গণঅভ্যুত্থানসহ
৫ আগস্টের আগে-পরের খুনিরা ধরা পড়ছে না। সেনাদের কঠোর পাহারার মধ্যেও
তাদের কেউ কেউ পালিয়েছে। ছা-পোনাসহ চম্পট দিচ্ছে কানাডা, আমেরিকা,
মধ্যপ্রাচ্যসহ নানান দেশে। এই ফাঁকে চক্র বিশেষ মিলকারখানায় ভাচুর-লুটপাটসহ
আগুনখেলার কাজটি সারিয়ে দিচ্ছে আচ্ছা মতো। আফ্রিকায় বর্বর-জংলী-জানোয়ার
সিধা করে শান্তি ফেরাতে বিশ্বসুনামের অধিকারী সেনাবাহিনীর মহড়ার মাঝেও
চক্রটি তাদের হিম্মত দেখিয়ে দিচ্ছে। ঢাকা লাগোয়া সাভার-আশুলিয়া-গাজীপুরে এ
আগুন খেলার এক খোলা ময়দান। রপ্তানিমুখী শিল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতের
সাধারণ কারখানাও হামলা-লুটপাট থেকে বাদ যাচ্ছে না।
চারদিকে যখন
সংস্কার-সংস্কার আওয়াজ, তখন নানান ছুঁতায় রাস্তায় নেমে শ্রমিক বিক্ষোভ। আর
শিল্পধ্বংসের খবর। পরিস্থিতি কারা উত্তপ্ত করছে, তা মালিক-বিনিয়োগকারীরা
জানেন-বোঝেন। সরকারেরও না বোঝার মতো নয়। দেশের রপ্তানি আয়ের বেশির ভাগই আসে
পোশাক রপ্তানি থেকে। গত কিছুদিন থেকে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি কম থাকলেও
ডলার সংকটের সময় এ খাতই বৈদেশিক মুদ্রা মজুদে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে
আসছে। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ
সরকারের পতনের পর যেভাবে নির্বিচারে সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় হামলা,
লুটপাট শুরু হয়, তার রেশ এখনো রয়ে গেছে। কোথাও কোথাও এর ব্যাপকতা আরো
বাড়বাড়ন্ত।
এ পর্যায়ে আশুলিয়ায় পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা
বাহিনীর সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে পোশাক শ্রমিক কাউসার খানের।
গুলিবিদ্ধসহ আহত ২০ জন। গত কয়েকদিনের ধারাবাহিকতায় সোমবার ১০টার দিকে
নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল ও ডিওএইচএস পয়েন্টে সড়ক অবরোধ করে কয়েকশ
পোশাক শ্রমিক। বন্ধ কারখানা খুলে দেয়ার দাবিতে কয়েকদিন ধরে বিচ্ছিন্নভাবে
তারা বিক্ষোভ করে আসছে। বিক্ষোভের সময় তারা যৌথ বাহিনীর কয়েকটি গাড়ি
ভাঙচুরও করে। তাদের দমানো বা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা কম হচ্ছে না। কিন্তু,
ফলাফল কাঙ্খিত পর্যায়ে নয়। এর অনিবার্য পরিণতিতে একদিকে ব্যবসায়িক
প্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে অনেকের কর্মসংস্থানও
হুমকিতে। হতাশায় তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকেরা।
প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা না
পেলে কারখানা বন্ধ রাখা ছাড়া মালিকদের কোনো বিকল্প নেই। পুলিশের সহায়তা
অকুলান। কিছু কারখানায় আগুন দেওয়ার চেষ্টা সেনা সদস্যরা রুখেছে। কিন্তু,
এভাবে ক’দিন? নানা দেনদরবারে খোলার পর আবার শ্রমিক বিক্ষোভ, আবার কারখানা
বন্ধ, বুঝিয়েশুনিয়ে আবার শ্রমিকদের কাজে ফেরানো- এগুলো মোটেই সমাধান নয়।
বরং অনিশ্চয়তা ও উৎকণ্ঠার আরো বিস্তার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের
অসহযোগ আন্দোলন ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরিস্থিতিতে দেশে কতো
শিল্পকারখানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে, এর পরিপূর্ণ হিসাবের আপডেট বড়
উদ্বেগজনক। গোটা পরিস্থতিটি ব্যবসায়ী, সেনাবাহিনী, শিল্প পুলিশ, ফায়ার
সার্ভিস, শ্রমিক-কর্মচারীসহ অনেকেরই ধারণার বাইরে। গাজীপুর, সাভার,
আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ছাড়িয়ে এ আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের অন্যান্য
শিল্পাঞ্চলেও। এ অরাজক পরিস্থির জন্য প্রতিবেশী দেশের দিকে অভিযোগের তীর।
তারা এসব ঘটনাকে আরো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচারের ঝাণ্ডায় বিদেশী
ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানসহ সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ইমেজ সংকট জোরদার করতে
চায় বলে অভিযোগটি বেশ জোরালো। আলামত বুঝে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি মেনে নিয়ে মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও
সরকারের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই করে দেয়া হয়েছে।
সচিবালয়ে সমঝোতা স্মারক
সইয়ের পর ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, এরফলে শ্রমিকদের হাজিরা বোনাস ও টিফিনের
টাকা বাড়ার পাশাপাশি ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নে কাজ করা হবে। শ্রম উপদেষ্টা
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুইয়া আশা করেন, বুধবার থেকেই শ্রমিকরা কাজে ফিরবেন। তবে
এরপরও বিশৃঙ্খলা কিংবা নৈরাজ্য হলে তা বরদাশত করা হবে না বলে হুঁশিয়ারি
উপদেষ্টাদের। এছাড়া, আগামী ১০ অক্টোবরের মধ্যে মালিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ
করতে হবে। তা না করলে বিজিএমইএ ব্যবস্থা নেবে বলে জানানো হয়। এসময়
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম
চৌধুরী পোশাক শিল্পে দেশি-বিদেশি ইন্ধনের কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু, সেই
আলোকে কার্যকর ফলোদয় নেই। একদিকে কয়েকটি কারখানা খুললে, আরেকদিকে কয়েকটিতে
গণ্ডগোল পাকছে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে জনতার জীবনের বিনিময়ে অর্জিত সাফল্য
ম্লান হয়ে যাওয়ার সমূহ শঙ্কা ঘুরছে। নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করে সব
কলকারখানার উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত না হলে সামনে আরো ভয়াবহ
অবস্থা নামতে পারে শিল্প সেক্টরে। গত এক দেয় মাসে সহিংসতায় জানমালের
ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যে অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে। এর আগে
দীর্ঘদিন হয়েছে দলবাজি ও লুটপাটের কারণে। অন্তর্র্বতী সরকারের সংস্কার
কাজে সময় লাগবে, তা ব্যবসায়ীরা ভালোভাবে মালুম করছেন। কিন্তু উৎপাদন ও
রফতানিতে যুক্তদের ঘণ্টা-মিনিট হিসাব কষে কাজ করতে হয়। দেশের বিভিন্ন
কারখানায় ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুট তাদেরই ঘন্টা বাজিয়ে দিচ্ছে। আইন
শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে কারখানা চালু রাখাই বোকামির পর্যায়ে।
আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং কারখানার নিরাপত্তায়সেনাবাহিনীর সহযোগিতা
চাওয়া হয়েছে। সেনাসহ তিন বাহিনী প্রধানের সঙ্গে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা
আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক কথা বলেছেন। সায়ও পেয়েছেন। কিন্তু, সেই দৃষ্টে ফল
না পেয়ে মনোবেদনায় ভুগছেন তারা। অনেকে বন্দর থেকে কাঁচামাল খালাস করতে
পারছে না। কারখানায় পণ্যের স্তূপ পড়ে আছে। ক্রেতাদের অনেকে রফতানি অর্ডার
বাতিল করে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিচ্ছে।
এ পিরিস্থিতির রেশ থামাতে পোশাকসহ
বিভিন্ন শিল্পে অস্থিরতার লাগাম টানার হাই অ্যান্টিবায়োটিক দাওয়াই জরুরি
হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা দেশগুলোর ইন্ধনের কথা এখানে
অবান্তর নয়। বিশেষ করে পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনের পেছনে ষড়যন্ত্রকেই
একমাত্র কারণ না ভেবে তাদের দাবির দিকেও মালিকদের মনোযোগ দরকার। মনে রাখতে
হবে, শিল্পসেক্টরের এসব তাণ্ডব ব্যবসা বাণিজ্যে ক্ষতির পাশাপাশি দেখা
দিয়েছে দেশের ইমেজহানির বড় কারণ হয়ে।
কারখানায় হামলাকারীদের অনেকে
শিশু-কিশোর। আবার এক এলাকার লোক অন্য এলাকায় যাচ্ছে বিশৃঙ্খলা ঘটাতে। অনেক
রিকশা ও ভ্যানচালক হামলায় জড়াচ্ছে। তৃতীয় কোনো পক্ষ শ্রমিকদের উস্কে দেওয়ার
ঘটনা থাকাও অস্বাভাবিক নয়। উৎপাদন-উন্নয়ন বরবাদ করাই তাদের অভিলাস। ওষুধ
শিল্পের দিকেও এদের লাল চোখ পড়েছে। এর অর্থ ও উদ্দেশ্যও পরিষ্কার। উদ্ভূত
পরিস্থিতির সুযোগে কিছু কিছু কারখানায় অপ্রয়োজনেও হাজিরা ভাতা বাড়ানোর মতো
দাবিতে কারা বিক্ষোভসহ গণ্ডগোলে কাঠখড়ি এগিয়ে দিচ্ছে তা সনাক্তের কাজে
সরকারের ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই। এরা নিশ্চয়ই সরকারের চেয়ে শক্তিধর নয়।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে অন্তর্র্বতী
সরকার কী সিদ্ধান্ত নেবে সেটি এখন একটা বড় প্রশ্ন। এখানে
মালিক-শ্রমিক-সরকারের চেয়েও স্বার্থ বেশি দেশের। ওইসব প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার
করে মানি লন্ডারিং, ঋণ নেয়ার মতো ঘটনা থাকলে ব্যক্তিদের বিহিত হোক।
কিন্তু, দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা, হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানে যেন
ছেদ না পড়ে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।