কোটা
সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা ও নাশকতায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে ২০০৯ সালের
সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র
শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
আসাদুজ্জামান খান কামাল। বুধবার সন্ধ্যায় সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি
বলেন, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া চলছে এবং যেকোনো
মুহূর্তে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে।
“১৮ অনুচ্ছেদে
(সন্ত্রাসবিরোধী আইনের) এটা সম্পর্কে বিস্তারিত দেওয়া আছে। পেছনের
সন্ত্রাস, সুশীল সমাজের ডিমান্ড, ১৪ দলের ডিমান্ড, অতি সম্প্রতি যেসব ঘটনা
ঘটছে, এগুলোর সঙ্গে জামায়াতের যোগসাজশ আছে। সব কিছু মিলিয়েই এটা করা হচ্ছে।
সবকিছু এখুনি জানাতে পারব না। এটা প্রক্রিয়াধীন। প্রক্রিয়া শেষে জানতে
পারবেন।”
গত সোমবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের বৈঠকে জামায়াতে
ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়। এরপর মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল
হক বলেন, সরকারের নির্বাহী আদেশে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হবে এবং কোন আইনি
প্রক্রিয়ায় তা করা হবে, তা চূড়ান্ত করা হবে বুধবারের মধ্যে।
এরপর বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানালেন, কাজটি করা হবে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে।
আইনের
ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সরকার, কোনো
ব্যক্তি বা সত্তা সন্ত্রাসী কার্যের সহিত জড়িত রহিয়াছে মর্মে যুক্তিসঙ্গত
কারণের ভিত্তিতে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, উক্ত ব্যক্তিকে তফসিলে
তালিকাভুক্ত করিতে পারিবে বা সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তফসিলে তালিকাভুক্ত
করিতে পারিবে।”
আইনে সন্ত্রাসী কাজের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যদি কোনো
ব্যক্তি, সত্তা বা বিদেশী নাগরিক বাংলাদেশের অখ-তা, সংহতি, জননিরাপত্তা বা
সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণ বা জনসাধারণের কোনো অংশের মধ্যে
আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার বা কোন সত্তা বা কোনো ব্যক্তিকে কোনো কাজ করতে
বা করা থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করার জন্য অন্য কোনো ব্যক্তিকে হত্যা,
গুরুতর আঘাত, আটক বা অপহরণ করে বা করার চেষ্টা করে, এ ধরনের কাজের জন্য
অন্য কারো সঙ্গে ষড়যন্ত্র বা সহায়তা বা প্ররোচিত করে; অথবা অন্য কোনো
ব্যক্তি, সত্তা বা প্রজাতন্ত্রের কোনো সম্পত্তির ক্ষতি করে বা করার চেষ্টা
করে; অথবা ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র বা সহায়তা বা প্ররোচিত করে; অথবা এ
ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য, দাহ্য পদার্থ ও আগ্নেয়াস্ত্র
ব্যবহার করে বা নিজ দখলে রাখে, কোনো সশস্ত্র সংঘাতময় দ্বন্দ্বের বৈরি
পরিস্থিতিতে অংশ নেয়, তাহলে তা ‘সন্ত্রাসী কাজ’ বলে গণ্য হবে।
এ আইনে কোনো অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ মৃত্যুদ-ের বিধান রয়েছে।
২০১৮
সালে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জুনের শেষে হাই কোর্ট অবৈধ
ঘোষণা করলে ছাত্ররা ফের মাঠে নামে। জুলাইয়ে তা সারা দেশের
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছড়িয়ে যায়। পরে শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন
কর্মসূচিকে ঘিরে একপর্যায়ে তা সহিংসতায় গড়ায়।
এর মধ্যে বিভিন্ন এলাকায়
রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় হামলা শুরু হয়। রামপুরায় বিটিভি ভবন, বনানীতে সেতু ভবন,
মহাখালীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ভাঙচুর করে
আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ভাংচুর করে আগুন দেওয়া হয় এক্সপ্রেসওয়ের মহাখালীর টোল
প্লাজা এবং মেট্রোরেলের দুইটি স্টেশনে। এই আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাতের মধ্যে
এক সপ্তাহে ১৫০ মানুষের মৃত্যুর তথ্য নথিভুক্ত করেছে সরকার, যদিও
সংবাদমাধ্যমের খবরে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যুর খবর এসেছে।
সরকারের
শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে সংঘাতে
জড়িয়ে নাশকতা করেছে একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল
জামায়াতে ইসলামী, আর তাতে মদদ দিয়েছে তাদের দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী বিএনপি।
বিএনপি
প্রকাশ্যেই ছাত্রদের ওই আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে সরকারের পদত্যাগের দাবি
জানিয়েছে। নাশকতায়ে সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করে সংঘাতের জন্য উল্টো
সরকারকেই দায়ী করেছে দলটি।
আর জামায়াত বলেছে, অরাজক পরিস্থিতিতে সরকার
“দেশ ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ভিন্নদিকে প্রবাহিত করার জন্য
এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে ১৪ দলের বৈঠকে জামায়াত নিষিদ্ধের এ হঠকারী সিদ্ধান্ত
নিয়েছে।”
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলে এ দলের কর্মীরা জঙ্গি দলের মত গোপন
কর্মকা-ের মাধ্যমে সক্রিয় থাকা চেষ্টা করতে পারে বলে সরকারকে সতর্ক করেছেন
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ।
তাদের নিষিদ্ধ করা হলে নতুন করে অশান্তি হবে কিনা,
সেই প্রশ্ন রাখা হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “জামায়াত-শিবির
এই অবস্থা তৈরি করেই ফেলেছে। এর পেছনে তাদের যথেষ্ট যোগসাজশ রয়েছে।
ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের সব দাবি মেনে নেওয়ার পরও আন্দোলন থামছে না। একটা
সহিংসতায় রূপ নিয়েছে।
“ছাত্ররা কোনোদিন এমন ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ে লিপ্ত
হত না যদি তাদের পরামর্শদাতারা এই রকম পরামর্শ না দিত। রাষ্ট্রীয় সম্পদ
ধ্বংস করেছে। এই যে এতগুলো মানুষ হতাহত হল, শুধু কি পুলিশের গুলিতে হয়েছে?
আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখুন, আমরাও প্রকাশ করব কার গুলিতে কত মানুষ মারা গেছে,
আহত হয়েছে।”
মন্ত্রী বলেন, “এই সবকিছু তো ছাত্ররা করেনি। ছাত্রদের
পেছনে রেখে পেছন থেকে যারা করেছে সেগুলো জামায়াত-শিবির-বিএনপি। অন্যান্য
জঙ্গি সংগঠনগুলো এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিল। এটাই আমাদের কাছে প্রতীয়মান
হচ্ছে। সেজন্য অনেক দিনের যে চাহিদা ছিল যে, জামায়াত শিবিরকে নিষিদ্ধ করার,
আজকে সেই প্রক্রিয়াটি চলছে।”
সরকারের এই সিদ্ধান্তের পর নতুন করে
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির শঙ্কা আছে কি না- এ প্রশ্নে আসাদুজ্জামান
খান কামাল বলেন, “অবনতি তো অনেকখানি হয়ে রয়েছিল। আমরা ধীরে ধীরে এটাকে ইয়ে
করে আনছি। কিন্তু এই অবনতির পেছনে যাদের হাত রয়েছে তাদেরকে আইনের সামনে
আনার জন্য প্রক্রিয়া চলছে। যারা এইগুলো করছে তাদের সম্পর্কে জনগণকে জানাতে
হবে, সেটাই আমরা ব্যবস্থা করছি।”
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক
গোয়েন লুইস এদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে কী কথা
হয়েছে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, “তারা অনেক কিছুই জিজ্ঞাসা করেছে। আর
কতদিনের মধ্যে অবস্থা স্বাভাবিক হবে, কারফিউ কবে উঠবে- ইত্যাদি। আমরা বলেছি
ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবে। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা কারফিউ উইথড্র করতে
পারব।
“তারা দুই একজন কিশোরের মৃত্যুর কথা জানতে চেয়েছিল। আমরা একটা
কিশোরের কথা বলেছিলাম যে, ওর বয়স কত এখনও আমরা তার সার্টিফিকেটটি পাইনি।
স্কুলে থেকে জানাচ্ছে সাড়ে ১৭ বছর। কিন্তু সেই ছেলেটি যে অন্যায় কাজটি
করেছে, এটা একটা জঘন্য অন্যায় কাজ করেছে। সে যাত্রাবাড়ীতে পুলিশ হত্যার
সঙ্গে জড়িত ছিল।”
তিনি বলেন, “তার ভিডিও এবং কথোপকথোন থেকে তাকে সনাক্ত
করেছে। সেতো পুলিশ হত্যা করেছেই। সেই পুলিশকে ঝুলিয়ে রাখার ক্ষেত্রেও সে
ছিল। দঁড়ি ধরে টানতেছিল ঝুলিয়ে রাখার জন্য।”
কারা কীভাবে প্রাণ হারাল?:
সংঘাতে
প্রাণহানির বিষয়েও জাতিসংঘ প্রতিনিধি দল জানতে চেয়েছিল জানিয়ে
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমরা বলেছি যে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবার
জন্যই দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং তাদের দেখতে গেছেন এবং তাদেরকে কিছু নগদ টাকা
সাহায্যও করেছেন। আমরা মনে করি এই ঘটনাগুলো আমাদের পুলিশ কিংবা নিরাপত্তা
বাহিনী ইচ্ছে করে বা কারো প্ররোচনায় করে নাই। মানুষের জানমাল এবং রাষ্ট্রীয়
সম্পদ রক্ষা করার জন্যই তারা গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে।”
পুলিশ ‘অনেক
ধৈর্যের সঙ্গে’ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে মন্ত্রী বলেন, “আমরা দেখেছি যে শিশু
কিশোরদের সম্মুখে নিয়ে আসছিল। এদের পেছনে ছিল আসল ব্যক্তিরা, যারা নাকি
ঘটনা ঘটাতে চেয়েছিল। আগুন ধরিয়েছে, মানুষ হত্যা করেছে, ইটপাটকেল ছুড়েছে।
তারা ছিল এই শিশুদের পেছনে, সেকেন্ড লাইনে, থার্ড লাইনে ছিল।
“আমাদের
পুলিশ বাহিনী এই শিশুদের চরম ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবেলা করেছেন। তারপর যখন
বৃষ্টির মত ঢিল আসা শুরু হল, পটকা ফুটানো হল, গুলি করা হল, তখন পুলিশ বাধ্য
হয়ে টিয়ার গ্যাস, তারপর যেটা যেটা করা দরকার সেটা করেছে। এতে হয়তো অনেকেই
আহত হয়েছেন। এরপরও যখন থামেনি তখন পুলিশ নন লেথাল আর্মস ফায়ার করতে বাধ্য
হয়েছে। আমরাও কারফিউ দিতে বাধ্য হয়েছি, সেনাবাহিনী দিতেও বাধ্য হয়েছি।
জানমালের নিরাপত্তার জন্যই এটা করা হয়েছিল।”
কয়েকদিনের সংঘাতে কেবল
আন্দোলনকারীরা নয়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি দলের ‘অনেকে’
মারা গেছেন, সে তথ্য জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলকে দেওয়ার কথা জানান
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “এখানে শুধু যে ছাত্ররা শহিদ হয়েছে,
শাহাদাত বরণ করেছে তা নয়। এখানে পুলিশ, আনসার, র্যাব সদস্য, সাংবাদিক এবং
বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ মৃত্যু বরণ করেছেন। এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব,
আওয়ামী লীগ, বিএনপির একজন দুইজন, দুইএকজন ছাত্রও শাহাদাত বরণ করেছেন।
এরমধ্যে আবার কয়েকজন ছাত্রলীগের সদস্যও রয়েছেন। আওয়ামী লীগের লোকও শাহাদাত
বরণ করেছেন। বাধ্য হয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করেছেন।”
জাতিসংঘের লোগোওয়ালা গাড়ি বেরোয় ‘ভুল করে’:
সহিংসতা
দমনে জাতিসংঘের লোগো লাগানো শান্তি মিশনের গাড়ি ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন করা
হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “ইউনাইটেড নেশনসের এপিসি ভেহিকেলটা আর্মিরা
ব্যবহার করেছেন। আর্মিরা ইউনাইটেড নেশনস থেকে যখন ফেরত এনেছে, আর্মিরা
তাড়াহুড়া করে বোধ হয় বের করেছিল। যখন দৃশ্যমাণ হয়েছে, আর্মিরা সঙ্গে সঙ্গেই
এটাকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। এটা দিয়ে কোনো অপারেশন কাজ চালানো হয়নি। এটা যখনই
তাদের নজরে পড়েছে তখনই তারা সরিয়ে নিয়েছে।”
সংঘাত-সহিংসতার তদন্তে কী কী
করা হচ্ছে, তাও জানতে চেয়েছেন জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা। সে প্রসঙ্গ ধরে
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমরা বলেছি, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ওয়ান
ম্যান ছিল। এটার সংখ্যা ও টিওআর বাড়িয়ে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। তদন্ত
শুধু তাদেরই নয়, পুলিশেরও তদন্ত হবে, কেন পুলিশ গুলি করতে বাধ্য হল,
বিজিবিরও তদন্ত হবে। যদি কেউ ভুল করে থাকে সেটাও আমরা দেখব।”