আমের বিশ্ববাজারে প্রবেশের প্রধান প্রতিবন্ধক বলে মনে করি।
ঢাকার বাদামতলী কিংবা যাত্রাবাড়ীতে আমগুলো পৌঁছানোর পর পাইকারদের মাথায় থাকে কীভাবে আমগুলো পচে যাওয়া থেকে রক্ষা করা যায়। সেখানে মেশানো হয় বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ। শুধু তাই নয়, এই রাসায়নিক পদার্থ চাষাবাদকালেও ব্যবহার হয়। উৎপাদনকালে কীটনাশকসহ বিভিন্ন রাসায়নিক ছিটানো প্রয়োজন কিন্তু ভোক্তার কাছে যাওয়ার আগেই সেই কীটনাশকের কার্যকারিতা বহাল থাকলে সেগুলো অবশ্যই ক্রেতাকে আকর্ষণ করবে না। আমাদের দেশে বিষয়টি কখনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না বলে বাজারে পাওয়া আম কতটা স্বাস্থ্যসম্মত তা বোঝার উপায় থাকে না।
বলার অপেক্ষা রাখে না আমাদের কৃষকরা বিষয়টি বোঝার কথা নয়। যারা বোঝেন তাদের তদারকি কতটা আছে তা প্রশ্ন হিসেবেই থেকে যায়। মূল কথা হচ্ছে, গুড এগ্রিকালচার প্র্যাকটিস বা গ্যাপ অনুসরণ করা হয় না আমাদের দেশে। যে কারণে বাংলাদেশের আম রফতানি বৃদ্ধি আশানুরূপ হচ্ছে না। যদি গ্যাপ অনুসরণ করা হতো তাহলে বাংলাদেশ থেকে আম রফতানির পরিমাণ অনেক বেড়ে যেতো। কোনো কোনো হিসাবে দেখা যায় এই মুহূর্তেই বাংলাদেশ থেকে ২ হাজার কোটি টাকার মতো আম রফতানি করার সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে। বাংলাদেশের আম রফতানিক্ষেত্রে আরও কিছু বাধা-বিপত্তি রয়েছে। এই বাধাগুলো দূর করার ক্ষেত্রেও তেমন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশের আম সম্পর্কে বিদেশের মানুষ তেমন একটা জানে না। মান বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্র্যান্ডিংয়ের দিকে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশকে বাজার অনুসন্ধান করতে হবে। প্রতিযোগীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য কৌশল অবলম্বন করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারী ও আমদানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো ভূমিকা রাখতে পারে। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্যের সংরক্ষণ ও বিকল্প ব্যবহারের বিষয়টি ভাবতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা আম উৎপাদন, বিপণন বিষয়ে কোনো নীতিমালা নেই। সেদিকটিও ভাবতে হবে। বাংলাদেশে রফতানি পণ্য হিসেবে আম নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে, প্রয়োজন গুরুত্বসহ পদক্ষেপ গ্রহণ।
পল্লীকবি জসিম উদ্দীনের কবিতাতেই আবার ফিরে যেতে চাই, তিনি মামার বাড়ির ঘরের পাশে আম-কাঁঠালের বাগানের কথা বলেছিলেন, আজ বাংলাদেশের সেই আম দুনিয়ার ক্রেতাদের ঘরেও বেশি বেশি যাওয়ার মতো সুযোগ পেতে পারে। প্রয়োজন শুধু একটু উদ্যোগ গ্রহণ।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।














সর্বশেষ সংবাদ
কুমিল্লা সেনানিবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন ডিসি,এসপি, ভিসিসহ ২৬ জন
৫২ জনকে পুশইনের তথ্য দিলো বিজিবি
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ফিরে আসার সম্ভাবনা নাই
দাউদকান্দিতে দেশীয় অস্ত্রসহ ছিনতাইকারী আটক
দুর্বৃত্তদের হামলায় ব্রাহ্মণপাড়া যুবলীগ নেতার মৃত্যু
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা সেনানিবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন ডিসি, এসপি, ভিসিসহ ২৬ জন
কুমিল্লা ও ফেনী সীমান্তে ৫২ জনকে পুশইনের তথ্য দিলো বিজিবি
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ফিরে আসার সম্ভাবনা নাই
কুমিল্লার দাউদকান্দিতে দেশীয় অস্ত্রসহ ছিনতাইকারী আটক
যুক্তরাজ্যে ২২ দিনেও খোঁজ মেলেনি বাংলাদেশি তরুণীর
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২