শনিবার ২৪ মে ২০২৫
১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
আজকের বাস্তবতায় পরিসংখ্যানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
মোহাম্মদ মাসুদ রানা চৌধুরী
প্রকাশ: শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫, ১:০১ এএম |


আজকের বাস্তবতায় পরিসংখ্যানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
ইংরেজ পরিসংখ্যানবিদ  কার্ল পিয়ারসন পরিসংখ্যানকে ‘বিজ্ঞানের ব্যাকরণ’ বলে অভিহিত করেছেন। দার্শনিক জর্জ বার্নার্ড শ'র মতে একজন বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ হচ্ছেন তিনি যিনি পরিসংখ্যানকে অনুসরন করে কাজ এগিয়ে নেন। অ্যান্ডস ডানকেলস এর মতে পরিসংখ্যান নির্ভুল নাও হতে পারে, তবে পরিসংখ্যান ছাড়া প্রকৃত সত্য বলা খ্বুই কঠিন।
বর্তমান যুগ হলো উন্মুক্ত উপাত্তের যুগ। পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদের একটি এখন উপাত্ত । যে দেশ যত বেশি উন্নত সে দেশের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা ততো বেশি উন্নত। সারা বিশ্বেই ডেটা বিপ্লব নামে এক ধরনের বিপ্লব সংগঠিত হচ্ছে। দ্রুতগতিতে ব্যাপক হারে উপাত্ত সৃষ্টি করা হচ্ছে। উপাত্ত বিশ্লেষণের জন্য মেশিন লার্নিং, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো নতুন প্রযুক্তি সৃষ্টি হচ্ছে। বৃহৎ টেক জায়ান্ট গুগল, আমাজন, ফেসবুক, অ্যাপল, মাইক্রোসফট- কোম্পানিগুলোর সংগ্রহে কোটি কোটি মানুষের গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত রয়েছে। ২০২৩ সালে বিশ্বে  ডাটা তথা উপাত্তের বাজারের আকার ছিল ১১২ বিলিয়ন ডলার যার আকার ২০২৮ সালে ১৯০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।বর্তমান ইন্টারনেটের যুগে উপাত্ত এখন সকল শ্রেণির কাছে তাৎক্ষণিক পৌঁছে যাচ্ছে। এর ফলে বিশ্ব ক্রমশই হাতের মুঠোয় এসে যাচ্ছে এবং বিশ্বকে আরও বৃহত্তর পরিসরে জানার সুযোগ হচ্ছে এবং তা নতুন নতুন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি নীতিগত  সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখছে। 
সভ্যতার শুরু থেকেই রাজস্ব সংগ্রহ, সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জনশুমারির জন্য উপাত্ত ব্যবহার করা হতো। শিল্প বিপ্লবের সময়ে শিল্পায়নের ব্যাপক প্রসারের সাথে সাথে উপাত্ত সংগ্রহ বাড়তে থাকে। বিংশ শতাব্দীতে এসে প্রযুক্তি ও কম্পিউটার আবিষ্কারের ফলে উপাত্তের পরিধি ব্যাপকতা লাভ করে। আর ডিজিটাল যুগে ইন্টারনেট সম্প্রসারণের ফলে উপাত্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণে এক নতুন মাত্রা লাভ করেছে। বাংলাদেশে যখন স্বাধীনতার পর প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছিলো তখনই ব্যাপক উপাত্তের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক, দেশীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈশ্বিক পর্যায়ে বিভিন্ন রেটিং প্রণয়নের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পরিসংখ্যানের উপর নির্ভর করতে হয়। জিডিপি’র / মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে কোন দেশের অবস্থান কি, সুখী দেশের তালিকা প্রণয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সূচকে বিভিন্ন দেশের অবস্থান এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিভিন্ন দেশের অবস্হান জানার জন্যও পরিসংখ্যানের উপর নির্ভর করতে হয়।
যে কোনো দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সঠিক ও সময়োচিত পরিসংখ্যান প্রণয়ন ও ব্যবহার অপরিহার্য। পরিসংখ্যান একটি দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপট ফুটিয়ে তোলে যা উক্ত দেশের অগ্রগতি ও বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে। পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য সঠিক ও সময়ানুগ পরিসংখ্যান অপরিহার্য। আর্থসামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ সর্বক্ষেত্রে সুষম ও সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য প্রয়োজন যথাযথ তথ্য-উপাত্ত তথা নির্ভুল পরিসংখ্যান। সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, পরিবীক্ষণ ও তার সফল বাস্তবায়নে সঠিক ও সময়োপযোগী পরিসংখ্যান দিকনির্দেশক তথা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে থাকে। এক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠ ও প্রামাণ্য পরিসংখ্যানিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, সংকলন ও প্রকাশনা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রতিটি সেক্টরে নির্ভুল, সময়ানুগ ও জনকল্যাণমুখী পরিসংখ্যানের প্রয়োগ একান্ত অপরিহার্য। একটি দ্রুত অগ্রসরমান অর্থনীতিতে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন ছাড়াও রাষ্ট্রের প্রশাসনিক নীতি নির্ধারণে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব অপরিসীম।
বাংলাদেশে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তিনটি বিভাগের অন্যতম একটি হচ্ছে 'পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ'। এ বিভাগের  আওতাধীন 'বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)' দেশের জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা হিসেবে পরিসংখ্যান সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে। দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, জনমিতি, কৃষি, নারী উন্নয়ন, মানবসম্পদ, পরিবেশ ও জলবায়ু ইত্যাদি ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও গবেষণার জন্য বিবিএস দাপ্তরিক পরিসংখ্যান সরবরাহ করে আসছে। বিবিএস জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্বের অন্যান্য দেশের জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা এবং উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। ২০১৩ সালে পরিসংখ্যান আইন, ২০১৪ সালে পরিসংখ্যান প্রস্তুত ও প্রকাশ বিধিমালা, ২০১৬ সালে প্রণীত পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালা এর আলোকে বিবিএস যুগোপযোগী প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন শুমারি ও জরিপ পরিচালনার মাধ্যমে সরকারের পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা,দপ্তর ও অধিদপ্তরের সাথে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রেখে দাপ্তরিক পরিসংখ্যান প্রস্তুতে সহায়তা করে যাচ্ছে।
জনশুমারি ও গৃহগণনা, কৃষি শুমারি, অর্থনৈতিক শুমারিসহ অন্যান্য শুমারি ও জরিপের পাশাপাশি জিডিপির ভিত্তিবছর পরিবর্তন, ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই), মজুরি হার সূচকসহ অন্যান্য সূচকের ভিত্তিবছর পরিবর্তনের কার্যক্রম নিয়মিতভাবে বিবিএস থেকে করা হয়। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) সংক্রান্ত বিভিন্ন সূচকের উপাত্ত প্রদান করে বিবিএস এসডিজি বাস্তবায়ন অগ্রগতি পরিবীক্ষণে ভূমিকা পালন করছে। 
প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে এ পর্যন্ত বিবিএস নিম্নবর্নিত বিভিন্ন  গুরুত্বপূর্ণ শুমারি ও জরিপ পরিচালনা করেছে:
১. জনশুমারি ও গৃহগণনা -১৯৭৪ সাল থেকে ১০ বছর অন্তর অন্তর এ পর্যন্ত মোট ৫টি শুমারি পরিচালিত হয়েছে।
২. অর্থনৈতিক শুমারি- ১৯৮৬ সাল থেকে মোট ৩ টি শুমারি পরিচালিত হয়েছে।
৩. কৃষি শুমারি- ১৯৭৭ সাল থেকে মোট ৪ টি শুমারি পরিচালিত হয়েছে।
৪. খানার আয় ব্যয় জরিপ- ১৯৭৩-৭৪ সাল থেকে মোট ১৫ টি জরিপ পরিচালিত হয়েছে।
৫. শ্রমশক্তি জরিপ- ১৯৮০ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ১৩ টি জরিপ পরিচালিত হয়েছে।
৬. স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সার্ভে- ১৯৮০ সাল থেকে বাৎসরিক ভিত্তিতে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
৭. উৎপাদন শিল্প জরিপ -১৯৭২ সাল থেকে ২৮ টি জরিপ পরিচালিত হয়েছে।
৮. মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে -১৯৯৩ সাল থেকে ১২ টি জরিপ পরিচালিত হয়েছে।
৯. চাইল্ড নিউট্রিশন সার্ভে- ১৯৮৫-৮৬ সাল থেকে ৭ টি জরিপ পরিচালিত হয়েছে।
১০. কৃষি দাগগুচ্ছ জরিপ -১৯৭৪ সাল থেকে বাৎসরিক ভিত্তিতে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
১১. ওয়েজ রেট সার্ভে -১৯৭৪ সাল থেকে বাৎসরিক ভিত্তিতে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
১২. মূল্য ও মজুরি পরিসংখ্যান -১৯৭৪ সাল থেকে বাৎসরিক ভিত্তিতে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
১৩. হেল্থ অ্যান্ড ডেমোগ্রাফিক সার্ভে -১৯৮০ সাল থেকে ৫ টি জরিপ পরিচালিত হয়েছে।
১৪. কৃষি ফসলের আয়তন ও উৎপাদন জরিপ-    ১৯৭২ সাল থেকে বাৎসরিক ভিত্তিতে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
১৫. পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ পরিসংখ্যান-    ২০১৬ সাল থেকে জরিপ ও সেকেন্ডারি উৎস হতে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহপূর্বক পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ পরিসংখ্যান প্রকাশিত হচ্ছে।
১৬. কৃষি শুমারি ২০১৯ সালে সম্পন্ন হয়েছে।
সঠিক ও সময়োপযোগী পরিসংখ্যান সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে, দেশের জন্য চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে সহায়তা করে এবং ভবিষ্যতে সম্ভাবনার বিষয়ে তথ্য যোগান দেয়।  বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিসংখ্যান বিষয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্ব ব্যাংক, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ও কোরিয়া সরকারের কঙওঈঅ এর সহায়তায় বিভিন্ন প্রকল্প/ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। এতে করে সঠিক তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, ডাটা সংরক্ষণ ও মানব সম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশা করা যায় আগামী দিনগুলোতে আর্থ-সামাজিক আরো বিভিন্ন বিষয়ে সময়োপযোগী, নির্ভূল পরিসংখ্যান প্রণয়ন করা সম্ভপর হবে। সঠিক, সময়ানুযোগী ও নির্ভুল পরিসংখ্যান প্রণয়নের হাত ধরে সঠিক নীতি নির্ধারণ করা সম্ভব হবে এবং তার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার কাংখিত লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে এটি আমাদের সবার একান্ত চাওয়া।
লেখকঃ পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।












সর্বশেষ সংবাদ
পলাতক বাহার কন্যা সোনালী শারজায়, যাচ্ছেন সূচিও
ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যেই নির্বাচন, একদিনও এদিক-সেদিকের সুযোগ নেই: উপদেষ্টা রিজওয়ানা
অর্ধ কোটি টাকা মূল্যের মাদক ও অবৈধমালামাল জব্দ
আরব আমিরাতে ঈদুল আজহার সম্ভাব্য তারিখ প্রকাশ
জাতীয় স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে: জামায়াত
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লার সাবেক এমপি বাহারের মেঝ মেয়ে সোনালী শারজায়, যাচ্ছেন সূচিও
দুর্বৃত্তদের হামলায় ব্রাহ্মণপাড়া যুবলীগ নেতার মৃত্যু
কুমিল্লা সেনানিবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন ডিসি,এসপি, ভিসিসহ ২৬ জন
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ফিরে আসার সম্ভাবনা নাই
আজকের বাস্তবতায় পরিসংখ্যানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২