এক বছরের ব্যবধানে
সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের নামে জমা থাকা টাকার পরিমাণে
ব্যাপক উল্লম্ফন হয়েছে; ৩৩ গুণের বেশি বেড়ে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৮ কোটি ৯৫
লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক।
গোপনীয়তার নীতির কারণে বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত দেশটির
ব্যাংকগুলোর কাছে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের এ পরিমাণ
অর্থ পাওনা রয়েছে; বর্তমান বিনিময় হার প্রতি ফ্রাঙ্ক ১৫০ টাকা ধরে এর
পরিমাণ ৮ হাজার ৮৩৫ কোটি ৫২ লাখ টাকার বেশি। ২০২৩ সালে এর পরিমাণ ছিল ১
কোটি ৭৭ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক; টাকার অঙ্কে ২৬৫ কোটি ১০ লাখ টাকা।
সুইজারল্যান্ডের
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) বৃহ্স্পতিবার তাদের
ব্যাংকগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বাংলাদেশিদের জমা থাকা ও
ব্যাংকগুলোর কাছে বাংলাদেশের ব্যাংকের পাওনার এসব তথ্য উঠে এসেছে।
আগের
বছর ২০২৩ সালে হঠাৎ করে সুইস ব্যাংকগুলো থেকে বাংলাদেশিদের জমা থাকার
অর্থের পরিমাণ কমে ১ কোটি ৭৭ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক হয়। এর আগের বছর ২০২২ সালে
এর পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৫২ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক। সে হিসাবে ২০২৩ সালে আগের বছরের
চেয় ৬৮ শতাংশ কমে ২৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যায়।
এক বছর
পরই বিশাল উল্লম্ফন দেখা গেল সুইস ব্যাংকগুলোর কাছে বাংলাদেশিদের পাওনা
হিসাবে, যা ২০১৫ সালের পর পঞ্চম সর্বোচ্চ। এ সময়ের মধ্যে ২০২১ সালে সবচেয়ে
বেশি ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক জমা ছিল সুইস ব্যাংকগুলোতে। এর আগে ২০১৬
সালে রাখা ৬৬ কোটি ১৯ লাখ ফ্রাঙ্ক ছিল সর্বোচ্চ; ১৯৯৬ সালে ছিল মাত্র ৩
কোটি ৮২ লাখ ফ্রাঙ্ক।
বিশ্বজুড়ে ধনী ব্যক্তিদের টাকা সুইস ব্যাংকে রাখার
আগ্রহের পেছনে মূল কারণ দেশটির গোপনীয়তার নীতি। সুইজারল্যান্ডের আইনে
ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য নয়। টাকার উৎসও তারা
জানতে চায় না। যদিও বিদেশি অর্থের তথ্যের গোপনীয়তার ক্ষেত্রে এখন ছাড়
দিচ্ছে সুইজারল্যান্ড।
কোন দেশের গ্রাহকদের কী পরিমাণ অর্থ
সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে জমা আছে, সেটির একটি ধারণা প্রতিবছর এসএনবির
বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায়। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদের
বাধ্যবাধকতা মেনে এসএনবি ওই তথ্য প্রকাশ করে। তবে সেখানে গ্রাহকের বিষয়ে
কোনো ধারণা পাওয়া যায় না।
তবে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নামে থাকা এসব
অর্থের যে পুরোটা পাচার হয়ে গেছে তেমনটা নয়। বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে
বাণিজ্যিক লেনদেনের পাশাপাশি বিদেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরাও বাংলাদেশের
নামে দেশটির ব্যাংকে অর্থ জমা রাখতে পারেন বলে অনেকে বলে আসছেন।
এর
সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ
হোসেন বলেন, এসএনবির তথ্য বলছে বাংলাদেশি ব্যাংক থেকে সুইস ব্যাংকে টাকা
স্থানান্তর হয়েছে। এখানে ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টের সংখ্যা
বেশি।
”তাই এখানে একটা প্রশ্ন উঠেছে যে ব্যবসার কারণে এটা বেড়েছে কি না।
কেননা সুইজারল্যান্ড বাংলাদেশের ব্যবসার বড় রকমের উৎস নয়। সুইজারল্যান্ডের
সঙ্গে আমাদের উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য নেই যে এটা হবে।“
তার ভাষ্য, এত
বিপুল পরিমাণে অর্থ বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো থেকে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে
জমা হওয়ার বাণিজ্যিক কোনো কারণ থাকার কথা না। বাণিজ্যিক কারণে যদি এটা না
হয় তাহলে অবশ্যই এটি ‘ক্যাপিটাল ফ্লাইট’ (পাচার)।
’ব্যাংক টু ব্যাংক’
হয়ে থাকলে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে হয়েছে কিনা সেই প্রশ্ন তুলে
তিনি বলেন, “আনুষ্ঠানিকভাবে যদি এ পরিমাণ অর্থ যেয়ে থাকে তাহলে এটা কীভাবে
সম্ভব হল? বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া তো এ অর্থ পাঠানো সম্ভব না।”
জাহিদ
হোসেন বলেন, “তবে এটা হতেও পারে কারণ সেসময় তো সুশাসনে সমস্যা ছিল। ৮
হাজার কোটি টাকা যদি ট্রান্সফার করতে চাই তাহলে কয়েকদিনের মধ্যেই ধাপে ধাপে
পাঠিয়ে দিয়ে প্রক্রিয়াটা শেষ করে দেওয়া যায়।
”ওই সময় জুন-জুলাইতে বড়
রকমের অর্থ দেশ থেকে নিয়ে যাওয়া তাদের জন্য অসম্ভব কোনো কিছু ছিল না–যদি
আপনি টপ লেভেলে সহায়তা পান। এটা তো একেবারে পাচার করার অর্থ বলা যায় না।
আমি শুনতে পারছি, বিদেশে শিক্ষার্থীর ফি হিসেবে ৬০০-৭০০ কোটি টাকা
ট্রান্সফার হয়েছে; জাস্ট টিউশন ফিস। এনিথিং ইজ পসিবল।”
তিনি বলেন,
“নিয়মের মধ্যে থেকেও তো অনিয়ম কাজ করা যায়। সরাসরি বাংলাদেশ থেকে সুইস
ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। রেগুলেটরের অনুমোদন ছাড়া এটা গেছে বলে মনে হয় না।
তখনকার রেগুলেটররাই এসব করত। সরিষার মধ্যে ভূত।”
এসএনবির বার্ষিক
প্রতিবেদনে দেশটির ব্যাংকগুলোর কাছে বাংলাদেশের ব্যাংকের এ পরিমাণ পাওনার
পাশাপাশি আমানতকারীদের জমার পরিমাণ ১ কোটি ২৬ লাখ ফ্রাঙ্ক। আগের বছর যা ছিল
১ কোটি ৩৯ লাখ ফ্রাঙ্ক।
এর বাইরে পুঁজিবাজারে সম্পদ ব্যবস্থাপনা
কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশের বিনিয়োগের ৮৬ লাখ ১৯ হাজার ফ্রাঙ্ক রয়েছে, যা
২০২৩ সালে ছিল ৮৬ লাখ ৭২ হাজার ফ্রাঙ্ক।
সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য
অনুযায়ী, দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অর্থের পরিমাণ প্রথমবার
১০ কোটি সুইস ফ্রাঙ্ক ছাড়িয়ে যায় ২০০৬ সালে, যেটি ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট
সরকারের শেষ বছর।
নয় কোটি ৭২ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক থেকে বেড়ে ওই বছর জমার পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ কোটি ৪৩ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক।
এরপর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম বছর ২০০৭ সালে জমা অর্থের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ২৪ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক হয়।
ক্ষমতাচ্যুত
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১১ সালে জমার পরিমাণ ছিল ১৫ কোটি ২৩ লাখ সুইস
ফ্রাঙ্ক, তা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০১৬ সালে তা ৬৬ কোটি ১৯ লাখে দাঁড়ায়।
পরের
বছর, অর্থাৎ ২০১৭ সালে তা কমে ৪৮ কোটি ১৩ লাখ সুইস ফ্রাঙ্কে নেমে এলেও
২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের বছরে তা আবারও বেড়ে ৬১ কোটি ৭৭ লাখ সুইস
ফ্রাঙ্কে দাঁড়ায়।
দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন নিয়ে কাজ করা
প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাষ্য হল, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের যে টাকা জমা রয়েছে,
তার ‘বেশিরভাগটাই অবৈধভাবে অর্জিত এবং বিদেশে পাচার’ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে সুইস ব্যাংকে জমা করা অর্থের পরিমাণ কমার সঙ্গে বিদেশে অর্থ পাচার কমে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা।