করোনা
সংক্রমণ ঠেকাতে চিকিৎসা প্রস্তুতি হিসেবে সারা দেশে যখন হাসপাতাল গুলো
প্রস্তুতির জন্য কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে, এদিকে জনবলের অভাবে বন্ধ হতে
চলেছে কুমিল্লার দুটি সরকারি আইসিইউ ইউনিট। গত করোনার মৌসুমে বিশেষায়িতভাবে
জীবন রক্ষাকারী এইসব ইউনিটের ৬০ টি বেড স্থাপন করা হলেও, এবার করোনা
শুরুতে এসব আইসিইউ ইউনিটের বেহাল দশা। বিগত ৮ মাস ধরে চিকিৎসক- স্টাফদের
বেতন ভাতা বন্ধ থাকায় অনেকটাই অচল হয়ে আছে দেড়শ কোটি টাকা মূল্যের আইসিইউ
সরঞ্জাম ।
কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের কোভিড ডেডিকেটেড আইসিইউ
ইউনিটের ইনচার্জ আবদুল মুকতাদির জানান, করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় জীবন
রক্ষাকারী ইউনিট হিসেবে ২০২০ সালের জুন মাসে কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতাল ও
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপন করা হয় এর দুটি বিশেষ আইসিইউ
ইউনিট। ইমারজেন্সি রেসপন্স এন্ড পেনডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রকল্পের আওতায়
এসব ইউনিটে জনবল নিয়োগ দেয়া হলেও গত ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে
যাওয়ায় ইউনিটগুলোতে দেখা দিয়েছে জনবল সংকট। দীর্ঘদিন বেতন ভাতা বন্ধ থাকায়
কোনরকম জোড়া তালি দিয়ে চলছে বিশেষায়িত এই দুইটি ইউনিটের কার্যক্রম
আবদুল
মুকতাদির বলেন, কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের ৩০ টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ১০
টি চালু আছ। তাও চলছে একজন চিকিৎসক ও ৪ জন নার্স দিয়ে। কোটি কোটি টাকার
জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম নষ্ট হচ্ছে। শুধুমাত্র দক্ষ জনবল নিয়োগ না থাকায়
সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ৷ এবার কোভিড সংক্রমন বাড়লে তখন এসব ইউনিটের
জন্য হাহাকার বাড়বে।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইজিও বিভাগের
জুনিয়র কনসালটেন্ট মাইন উদ্দিন মিয়াজী বলে, গত ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ
শেষ হয়ে যাবার পর বেতন ভাতা বন্ধ হয়ে যায়, অনেক চিকিৎসক নার্স চলে যান।
তারপরেও আমরা কয়েকজন চিকিৎসকন্যার্স এখনো কাজ করছি। চাইলেই এই মহামূল্যবান
স্বাস্থ্য সেবা ইউনিট ছেড়ে দেওয়া যায় না। আমরা চাই প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি
হউক, কারন আবারো করনার সতর্কতা জারি হয়েছে। বকেয়া বেতন ভাতা দিয়ে আবারো
চিকিৎসক নার্সদের ফেরত আনা হোক।
তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, গত
করোনার মৌসুম এর জীবন বাজি রেখে এই সব ইউনিটে আমরা কাজ করেছি। এখন
প্রকল্পের মেয়াদ বাতিল হয়ে যাওয়ায় আমাদেরকেই চলে যেতে হচ্ছে। আর গত মৌসুমে
যখন আইসিইউ এর জন্য হাহাকারে, একজন মৃত্যুবরণ করলে অপর একজন বাঁচার জন্য
সিট পাচ্ছিলেন- সেই অভিজ্ঞতার কথা চিন্তা করে এই আইসিইউগুলো এখনই চালু করা
প্রয়োজন।
জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটের ওয়ার্ড বয় হাবীবুর রহমান
বাবলু বলেন, গত ৮ মাস বেতন পাই না। তারপরও চাকরি ছেড়ে দেই নি। বেতন ভাতা
চালু করলে - লোকবলও বাড়বে, রোগীও বেশি চিকিৎসা দেয়া যাবে।
করোনাার প্রথম
ধাপ থেকে শুরু করে গত মৌসুমে প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষ কুমিল্লার
বিভিন্ন আইসিইউ ইউনিটের চিকিৎসা নিয়েছিলেন। এর মধ্যে আইসিইউতেই চিকিৎসাধীন
অবস্থায় প্রাণ হারায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ। আইসিইউ না পেয়ে কতজনের
প্রাণহানি হয়েছে সেটির কোন হিসাব নেই। অথচ করোনার চলতি মৌসুমে চিকিৎসা
কেন্দ্র প্রস্তুতের সতর্কতার সময়ে এসে সর্বোচ্চ বিশেষায়িত আইসিইউ ইউনিটের
এমন বেহাল দশা। রোগীর স্বজনরা বলছে, সরকারি এসব আইসিইউতে বিনামূল্যে
চিকিৎসা নেয়া যায়। করোনার সময় সবগুলো আইসিউ চালু থাকলে সুবিধা হবে
সুবিধাবঞ্চিত মানুষের। বিনামূল্যে পাবেন উচ্চমূল্যের চিকিৎসা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার শাহজাহান কবির (৬৫) গত দুই সপ্তাহ জেনারেল
হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার ভাতিজা মাহবুব আলম বলেন,
বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে এতদিন রোগী রাখলে কয়েক লাখ টাকা দিতে হত। অথচ
এখানে প্রায় বিনামূল্যেই আইসিউর সেবা পাওয়া যাচ্ছে। গরিব দুঃখী মানুষ
যাদের আইসিইউ প্রয়োজন তারা চাইলে এখান থেকে চিকিৎসা নিতে পারে। অথচ
শুধুমাত্র লোকবল এর অভাবে এখানে আইসিইউ সিটগুলো খালি পড়ে আছে।
আইসিইউ
তে চিকিৎসা নিচ্ছেন বুড়িচং উপজেলার শিকারপুর গ্রামের ১৪ বছর বয়সী হোসাইন।
তার মা শাহিনা বেগম জানান, আমার ছেলেকে আইসিইউ তে নিতে বলেছে। কিন্তু আমার
যা অর্থনৈতিক অবস্থা তাতে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে নেয়া সম্ভব হয়নি।
পরে আমার পরিচিত একজনের পরামর্শে সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এখানে কোন
টাকা পয়সাই লাগছে না। বরং ছেলে পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাচ্ছে।
স্বাস্থ্য
অধিদপ্তর সূত্রে, এই দুই হাসপাতালে ইআরপিপি প্রকল্পের করোনা আইসিইউ ইউনিট
জনবল শুন্য বলা হলেও, সরেজমিনে দেখা গেছে কয়েকজন চিকিৎসক ও নার্স
স্বপ্রনোদিত ভাবেই সেবা করছেন এখানে। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের
আইসিইউ ইউনিটের ৩০ টি বেডের মধ্যে চালু আছে ১০ টি বেড এবং কুমিল্লা জেনারেল
হাসপাতালের ৩০ টি বেডের মধ্যে চালু আছে ১০ টি। একজন করে চিকিৎসক ও চারজন
করে নার্স আয়া দিয়ে চলছে এই ইউনিটগুলো। আশেপাশেই অচল অবস্থায় পড়ে আছে কোটি
কোটি টাকার অমূল্য চিকিৎসা সরঞ্জাম।
কুমিল্লা সিভিল সার্জন আলী নূর
মোহাম্মদ বশির আহমেদ বলছেন, সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে আইসিইউ ইউনিটগুলোর
বিষয়ে জানানো হয়েছে। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কুমিল্লা জেনারেল
হাসপাতালের আইসি ইউনিটের প্রকল্প মেয়াদ শেষ হবার কারনেই চিকিৎসক ও স্টাফদের
বেতন ভাতা বন্ধ হয়ে যায় এবং স্থবিরতা শুরু হয়। তবে এসব বিষয়ে স্বাস্থ্য
মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর অবগত আছেন, আশা করছি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এই
জটিলতা নিরসন হয়ে আইসিইউ ইউনিট গুলো পুরোদমে চালু হবে।