এই
সিরিজ ঘিরে খুব বেশি ‘হাইপ’ নেই বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু সাপ্তাহিক ছুটির
দিনে মিরপুর সেই ভুল ভাঙিয়ে দিল। গ্যালারিতে দেখা গেল ১৬-১৭ হাজার দর্শক।
গর্জনে-উল্লাসে মাঠ মাতিয়ে রাখলেন তারা। রোমাঞ্চ জাগানিয়া ম্যাচে শেষ ওভারে
জয়ের স্বস্তিকে সঙ্গী করে মাঠ ছাড়লেন তারা। কিন্তু বাংলাদেশের খেলা তাদের
মন কতটা ভরাতে পারল? আরও বড় প্রশ্ন, বিশ্বকাপের দুয়ারে দাঁড়িয়ে কোন বার্তা
পাওয়া গেল দলের পারফরম্যান্সে!
চট্টগ্রামের তিন ম্যাচেই সিরিজ নিশ্চিত
করে ফেলা বাংলাদেশ মিরপুরে জিতল ৫ রানে। এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও এমন
কষ্টের জয়ে ভ্রূ কুঁচকে যাওয়া স্বাভাবিক। ম্যাচের নানা বাঁকে ফিরে গেলে
হতাশার উপকরণ মিলবে আরও। ব্যাটিংয়ে দারুণ শুরুর পরও অবিশ্বাস্য ধস, বোলিংয়ে
জিম্বাবুয়েকে বাগে পেয়েও নাকাল করতে না পারা, ভীড় জমাচ্ছে এমন অনেক
প্রশ্নই। শেষ পর্যন্ত কেবল সান্ত¡না, অন্তত হারতে হয়নি!
মিরপুর
শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে শুক্রবার বাংলাদেশ অলআউট হয় ১৪৩ রানে। শুরুটা যেমন
ছিল, তাতে এই স্কোর একরকম অকল্পনায়। উদ্বোধনী জুটিতেযে ১১ ওভারে ১০০ রান
তুলে ফেলেছিলেন সৌম্য সরকার ও তানজিদ হাসান!
১০১ রানের এই জুটি ভাঙার পর তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে বাংলাদেশের ইনিংস।৫২বলের মধ্যে ১০ উইকেট হারায় তারা স্রেফ ৪২রানে।
দুই ওপেনারের পর তিনে নামা তাওহিদ হৃদয়ের ১২ রানই দলের সর্বোচ্চ। আর কোনো ব্যাটসম্যান দু অঙ্ক ছুঁতে পারেননি।
জিম্বাবুয়ের এই দলের এমন অবস্থা যে, এই লক্ষ্যওতাড়া করতে পারেনি তারা।আটকে যায় ১৩৮ রানে।
বাংলাদেশের
দুই বোলিং নায়ক সিরিজে প্রথমবার মাঠে নামা দুজন। প্রায় ১০ মাস পর দেশের
হয়ে টি-টোয়েন্টি খেলতে নেমে সাকিব আল হাসান নিয়েছেন ৩৫ রানে ৪ উইকেট। দারুণ
বোলিংয়ে ১৯ রানে ৩ উইকেট নিয়ে ম্যাচের সেরা আইপিএল-ফেরত মুস্তাফিজুর
রহমান।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ৯২ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে প্রথমবার ম্যাচ সেরা হতে পারলেন বাঁহাতি এই পেসার।
বাংলাদেশ
এ দিন একাদশের বাইরে রাখে লিটন কুমার দাস, মাহমুদউল্লাহ ও সাইফ উদ্দিনকে।
তবে একাদশে ফেরেন সাকিব, মুস্তাফিজ ও সৌম্য।শক্তি তাই কমার চেয়ে বরং আরও
বেড়েছে বললেও ভুল হয় না। কিন্তু সবচেয়ে ভুগতে হলো এই ম্যাচেই।
টস জিতে
ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশকে নতুন আশার জোগান দেয় নতুন উদ্বোধনী জুটি। শুরুতে
দ্রুত রান তোলার ভার বলতে গেলে একাই বয়ে নেন তানজিদ। ফ্লিক-কাট-ড্রাইভ
মিলিয়ে প্রথম পাঁচ ওভারে সাতটি বাউন্ডারি আসে তার ব্যাট থেকে।
দলের রান তখন ৪২। তাতে ৩৯ রানই তানজিদের, সৌম্যর ছিল ৬ বলে ২।
সিরিজের আগের ম্যাচগুলিতে পাওয়ার প্লের ব্যাটিং নিয়ে সমালোচনার শিকার হওয়া দল এবার ৬ ওভারে তুলতে পারে ৫৭ রান।
সৌম্য
তখনও ঠিক ছন্দ পাচ্ছিলেন না। ১১ বলে তার রান ছিল ৬। প্রথম বড় শট আসে তার
ব্যাট থেকে সপ্তম ওভারে। ব্রায়ান বেনেটের অফ স্পিনে ছক্কা মারেন তিনি
রিভার্স স্ইুপ খেলে। পরের ওভারে আরেকটি ছক্কা আসে তার ব্যাট থেকে লুক
জঙ্গুয়ের বলে নান্দনিক ইনসাইড আউট শটে।
পরের ওভারে ফারাজ আকরামকে ছক্কায় ওড়ানোর পর তানজিদ ফিফটিতে পা রাখেন ৩৪ বলে।
দুইজনের ব্যাটে দল দ্রুত ছুটে যায় শতরানে। ১৪ ম্যাচ পর শুরুর জুটিতে শতরান পায় বাংলাদেশ।
জুটি ভাঙে তানজিদের বিদায়ে। ৫১ রানে সহজ ক্যাচ দেওয়া ব্যাটসম্যান বিদায় নেন আর এক রান যোগ করেই।
তানজিদের ৫২ রান আসে ৩৭ বলে। জঙ্গুয়ের ওই ওভারেই সঙ্গীর পথ ধরেন ৩৪ বলে ৪১ রান করা সৌম্য।
ধসের আভাস তখনও সেভাবে পাওয়া যায়নি। কিন্তু দ্রুতই বদলে যায় দৃশ্যপট।
প্রথমবার
তিনে ব্যাট করতে নেমে তাওহিদ হৃদয় সীমানায় ধরা পড়েন রাজার বলে। বেনেটের
পরের ওভারেই আউট হয়ে যান সাকিব আল হাসান ও নাজমুল হোসেন শান্ত।
ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলে বোল্ড হয়ে যান দুই ব্যাটসম্যানই।
হতচকিত ব্যাটিং
লাইন আপ ভেঙে পড়ে তাসের ঘরের মতো। এলোমেলো শট খেলে জাকের আলি ধরা পড়েন
থার্ড ম্যানে (৭ বলে ৬)। জঙ্গুয়ের ইয়র্কারে বোল্ড হয়ে যান রিশাদ হোসেন।
তাসকিন আহমেদ শূন্যতে ফেরেন রান আউটে।
লোয়ার অর্ডারও পারেনি তেমন কিছু করতে। উদ্বোধনী জুটিতে ১১ ওভার খেলে ফেলা দল অলআউট হয়ে যায় ২০ ওভারের আগেই।
এই
পুঁজির পর বোলিংয়ে যেমন শুরু দরকার, বাংলাদেশকে তা এনে দেন তাসকিন আহমেদ।
প্রথমবার ওপেন করতে নামা ব্রায়ান বেনেটকে ফেরান তিনি প্রথম ওভারেই।
সিকান্দার
রাজা তিনে নেমে তানজিম হাসানের এক ওভারে চার মারেন তিনটি। তার ডানাও ছেটে
দেন তাসকিন। ভেতরে ঢোকা বলে উপড়ে যায় ১০ বলে ১৭ রান করা জিম্বাবুয়ের
অধিনায়কের মিডল স্টাম্প।
উইকেট শিকারে যোগ দেন পরে স্পিনাররাও।
টাডিওয়ানাশে মারুমানিকে ফেরান সাকিব, রিশাদকে রিভার্স সুইপ করার চেষ্টায়
আউট হন ক্লাইভ মাডান্ডে।
দশম ওভারে ৫৭ রানে ৪ উইকেট হারানো জিম্বাবুয়েকে
লড়াইয়ে ফেরান জোনাথান ক্যাম্পবেল ও রায়ান বার্ল। তানভির ইসলাম ও তানজিম
হাসানকে দারুণ দুটি ছক্কা মারেন ক্যাম্পবেল। তানজিমকেই চোখধাঁধানো ফ্লিকে
গ্যালারিতে পাঠান বার্ল।
দুজনকেই অবশ্য জীবন দেয় বাংলাদেশ। ১২ রানে
রিশাদের বলে ক্যাম্পবেলে ক্যাচ ছাড়েন হৃদয়, ১ রানে তানজিমের বলে বার্লের
ক্যাচ নিতে পারেননি কিপার জাকের।
সেজন্য অবশ্য খুব একটা ভুগতে হয়নি
বাংলাদেশকে। দারুণ এক স্লোয়ারে বার্লকে ১৯ রানে বিদায় করেন মুস্তাফিজ। লং
অন থেকে অনেকটা ভেতরে ছুটে দারুণ ডাইভিং ক্যাচ নেন সৌম্য। ওই ওভারে
জঙ্গুয়েকেও ফেরান মুস্তাফিজ।
সাকিব দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে থামান ২৭ বলে ৩১ রান করা ক্যাম্পবেলকে।
ম্যাচ
তখন শেষ বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু সাকিকের ওই ওভারেই চার ও ছক্কা মেরে
উত্তেজনা ফেরান ওয়েলিংটন মাসাকাদজা। পরে খেলা পৌঁছে যায় শেষ ওভারের
নাটকতীয়তা। ৬ বলে জিম্বাবুয়ের প্রয়োজন পড়ে ১৪ রানের।
সাকিবের করা ওভারের
প্রথম বলেই সহজ ক্যাচ ছাড়েন তানজিদ। তৃতীয় বলে ছক্কা মেরে জিম্বাবুয়ের আশা
জাগিয়ে তোলেন ব্লেসিং মুজারাবানি। কিন্তু সাকিবের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তারা
পেরে ওঠেননি।
চতুর্থ বলেই স্টাম্পড হয়ে যান মুজারাবানি। পরের বলে রিচার্ড এনগারাভাকে বোল্ড করে ম্যাচ শেষ করেন সাকিব।
শেষটা তাই বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিময়। কিন্তু এই জয়ে তৃপ্তি কতটা, প্রশ্নটা উঠতেই পারে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ:
১৯.৫ ওভারে ১৪৩ (তানজিদ ৫২, সৌম্য ৪১, হৃদয় ১২, শান্ত ২, সাকিব ১, জাকের
৬, রিশাদ ২, তাসকিন ০, তানজিম ৬, মুস্তাফিজ ৩, তানভির ৩*; রাজা ৪-০-২৪-১,
মুজারাবানি ৩.৫-০-৩০-১, এনগারাভা ৪-০-২৭-২, বেনেট ৩-০-২০-২, জঙ্গুয়ে
৩-০-২০-৩, আকরাম ১-০-৯-০, মাসাকাদজা ১-০-৭-০)।
জিম্বাবুয়ে: ১৯.৪ ওভারে
১৩৮ (মারুমানি ১৪, বেনেট ০, রাজা ১৭, ক্যাম্পবেল ৩১, মাডান্ডে ১২, বার্ল
১৯, জঙ্গুয়ে ১, আকরাম ১১, মাসাকাদজা ১৩, মুজারাবানি ৯, এনগারাভা ০; তাসকিন
৪-০-২০-২, তানজিম ৪-০-৪২-০, সাকিব ৩.৪-০-৩৫-৪, মুস্তাফিজ ৪-০-১৯-৩, তানভির
২-০-১৪-১, রিশাদ ২-০-৬-১)।
ফল: বাংলাদেশ ৫ রানে জয়ী।
সিরিজ: পাঁচ ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ৪-০ ব্যবধানে এগিয়ে।
ম্যান অব দা ম্যাচ: মুস্তাফিজুর রহমান।