মানব
সেবার মূলমন্ত্র নিয়ে রোভার স্কাউটের পথচলা। একজন রোভার স্কাউটের মূল কাজ
হলো নিজের সেবা করা, স্রষ্টার সেবা ও দেশকে সেবা করা। হজ ক্যাম্পের
অংশগ্রহণকারী রোভার স্কাউটদের স্মৃতি তাদের জীবনে একটি গভীর প্রভাব ফেলে।
এই ক্যাম্পে রোভার স্কাউটরা হজযাত্রীদের সেবা, নিরাপত্তা ও দিকনির্দেশনা
প্রদানের সহায়তা করে থাকে। এতে রোভার স্কাউটদের দায়িত্ব এবং অভিজ্ঞতা খুবই
প্রশান্তির।
মুলত প্রশিক্ষণ ও সেবার জন্যই স্কাউটিং পৃথিবীর অনেক দেশে
বিস্তৃতি লাভ করছে। বিশ্বের প্রায় ১৭২টি দেশে স্কাউট আন্দোলন সাড়া জাগাতে
সক্ষম হওয়ার মূল কারণ স্কাউটদের সেবার মনোভাব। দেশ ও সমাজের সেবা করে
যাচ্ছে প্রতিনিয়ত প্রতিটি রোভার স্কাউট। বন্যা, যানজট নিরসনে ট্রাফিকিং,
প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ দেশের যে কোন ক্লান্তিলগ্নে দেশ, সমাজ ও মানুষের
সেবার প্রয়োজনে তারা নির্ভীক সৈন্য ও নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করছে। রোভার
স্কাউটরা হজযাত্রীদের সহায়তায় মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে মানব সেবা, ধৈর্য, ও
সহমর্মিতার গুণাবলী জাগ্রত করে। দেশের বিভিন্ন জেলার কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ও
মুক্ত দলের রোভার স্কাউটদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ মেলে। এতে করে নিজ নিজ
এলাকার সংস্কৃতি এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের একটি অসাধারণ সুযোগ হয়।
রোভার
স্কাউটরা স্বেচ্ছা সেবামূলক কাজের মাধ্যমে স্কাউট নামটি সবার কাছে পরিচিতি
করতে সক্ষম হয়েছে। স্বেচ্ছা সেবামূলক কাজের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হজ্জ
ক্যাম্প। এর ধারাবাহিকতায় রোভাররা সেবা প্রদান করে ঢাকার আশকোনাস্থ স্থায়ী
হজ ক্যাম্পে। এই হজ ক্যাসেপ আমার ও কাজ করার সুযোগ হয় গত ২০০৪ সালে। আমার
অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল হজ ক্যাম্পে যাব এবং হজ যাত্রীদের সেবা করব। তাছাড়া
হজ ক্যাম্পে সেবাদানের জন্য সনদ প্রদান করে যেটা একজন রোভারের পি আর এস
অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তিতে সহায়তা করে।
কুমিল্লার সিডিউল ছিল ১- ৬ অক্টোবর
২০০৪ পর্যন্ত। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ রোভার গ্রুপের রোভার মেট
হিসেবে আমি এবং রোভার মেট মো. রাসেল দুই জন মনোনিত হই। আমরা ৩০ সেপ্টেম্বর
হজ ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম কুমিল্লা রেল স্টেশন থেকে ট্রেনে করে
ঢাকা এয়ারপোর্ট রেল স্টেশন। এয়ারপোর্ট রেল স্টেশন থেকে কয়েক মিনিট হাঁটলে
আশকোনা হজ ক্যাম্প।
আমরা আগের দিন রাতেই পৌঁছে ছিলাম হজ ক্যাম্পে।
পৌঁছানোর পর গোসল, খাওয়া দাওয়ার পর বিশ্রাম নেই। হজ ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিল
ঢাকা জেলা রোভারের তৎকালীন সহকারি কমিশনারও বাংলাদেশ স্কাউটসের সহকারি
লিডার ট্রেইনার কুমিল্লা দেবিদ্বারের কৃর্তি সন্তান আফরোজ সরকার। ক্যাম্পের
ডিউটি প্রতিদিন ছয় ঘন্টা করে চারটি শিফ্টে ভাগ করা ছিল। আর একজন রোভার এবং
গার্ল-ইন-রোভার প্রতিদিন দুই শিফ্ট করে কাজ করতে পারত। হজ ক্যাম্পে কাজের
চাপ অনেক বেশি। হজযাত্রীদের লাগেজ বহন, পথ নির্দেশ, স্বাস্থ্য সেবা, এবং
অন্যান্য কাজে সহায়তা করতে স্কাউটরা দিনরাত ব্যস্ত থাকতে হয়।
লিফ্ট
থাকার কারণে ব্যাগসহ হাজীদের উপরে ওঠা নামা সহজ ছিল। হজ যাত্রী ছাড়া অন্য
কেউ ডরমেটরীতে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কারণ চুরি ও বিশৃঙ্খলা এড়াতেই এই
ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। হজ যাত্রীদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করাই ছিল আমাদের
মূল উদ্দেশ্য।
হজ ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হয়েছে বিচিত্রসব
অভিজ্ঞতা। কারণ অনেক সময় অনেক সরকারি কর্মকর্তা উপরে উঠতে চাইতো কিন্তু
আমরা বাধা দেওয়ার কারণে তর্ক বিতর্ক সৃষ্টি হত মাঝে মাঝে। তখন শিফ্ট
ইনচার্জরা গিয়ে পরিস্থিতি শিথিল করে দিত। স্কাউটিং যে মানুষের কল্যাণে
নিবেদিত তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে।
হজ ক্যাম্পে সেবা করা নিঃসন্দেহে
অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক ও আত্মতৃপ্তির একটি কাজ। এটি এমন একটি সুযোগ, যেখানে
মানুষ আল্লাহর পথে যাত্রা করা হাজীদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা যায়। এই
ধরনের সেবায় অংশগ্রহণ করলে মানুষের হৃদয়ে একধরনের প্রশান্তি ও আধ্যাত্মিক
আনন্দ সৃষ্টি হয়। হাজীদের সহায়তা করতে গিয়ে তাদের কৃতজ্ঞতা, আন্তরিক দোয়া
এবং হাসিমুখে "জাজাকাল্লহ খাইরান" বলার মতো মুহূর্তগুলো সত্যিই হৃদয় ছুঁয়ে
যায়। এটি কেবল সেবামূলক কাজই নয়, বরং নিজের ধৈর্য, সহানুভূতি ও সহযোগিতার
মনোভাবকে উন্নত করারও এক সুযোগ। পাশাপাশি, এমন একটি পরিবেশে সময় কাটানো যায়
যেখানে ধর্মীয় অনুপ্রেরণা, সংযম ও নিবেদনের বার্তা প্রতিটি মুহূর্তে
অনুভূত হয়।
হজ ক্যাম্পে এমন একটি জায়গা, যেখানে হাজার হাজার হাজি
একত্রিত হন আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে। তাদের সেবা করার মাধ্যমে শুধু মানবিকতা
নয়, ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করারও এক অনন্য সুযোগ তৈরি হয়। সম্মানিত হাজীরা
আল্লাহর মেহমান, তাঁদের সেবা করা মানে আল্লহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি
সুযোগ। যখন কোনো হাজী কৃতজ্ঞতার সঙ্গেদোয়া করেন বা হাসিমুখে ধন্যবাদ দেন,
তখন হৃদয় প্রশান্তিতে ভরে যায়।
স্মরণীয় মুহূর্ত কোনো বৃদ্ধ হাজীকে তার
প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হাতে তুলে দেওয়া। কোনো অসুস্থ হাজীকে হাসপাতালে পৌঁছে
দেওয়া, তাদের হজের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তথ্য দিয়ে সাহায্য করা, এই ছোট ছোট
কাজগুলো এক সময় স্মৃতির ভান্ডারে চিরকাল জায়গা করে নেয়। হজ ক্যাম্পে কাজ
করা মানে পুরোপুরি সৎ ও নিষ্ঠাবান থাকা। এখানে কাজের কোনো প্রতিদান
প্রত্যাশা না করে সম্পূর্ণ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা হয়। এটি আমাদের
চরিত্র গঠনে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মত হজ ক্যাম্পে
রোভার স্কাউটের সেবাকার্যক্রম শুরু হয়। সেই থেকে প্রতি বছর ৩৫-৪০ দিনব্যাপী
রোভার স্কাউটরা সম্মানিত হজ যাত্রীগনকে সেবা দিয়ে থাকে। প্রতিদিন ৬ঘন্টা
করে ৪টি শিফটে প্রায় ১০০জন রোভারও গার্ল-ইন রোভার স্কাউট ও কর্মকর্তা হজ
ক্যাম্পে সেবাদান কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। হজ ক্যম্পে রোভার স্কাউটরা
সেবাদান কার্যক্রমকে একটি পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে মনে করে অত্যন্ত আন্তরিকতা
ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে থাকে।
রোভাররা হজ ক্যাম্পে সেবাদানে অগ্রণী
ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রতিদিন ডিউটি শেষে রাত ১২টায় সভা বসত, প্রতিদিনের
পর্যালোচনা ও পরবর্তী দিনের কার্যক্রম নিয়ে। যা ছিলো ব্যতিক্রমী আকর্ষণীয়।
কাজের
ফাঁকে আমরা একদিন বিমানবন্দরে ঘুরে দেখতে যাই। সেখানে বেড়ানোর অনুমতি পাই
শুধুমাত্র রোভার হওয়ার কারণে। হজ ক্যাম্প থেকে প্রতিটি শিফটে ইনচার্জ
পরিবর্তন করা হয়। যেখানে সকলের সুযোগ তৈরি হয় নেতৃত্ব দেওয়ার। ফলে বিভিন্ন
ইউনিটের রোভাদের নেতৃত্ব দিয়ে আমরা আরো দক্ষ ও প্রশিক্ষিত হয়ে উঠতে পেরেছি।
এভাবে দেখতে দেখতে ছয়দিন পার হয়ে যায়। আমরা রিলিজ সার্টিফিকেট নিয়ে
কুমিল্লা উদ্দেশ্য বাসে উঠে বারবার মনে হয় আবার যেন হজ ক্যাম্পে আল্লাহর
মেহমানদের সেবা করার সুযোগ স¥ৃতি হয়ে থাকবে স¥ৃতি হয়ে থাকবে।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।
সম্পাদক, বাংলদেশ স্কাউটসÑ কুমিল্লা জেলা রোভার